ক্রিকেটজুড়ে ছয়ের জয়!

ক্রিকেটের সঙ্গে ছয়ের সম্পর্কটা দারুণ! ছয় বলে ওভার এবং এক বলে সর্বোচ্চ রান ছয়, বোলিং এবং ব্যাটিংয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয়ের সঙ্গেই ছয়ের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। আবার আন্তর্জাতিক ও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট মিলিয়ে টানা ছয় বলে ছয়টি ছয় মারার রেকর্ডটিও ঠিক ছয়জনের। এখন তো নিশ্চিত ক্রিকেটের সঙ্গে ছয়ের সম্পর্কটাকে প্রায় দৈবচীয় মনে হচ্ছে!

শুরুতে কিন্তু ক্রিকেটে ছয় এতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। ১৯৭৯-৮০ সালের আগে বিভিন্ন দেশে একেক মাপের ওভারে খেলা হতো। চার, পাঁচ এমনকি আট বলের টেস্টও দেখেছে বিশ্ব। প্রথম নথিভুক্ত ওভার ছিল চার বলের, ইংল্যান্ডে, ১৮০০ সালে। এরপর পরবর্তী প্রায় এক শতাব্দী চার বলের ওভারেই ক্রিকেট খেলেছেন ক্রিকেটের আদি জনকেরা। ছয় বলের প্রথম ওভার দেখা যায় অস্ট্রেলিয়ায়। সেটাও ১৮৯০ সালের দিকে, চার বলের ওভার একজন বোলারের জন্য বড়ই কম মনে হওয়াতে। ১৮৯০ সালে অস্ট্রেলিয়ায় এই বদল আসার পর ১৯০০ সালের দিকে ইংল্যান্ডেও ক্রিকেট খেলা শুরু হয় ছয় বলে। এরপর ছয় বলের ওভার বদলে পাঁচ ও আট বলের ওভারে খেলা হলেও চার বলে আর কখনো ফেরত যায়নি ক্রিকেট। তখন অবশ্য নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম ছিল না। ম্যাচের আগে টসের সময় দুই দলের অধিনায়ক যে মাপের ওভারের ব্যাপারে একমত হতেন, সে মাপের ওভারেই খেলা হতো ক্রিকেট। এ বিষয়ে অবশ্য তৎকালীন প্রচলিত রীতিকেই প্রাধান্য দেওয়া হতো। প্রথমবারের মতো ছয় ওভারে খেলা শুরু করে অস্ট্রেলিয়া অবশ্য সবার আগেই বদল এনেছে এ নিয়মে। ১৯২৪ সালে প্রথমবারের মতো আট বলের ওভার শুরু করে তারা। মনে করা হচ্ছিল, আট ওভারে খেলা হলে ওভার বদলে সময় কম যাবে, এক দিনে বেশি বল খেলা হবে। কিন্তু একেবারে পাকা কোনো নিয়ম হয়নি তখনো। এরপর ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত বেশ কয়েকবার ছয় ও আট বলের মাঝে নিয়ম পাল্টানো হয়েছে।

কিন্তু ১৯৩৭ সালের পর ‌১৯৭৯ সালের আগ পর্যন্ত প্রায় পাকাপাকিভাবেই আট ওভারের টেস্ট খেলেছে অস্ট্রেলিয়া। এই‌ সময়ে আর ছয় বলে না ফেরার কারণটা জেডি স্কট নামের এক ভদ্রলোক। উত্তর অস্ট্রেলিয়ার এই আম্পায়ার প্রথমবারের মতো আম্পায়ারিং করতে নামেন ১৯৩৭ এক অ্যাশেজ সিরিজের প্রথম টেস্টে। সে সময় তাঁর হাতে প্রতি ওভারের বল গণনার এক নতুন যন্ত্র দেখা যায়। ‘নভেল ওভার কাউন্টার’ নামের এই গণনযন্ত্রে একবারে আটটি বল গোনা যেত। সে সময় এই যন্ত্র এতটাই বিখ্যাত হয় যে এরপর অস্ট্রেলিয়ায় প্রায় প্রতি টেস্টেই বল গোনা হয়েছে এই কাউন্টার দিয়ে। ফলাফল, প্রতিটি টেস্টই খেলা হয়েছে আট বলের ওভারে। তবে এই পুরো সময়টাতেই অবশ্য ছয় বলের ওভারে টেস্ট খেলেছে ইংল্যান্ড।

