উয়েফা নেশনস লিগ—নতুন টুর্নামেন্ট পুরোনো ফ্রান্স

ম্যাচের শেষ বাঁশি বাজতে না বাজতেই ক্যামেরা তাক করা হলো করিম বেনজেমার দিকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। বিশ্বজয়ের আনন্দ যেন অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পড়ছে তাঁর চোখ থেকে। ক্যামেরা অন্যদিকে ঘুরতেই দেখা গেল বিজয়ের অন্যরূপ। কিলিয়ান এমবাপ্পে নিজের দুই হাত আকাশে তুলে বিশ্বজয়ের হাসি নিয়ে ছুটে গেছেন গ্যালারিতে। দুটি আনন্দের ধরন আলাদা হলেও আনন্দের গল্পটা একই সূত্রে গাঁথা।

বলছি ফ্রান্স দলের নেশনস লিগ জয়ের কথা। আন্তর্জাতিক ফুটবলে নেশনস লিগ নামটা বেশ নতুন। মাত্র দ্বিতীয় আসর বসেছে এ বছর। এই টুর্নামেন্টের পেছনে মূল কারণ অবশ্য একটু জটিল। নেশনস লিগের আগে ইউরোপে আন্তর্জাতিক দলগুলো মুখোমুখি হতো দুটি টুর্নামেন্টের জন্য। বিশ্বকাপ আর ইউরো বাছাইপর্ব। আর সেসব বাছাইপর্বের খেলার ড্র এমনভাবে করা হতো যে বড় দলের সঙ্গে খেলা ছোট কোনো দলের। যেমন স্পেন-জার্মানির মতো দলের বিপক্ষে সাইপ্রাস-কসোভোর মতো দল মুখোমুখি হতো নিয়মিতই।

এতে করে যাঁরা আন্তর্জাতিক ফুটবলের নিয়মিত দর্শক নন, তাঁদের কাছে বড় টুর্নামেন্ট বাদে অন্য কোনো খেলার আকর্ষণই ছিল না তেমন। বরং যাঁরা আন্তর্জাতিক ফুটবলের দর্শক নন, তাঁদের কাছে বিরক্তির চূড়ান্তে পৌঁছেছিল ‘ইন্টারন্যাশনাল ব্রেক’। এ ছাড়া ইন্টারন্যাশনাল ব্রেক আর ইনজুরি তো একসময় সমার্থক শব্দই হয়ে উঠেছিল।

তা থেকে বের হতেও নতুন কিছু খোঁজা শুরু করে উয়েফা। আর সেটিই হলো উয়েফা নেশনস লিগ। উয়েফার অধীনে মোট ৫৫টি দেশ খেলে। আর তাদের র‍্যাঙ্কিং অনুযায়ী ভাগ করা হয়েছে মোট চারটি ডিভিশন (League A, B, C, D) প্রথম তিন ডিভিশনে ১৬টি ও শেষ ডিভিশনে সাতটি দল নিয়ে। এই ১৬টি দলকে আবার ভাগ করা হয়েছে চারটি গ্রুপে। যেমন A গ্রুপের কথাই ধরা যাক। A1 গ্রুপে রয়েছে র‍্যাঙ্কিংয়ের ১-৪, A2 তে রয়েছে ৫-৮, A3 তে ৯-১২, A4 তে ১৩-১৬। চারটি গ্রুপ থেকে একটি করে দল নিয়ে হয় চার দলের গ্রুপ। সেখানে চার গ্রুপের শীর্ষ চার দল সুযোগ পায় নেশনস কাপের ফাইনালে। আর শেষ দল নেমে যায় লিগ ‘বি’ তে। একই ভাবে লিগ ‘বি’ এর চার গ্রুপের সেরা চার দল উঠে আসে লিগ ‘এ’ তে। আর নিচে থাকা চার দল চলে যায় লিগ ‘সি’ তে। নিয়ম মূলত এটুকুই।

বলতে পারো এই এত ঘোরপ্যাঁচের নিয়ম করার কী প্রয়োজন? প্রয়োজনটা নিচের সারির দলগুলোর জন্য। আগে বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব-ফিফা ফ্রেন্ডলি ম্যাচে ওপরের সারির দলগুলোর সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে বারবারই হেনস্তা হতে হতো দলগুলোকে। কিন্তু এই নেশনস লিগ হওয়ার ফলে তারা যেমন নিজেদের সারির দলের সঙ্গে খেলতে পারছে, সেই সঙ্গে বড় দলগুলোও পাচ্ছে নিয়মিত বড় দলের বিপক্ষে খেলার সুযোগ। এতে করে দর্শকরাও ক্লাবের খেলা না থাকলে সময় কাটানোর জন্য পাচ্ছে জমজমাট একটি ম্যাচ। সব মিলিয়ে দুই দিক দিয়েই লাভ। উয়েফার নিজেদের পকেট ভরার জন্য এর চেয়ে ভালো আইডিয়া আর কিছু হতে পারে না।

লিগ ‘এ’–এর চার গ্রুপের শীর্ষ চার দলকে নিয়ে দুই বছর শেষে বসে উয়েফা নেশনস লিগ ফাইনাল। চার শীর্ষ দল মুখোমুখি হয় সেমিফাইনাল আর ফাইনাল খেলার জন্য। আর সেখানেই জমে থাকে রোমাঞ্চ ঠিকরে বের হয়!

