এভাবেই জেতে রিয়াল মাদ্রিদ

ফুটবল পণ্ডিতদের অনেকে ভেবেছিলেন, উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের এই মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদের পক্ষে ভালো করাটাই হবে ‘অসম্ভব’। তাঁদের যুক্তির অবশ্য কমতি ছিল না। দল ছেড়েছেন রিয়াল ডিফেন্সের দুই স্তম্ভ সের্হিও রামোস আর রাফায়েল ভারানে। রিয়াল ইতিহাসের সেরা কোচ জিনেদিন জিদানও বিদায় নিয়েছেন। রিয়ালকে নিয়ে তাই শঙ্কাতেই ছিলেন তাঁরা।

কিন্তু পণ্ডিতেরা ভুলে গিয়েছিলেন, দলটা রিয়াল মাদ্রিদ আর টুর্নামেন্টটা চ্যাম্পিয়নস লিগ। ১৩ বার এই টুর্নামেন্টের শিরোপা উঁচিয়ে ধরেছে রিয়াল মাদ্রিদ। সেই শিরোপা জিততে তাদের ফেবারিট হতে হয় না।

রিয়াল মাদ্রিদ সেই কথারই প্রমাণ দিয়েছে প্রতিটি ম্যাচে। কে ছিল না তাদের প্রতিপক্ষ? এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগে কঠিন সব প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হয়েছিল রিয়াল। গ্রুপ পর্বে সিরি ‘আ’জয়ী ইন্টার, রাউন্ড অব সিক্সটিনে পিএসজি, কোয়ার্টার ফাইনালে গতবারের চ্যাম্পিয়নস লিগজয়ী চেলসি, সেমিফাইনালে ম্যান সিটি আর ফাইনালে তো পরাক্রমশালী লিভারপুল! কিন্তু একবারও দমে যায়নি রিয়াল। মচকেছে কিন্তু ভাঙেনি।

পিএসজির বিপক্ষে ম্যাচটাই দেখো, ১৫০ মিনিট পর্যন্ত এগিয়ে ছিল পিএসজি। জয়টাকে তখন মেসি-নেইমার-এমবাপ্পেদের হাতের মুঠোয় বলেই মনে হচ্ছিল। এরপর এক ধূমকেতুর মতো জ্বলে উঠলেন করিম বেনজেমা। ৬১ থেকে ৭৮—১৬ মিনিটের ঝড়ে তছনছ হয়ে গেল প্যারিস।

কোয়ার্টার ফাইনালে রিয়ালের মুখোমুখি গতবারের চ্যাম্পিয়নস লিগজয়ী চেলসি। গতবার রিয়ালকে হারিয়েই চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে পা রেখেছিল তারা। রিয়ালের সামনে প্রতিশোধ নেওয়ার এক সুবর্ণ সুযোগ। আর এমন সুযোগ কেউ কি ছাড়ে? চেলসির মাটিতে চেলসির দর্শকদের সামনে ইতিহাস তৈরি করলেন করিম বেনজেমা। ইতিহাসের দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পর চ্যাম্পিয়নস লিগে টানা দুই ম্যাচে হ্যাটট্রিক করার রেকর্ড গড়লেন করিম। প্রথম লেগে রিয়াল ৩-১ গোলে এগিয়ে। কিন্তু সিনেমার রোমাঞ্চ তখনো যে বাকি!

ভিনিসিয়ুসের গোলেই চ্যাম্পিয়ন রিয়াল মাদ্রিদ

রিয়ালের মাঠে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল রিয়াল ডিফেন্স। ম্যাচের বাকি মাত্র ১৫ মিনিট, স্কোরলাইন রিয়াল ০, চেলসি ৩! পরাজয় তখন কড়া নাড়ছে রিয়ালের দরজায়। গত মৌসুমের মতো এই মৌসুমেও কি বেদনায় নীল হয়ে বাড়ি ফিরতে হবে রিয়ালকে? রিয়াল মাদ্রিদের সমর্থকেরা যখন নখ কামড়াচ্ছেন, তখনই ত্রাতা হয়ে এলেন লুকা মদরিচ। আউটসাইড অব দ্য ফুট দিয়ে বাড়ানো মাপা লব, একেবারে রদ্রিগোর পায়ে। নীল সিংহদের বুনো আনন্দ হঠাৎই পরিণত হলো নীল বেদনায়। এর পরের গল্পটা আগের মতোই। একবার মোমেন্টাম হাতে পেয়ে যাওয়া রিয়াল বাঘের মতোই হিংস্র। এরপর এক্সট্রা টাইম—তিন ডিফেন্ডারকে বোকা বানিয়ে ভিনিসিয়ুসের বাড়ানো ক্রস। সেখান থেকে করিম বেনজেমার হেড! পুরো মৌসুমে প্রতিপক্ষের মনে ত্রাস সৃষ্টি করেছিলেন যে দুজন, ঠিক সেই দুজনই হয়ে উঠলেন রিয়ালের রক্ষাকর্তা! নিজেদের মাটিতে ২-৩ গোলে হেরেও দুই লেগ মিলিয়ে ৫-৪ গোলে জিতে সেমিতে জায়গা করে নিল রিয়াল।