ওয়ানডেতে যে রেকর্ড শহীদ আফ্রিদির। ৩৯৮ ওয়ানডেতে ৩৫১টি ছক্কা মেরেছেন তিনি। সব ফরম্যাট মিলিয়ে অবশ্য ছক্কার রাজ্যে একচ্ছত্র শাসন ক্রিস গেইলের।

ক্রিকেটে ছয়ের সুদিন আবার ফেরানোর কৃতিত্বটা কেরি প্যাকার নামের আরেকজন অস্ট্রেলিয়ান ভদ্রলোকের। অস্ট্রেলিয়ান চ্যানেল নাইন নেটওয়ার্কের মালিক ছিলেন তিনি। নিজ উদ্যোগে প্রদর্শনী সিরিজ আয়োজন করে প্রথমবারের মতো ক্রিকেটের বাণিজ্যায়ন শুরু করেন তিনি। এই উদ্যোগ কোনোভাবেই পছন্দ হয়নি আইসিসির। কেরির প্রদর্শনী সিরিজ যাতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের চেয়ে জনপ্রিয় না হয়ে যায়, সে জন্য এর পরপরই ক্রিকেটের নিয়মে বেশ কিছু বদল আনে আইসিসি। ওয়ানডে এবং বিশ্বকাপকে প্রাধান্য দেওয়া শুরু হয়, ডে-নাইট ম্যাচের প্রচলন, ফিল্ডিংয়ে ৩০ গজ বৃত্ত, সব খেলার বাধ্যতামূলক সম্প্রচারের মতো নানা উদ্ভাবনী উদ্যোগ নেয় তারা। সে সময়ই প্রথমবারের মতো ক্রিকেটের সব নিয়ম একত্র করে কোডবুক লেখা হয়, যেখানে আট বলের ওভার বেশি লম্বা এবং বোলারদের ক্লান্তির অন্যতম কারণ হওয়াতে প্রতি ওভারে ছয় বল করার সিদ্ধান্ত আসে। এরপর আর ক্রিকেটে নিজের স্থান পাকা করতে সমস্যা হয়নি ছয় নামক এই সংখ্যার।

বাউন্ডারিতে সর্বোচ্চ রান ছয় হওয়া নিয়েও ক্রিকেটের আদিকালে নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম ছিল না। অনেক জায়গায় সর্বোচ্চ বাউন্ডারি আট ও পাঁচ হিসেবেও ক্রিকেট খেলা হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক টেস্ট শুরু হওয়ার পর ছয় রানই সর্বোচ্চ বাউন্ডারির পরিমাপ থেকেছে সব সময়।

তবে এখন, বিশেষ করে টি-টোয়েন্টির যুগ শুরু হওয়ার পর থেকে ক্রিকেটের আষ্টেপৃষ্ঠে জুড়ে গেছে ছয় নামক এই সংখ্যাটি। ছক্কার বাহার দেখা যায় বলেই টি-টোয়েন্টির এত ভক্ত, ফ্র্যাঞ্জাইজি লিগের এত দাম। ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা মনে করে থাকেন, গত ২০ বছরে ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বদল এসেছে ছক্কার ব্যবহারে। পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝানো যাক। নব্বইয়ের দশকে ওয়ানডের শ্রেষ্ঠ ফিনিশার মনে করা হতো অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান মাইকেল বেভানকে। ১৯৯৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপ জেতার পেছনে অন্যতম অবদান ছিল তাঁর। হিসাব করলে দেখা যায়, ফিনিশার হয়েও বেভান নিজের ক্যারিয়ারের প্রতি ৪৪৩ বলে মাত্র একটি করে ছক্কা মেরেছেন। মতান্তরে যাঁকে এখন বিশ্বক্রিকেটের শ্রেষ্ঠ ফিনিশার হিসেবে দেখা হয়, সেই মহেন্দ্র সিং ধোনি তাঁর ক্যারিয়ারের প্রতি ৫৪টি বলে একটি করে ছক্কা মেরেছেন, যা বেভানের প্রায় নয় গুণ! এমনকি জো রুট, যাঁকে ইংল্যান্ডের ব্যাটিং লাইনআপের সবচেয়ে কম মারকুটে ব্যাটসম্যান বলা যেতে পারে, তিনিও বেভানের তুলনায় তিন গুণ বেশি ছক্কা মারেন প্রতি ম্যাচে। ২০ বছর আগেও ক্রিকেট সিঙ্গেল ও ডাবলের খেলা ছিল, এখন তা পুরোপুরি বদলে ছক্কার খেলা।