ইউরো–জয়ী ইতালি, বিশ্বজয়ী ফ্রান্সের সঙ্গে তরুণ স্পেন আর গোল্ডেন জেনারেশনের বেলজিয়াম; কাগজেকলমে ইউরোপের সেরা চার দলই উঠে এসেছিল শিরোপার শেষ লড়াইয়ে। আর নেশনস লিগের মতো টুর্নামেন্টে, যার সূচনাই হয়েছে টানটান উত্তেজনাকর ম্যাচের জন্য; সেখানে যে পরিমাণ রোমাঞ্চ আশা করা যায়, তার সবটাই পুষিয়ে দিয়েছে তারা।

প্রথম সেমিফাইনালে সবাই ফেবারিট ধরেই রেখেছিল ইতালিকে। ইউরোজয়ী দল তারা, সেই সঙ্গে অপরাজিত ৩৭ ম্যাচ ধরে। অন্যদিকে স্পেনের খেলার ধরন নিয়ে বিরক্ত খোদ স্প্যানিশ সমর্থকরাই। দলভর্তি তরুণ তারকা, নেই কোনো স্ট্রাইকার। অথচ এই দলটিই ফেবারিট ইতালিকে নাকানি-চুবানি দিল ম্যাচের প্রথমার্ধে। ফেরান তোরেস একা হাতে ম্যাচ বের করে নিয়ে গেলেন ইতালির কাছ থেকে।

আবার দ্বিতীয় সেমিতে চিত্রনাট্য আরও জটিল। বেলজিয়ামের প্রথমার্ধের দুই গোল দেখে আগের সেমির মতোই ফলাফল ভেবে রেখেছিলেন সবাই। সবাই ভেবেই নিয়েছিল, অবশেষে বেলজিয়ামের গোল্ডেন জেনারেশন হয়তো শিরোপার মুখ দেখবে। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধ আসতে না আসতেই বেলজিয়ান ডিফেন্স লন্ডভন্ড করে দিলেন এক বেনজেমা। ডি-বক্সের ভেতর পাঁচজন ডিফেন্ডারের মধ৵ দিয়ে অসাধারণ এক শট জালে জড়ালেন বেনজেমা। এতটাই অবিশ্বাস্য একটি গোল ছিল যে ক্লাবের সতীর্থ গোলরক্ষক থিবো কর্তোয়া নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। সে জায়গা থেকে গোল দূরে থাকুক, পোস্টে শট রাখাই দুরূহ। এমন এক গোলই চুরমার করে দিয়েছিল বেলজিয়াম দলের কনফিডেন্স। বাকিটুকু ফ্রেঞ্চ দল কাজে লাগিয়েছে নিজের মতন করে। এমবাপ্পের পেনাল্টি আর শেষ মিনিটে থিও হার্নান্দেসের গোলে নাম লিখিয়েছে ফাইনালে।

দুই সেমিফাইনাল যে রোমাঞ্চ দেখিয়েছিল, স্পেন-ফ্রান্সের প্রথমার্ধ যেন সেই রোমাঞ্চে পানি ঢেলে দিল। দুই দল নিজেদের হাফে, যতটা পারা যায় সাবধানী ফুটবলে মত্ত। নেশনস লিগে এমন ফুটবল কে দেখতে চান? কিন্তু দুই দলের জন্যই বিরক্তিকর ফুটবল খেলাটা জরুরি ছিল, ঝুঁকি নিতে চাচ্ছিল না কেউই। ৯ বছর পর আন্তর্জাতিক শিরোপার এতটা কাছে স্পেন, অন্যদিকে ফ্রান্সের সবচেয়ে তারকাভর্তি দল এটা, এ দল নিয়ে শিরোপা না জেতা কোচ দিদিয়ের দেশমের জন্যই অপমানসূচক। দুইয়ে দুই চার মিলিয়ে দুই দলই নিজেদের সাবধানী খেলাটা খেলছিল। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধ আসতে না আসতেই রাতারাতি বদলে গেল দুই দলের খেলা।