সেমিতে প্রতিপক্ষ পেপ গার্দিওলার ম্যানচেস্টার সিটি। অনেকে ভাবলেন, আর যা–ই হোক, এবার আর রিয়ালের ফাইনালে ওঠা হচ্ছে না। কিন্তু লড়াই হলো হাড্ডাহাড্ডি। ‘কেউ কারে নাহি ছাড়ে, সমানে সমান’ অবস্থা। সিটির ৪ গোলের বিপরীতে রিয়ালও শোধ করল ৩ গোল! ফুটবল রোমাঞ্চের সবটা তখনো বাকি।

গোলপোস্টে দেয়াল হয়ে ছিলেন থিবো কোর্তোয়া

রিয়ালের মাঠে চ্যাম্পিয়নস লিগ সেমিফাইনাল, দ্বিতীয় লেগ। ৮৯ মিনিট, স্কোরলাইন রিয়াল ০, সিটি ১। নিজ দলের পরাজয় চোখে দেখা সম্ভব হচ্ছিল না অনেকের। আস্তে আস্তে মাঠ ছাড়তে শুরু করেছিলেন অনেক মাদ্রিদিস্তা। পেপ গার্দিওলার জন্য টানা দ্বিতীয় চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল খেলা আর মাত্র ২ মিনিটের ব্যাপার। ১৯ বছর বয়সী রদ্রিগো মাঠে নেমেই ৮৮ সেকেন্ডের মধ্যে করে ফেললেন ২ গোল। ৮৮ সেকেন্ডের তাণ্ডব শেষে স্কোরলাইন রিয়াল মাদ্রিদ ২, ম্যান সিটি ১। খেলা অতিরিক্ত সময়ে। এরপর যেন ঠিক সেই চেলসি ম্যাচের পুনরাবৃত্তি; পেনাল্টিতে বেনজেমার গোল—রিয়াল মাদ্রিদ ফাইনালে।

রিয়ালের দুই ভরসা—বেনজেমা ও মদরিচ

পরপর তিন ম্যাচে ফিরে আসা, সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে গিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে নিজেদের জায়গা তৈরি করে নেওয়া—মুখে বলা যতটা সহজ, করে দেখানো ততটাই কঠিন। সেটাই করে দেখাল কার্লো আনচেলত্তির দল।

পুরো মৌসুমের পরিশ্রম বৃথা যায়নি। লিভারপুলের বিপক্ষে ফাইনালে প্রথমার্ধ রিয়াল সমর্থকদের বুকে কাঁপন ধরিয়েছে সালাহ-মানে-দিয়াজের আক্রমণ। আর তাঁদের সামনে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন থিবো কোর্তোয়া। অফসাইডে বাতিল হওয়া গোল কিংবা পুরো ৪৫ মিনিটে একটা শটও অন টার্গেটে রাখতে না পারা নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা ছিল না রিয়ালের। কারণ, রিয়ালের সাবেক অধিনায়ক সের্হিও রামোস স্পষ্ট গলায় একটা কথা বলে গিয়েছেন অনেক বছর আগে, ‘রিয়াল ফাইনাল খেলতে নামে না। রিয়াল ফাইনাল জিততে নামে।’ আর সেই জয়ই তুলে আনলেন ভিনিসিয়ুস জুনিয়র। ভালভার্দের ডিফেন্সচেরা পাসে আলতো ছোঁয়া, বল লিভারপুলের জালে। ওটুকুই যথেষ্ট ছিল। পুরো ম্যাচে একটা শট অন টার্গেট, একটা গোল আর তাতেই শিরোপা রিয়ালের। তিন দশকের ওপর কোচিং করানো কার্লো আনচেলত্তিকে এমনি এমনি ‘ডন’ ডাকা হয় না।

কার্লো আনচেলত্তি

‘ডন’ জানেন, কাকে কখন কীভাবে নামিয়ে ম্যাচ বের করে আনতে হয়। গত মৌসুমে ঠিক এই দলের অর্ধেক খেলোয়াড়কে বাতিলের খাতায় ফেলে দিতে চেয়েছিলেন অনেকে। অধিনায়ক, কোচ হারানো দলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন প্রায় ফুরিয়ে যাওয়া কার্লো আনচেলত্তি। কেই–বা এই দলকে ওপরের দিকে রাখবে?

স্প্যানিশে রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকেরা প্রায়ই একটা কথা বলেন, ‘আসি গানা এল মাদ্রিদ’, কথাটার অর্থ ‘রিয়াল মাদ্রিদ এভাবেই জেতে’। সত্যিই, রিয়াল মাদ্রিদ এভাবেই জেতে। পাশার দান উল্টে, প্রতিপক্ষের আনন্দকে হতাশায় পরিণত করে রিয়াল এভাবেই জেতে। যখনই রিয়াল মাদ্রিদকে নিয়ে সবার আশা ফুরিয়ে যায়, ভাবেন, রিয়ালের দিন ফুরিয়ে এসেছে; তখনই রিয়াল যায় আর আরেকটা চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে আসে। কারণ, এটাই তাদের ঐতিহ্য।

(কিশোর আলোর জুন ২০২২ সংখ্যায় প্রকাশিত)