ছক্কা নিয়ে রেকর্ডগুলো দেখলেই বোঝা যায়, ছক্কায় এখন কতটা নির্ভরশীল ক্রিকেট। গত দুই দশকের সেরা ব্যাটসম্যানদের প্রায় প্রতিজনই ছক্কা বিষয়ে কোনো একটি রেকর্ডের অধিকারী। ব্যতিক্রম শুধু ওয়াসিম আকরাম। টেস্টে এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি ছক্কার রেকর্ডটি এখন পর্যন্ত তাঁর থেকে নতুন দিনের কোনো ব্যাটসম্যান ছিনিয়ে নিতে পারেননি। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১৯৯৬ সালে এক ইনিংসে ‌১২টি ছক্কা মেরে এই রেকর্ড নিজের করে নিয়েছিলেন তিনি।

ওয়ানডেতে এই রেকর্ডের নব্য অধিকারী ইয়ন মরগান। এই বিশ্বকাপেই আফগানিস্তানের বিপক্ষে এক ইনিংসে ১৭টি ছক্কা মেরেছিলেন তিনি। পুরো টেস্ট ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বেশি ছক্কার রেকর্ড ব্রেন্ডন ম্যাককালামের। ১০১ টেস্ট ম্যাচে ১০৭টি ছক্কা মেরেছেন তিনি। ওয়ানডেতে যে রেকর্ড শহীদ আফ্রিদির। ৩৯৮ ওয়ানডেতে ৩৫১টি ছক্কা মেরেছেন তিনি। সব ফরম্যাট মিলিয়ে অবশ্য ছক্কার রাজ্যে একচ্ছত্র শাসন ক্রিস গেইলের। নিজের ক্যারিয়ারের ৪৬২টি ম্যাচে ৫৩৪টি ছক্কা মেরেছেন তিনি। এখনো অবসর না নেওয়ায় এই সংখ্যা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে থামবে, তা বোঝা মুশকিল। 

টানা ছয় বলে ছয় ছক্কা মারার গল্পটি প্রথমবারের মতো লিখেছিলেন স্যার গ্যারি সোবার্স। ১‌৯৬৮ সালে এক প্রথম শ্রেণির ম্যাচে এক ওভারের প্রতিটি বলকেই মাঠের বাইরে পাঠিয়েছিলেন তিনি। ২০০৩ বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে ছয় বলে ছয় ছক্কা হাঁকিয়েছেন হার্শেল গিবস। ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ইংলিশ বোলার স্টুয়ার্ট ব্রডের এক ওভারে ছয় ছক্কা মেরেছেন যুবরাজ সিং। আর সর্বশেষ এই প্রদর্শনী দেখা গেছে আফগানিস্তান প্রিমিয়ার লিগের এক ম্যাচে, যেখানে আফগান ব্যাটসম্যান হজরতুল্লাহ জাজাইয়ের ব্যাটে। 

এই রেকর্ডের অধিকারী কিন্তু বাংলাদেশের একজন ক্রিকেটারও আছেন। ২০০৯ সালে নাইম ইসলাম ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের এক ম্যাচে টানা ছয় বলে ছয় ছক্কা মেরেছিলেন। তবে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ উন্নত প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের মধ্যে না আসায় যেই কীর্তি অনেক জায়গাতেই উল্লেখ করা হয় না।

বোলিং ওভারে সর্বোচ্চ চার বলে টানা চারটি উইকেট নেওয়ার রেকর্ড খুঁজে পাওয়া যায়। সেই মহান রেকর্ডের অধিকারীও গুনে গুনে শুধু ছয়জন বোলার। ক্রিকেটজুড়ে ছয়ের শাসনটা কি এখনো ভুতুড়ে মনে হচ্ছে না?