শুরুটা করেছিলেন স্পেনের মিকেল ওয়ারজাবাল। কিন্তু স্পেনকে গোলের আনন্দটাও ঠিকমতো করতে দেননি করিম বেনজেমা। সেমিতে চোখ ধাঁধানো এক গোল করে নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু ফাইনালটা আরও স্মরণীয় করে রাখতে চাইলেন নিজের মতন করে। পাঁচ বছর জাতীয় দলে বারবার নিষ্পেষিত হয়েছেন, সতীর্থের ব্ল্যাকমেলিংয়ের অভিযোগ গড়িয়েছে আদালত পর্যন্ত। সেখান থেকে নির্দোষ হয়ে ফেরত এসেছেন, কিন্তু জাতীয় দলে কোচ ডেকে পাঠাননি। বছরের পর বছর পরিশ্রম করে গেছেন, কোচের প্রিয়পাত্র হতে পারেননি। বিশ্বকাপ জিতেছে ফ্রান্স, বাসায় বসে তা দেখেছেন বেনজেমা। মনে কষ্ট লুকিয়ে বাইরের উৎসব দেখিয়েছেন।

ইউরো তো যখন অবশেষে ডাক পেয়েছেন কোচের কাছ থেকে, জাতীয় দলে নিজেকে প্রমাণের জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন বেনজেমা। পাঁচটি বছর চলে গেছে তাঁর জীবন থেকে। শেষ যেবার ফ্রান্স দলে ছিলেন, সেবার ছিলেন ফ্রান্সের একমাত্র তারকা। আর এখন সেই দলে তারকারাজি। কিন্তু করিম বেনজেমা জানেন কীভাবে তারকারাজির মধে৵ও নিজেকে অনন্যভাবে চেনাতে হয়। প্রমাণ? ফাইনালের গোলটাই। ডি-বক্সের মাথায় যখন পাসটা পান, একমুহূর্ত চোখ বোলালেন আশপাশে। এখান থেকে তিনজন ডিফেন্ডারের মধ৵ থেকে শট নেওয়ার অর্থ একটিই, নিশ্চিত মিস। বেনজেমা সেই সুযোগটাই নিলেন। না কোনো ডিফেন্ডার, না গোলকিপার; কারোর সাধ্য ছিল না সে শট থামানোর। গোলরক্ষকের হাত ছুঁয়ে পৌঁছে গেল বল জালে। প্রথমার্ধে যাঁরা রোমাঞ্চ দেখার অপেক্ষায় ছিলেন, তাঁরা হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন কতক্ষণ।

ম্যাচ শেষ হওয়ার ১০ মিনিট আগে স্পেনের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিলেন কিলিয়ান এমবাপ্পে। কয়েক মাস আগেই পেনাল্টি মিস করে চোখের বালি হয়েছিলেন ফ্রান্সবাসীর। ফ্রান্সকে বিশ্বকাপের পর আরেকটি শিরোপা উপহার দেওয়ার বড় সুযোগ সেদিন নিজ হাতে নষ্ট করেছিলেন এমবাপ্পে। এবারে সে সুযোগ ছাড়েননি। গোল করেই বাচ্চাদের মতন আনন্দে মেতে উঠেছেন। ২২ বছর বয়সে দু-দুটি শিরোপা উপহার দেওয়া কম কথা নয়। সে গোল অফসাইড নাকি তা নিয়ে বড়সড় ঝামেলা হয়ে গেছে বটে। কিন্তু তাতে কী? ফ্রান্সের অদেখা স্বপ্ন তো পূরণ হয়ে গেছে! নেশনস লিগের শিরোপা শোভা পাচ্ছে এখন ফ্রান্সের ক্যাবিনেটে।

নেশনস লিগের দ্বিতীয় আসরটা হয়ে রইল শাপমোচনের এক আসর। পাঁচ বছর আগে জাতীয় দলে ব্ল্যাকমেলিংয়ের অভিযোগ এনে বাদ দেওয়া হয়েছিল করিম বেনজেমাকে। পাঁচ বছর জাতীয় দলে খেলতে না পেরে কত অপমানের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাঁকে। ভেঙে পড়েননি তাতে। ফিরে এসে একা দলকে টেনেছেন ইউরোতে, আর নেশনস লিগে তো সর্বোচ্চ গোলদাতার পাশাপাশি ফাইনালের সেরা খেলোয়াড়ও তিনি। অন্যদিকে পেনাল্টি মিস করে এক রাতের মধ্যেই কত অপবাদ শুনতে হয়েছিল ২২ বছর বয়সী এমবাপ্পেকে।

বীরদের জন্য এমন মঞ্চ তৈরিই ফিরে আসার জন্য, শাপমোচনের জন্য। তাই এবারের নেশনস লিগটা বেনজেমা-এমবাপ্পের শাপমোচনের গল্প হয়েই রইল।