খেলায় সেরা পড়ায় সেরা

খেলা ও পড়াশোনা একসঙ্গে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়—পেশাদার যুগে অহরহ শোনা যায় কথাটি। তবে অনেকের মতো বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) ছাত্র আকবর আলী দেখিয়ে দিয়েছেন পড়া ও খেলা দুটোই একসঙ্গে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব এবং তা বেশ ভালোভাবেই। বর্তমানে অনূর্ধ্ব–১৯ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক আকবর ২০১৬ সালে এসএসসিতে মানবিক বিভাগ থেকে পেয়েছেন এ প্লাস। আকবরের গল্পটা হতে পারে কিশোর আলোর প্রতিভাবান কিশোরদের জন্য অনুপ্রেরণার।

খেলার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পড়াশোনা সম্ভব? 

প্রশ্নটি অনেক কিশোরের মনেই বাসা বেঁধে আছে। কেউ বড় খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্নপূরণের বাধার অজুহাতে পড়তে চায় না, আবার পরীক্ষায় ভালো রেজাল্টের প্রত্যাশায় খেলাধুলার ধারেকাছে হাঁটে না অনেকেই। বাসায় মা বলছেন বই নিয়ে বসতে। ছেলের জবাব, ‘আমি হব পেশাদার ক্রিকেটার। আমার দ্বারা পড়াশোনা সম্ভব নয়।’ ছেলের স্বপ্নের সামনে মা হয়ে পড়েন অসহায়। পেশাদার এই যুগে পড়া ও খেলার দ্বন্দ্ব দেখা যায় অহরহ। কিন্তু পরীক্ষায় ভালো রেজাল্টের সঙ্গে ভালো খেলোয়াড় হওয়ার কাজ দাপটের সঙ্গে করে দেখানো সম্ভব। হাতের কাছে জুতসই নামও আছে বেশ কয়েকটি। তবে সুদূর অতীতে বা বেশি দূর যাওয়ার প্রয়োজন নেই। বর্তমান বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব–১৯ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক আকবর আলীর দিকেই তাকাও। 

যুবদলের অধিনায়ক আকবরের ধ্যানজ্ঞান ক্রিকেট। বড় খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বহু বাছাই পেরিয়ে নাম লিখিয়েছেন বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি)। ঘুম ছাড়া বেশির ভাগ সময়ই আকবরের দুনিয়ায় ব্যাট আর বল। এতে পড়াশোনা তো গোল্লায় যায়-ইনি, বরং ভালো খেলার জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে একাডেমিক শিক্ষা। খেলার ফাঁকে ফাঁকে বই-খাতা নিয়ে বসেই এসএসসিতে মানবিক শাখা থেকে পেয়েছেন এ প্লাস। অর্থাৎ বোর্ড পরীক্ষায় এ প্লাস পাওয়া একজন ছাত্রই হয়েছেন যুবদলের অধিনায়ক। অন্যভাবে বললে যুবদলের অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পেয়েছেন বোর্ড পরীক্ষায় এ প্লাস পাওয়া ছাত্র। 

একজন ভালো ক্রিকেটার হওয়ার জন্য আকবরের কত পরিশ্রম। ভোরে ঘুম থেকে উঠেই ছুটতে হয় খেলার মাঠে। হাড়ভাঙা খাটুনি শেষে হোস্টেলে ফিরে সময়মতো খাবার খেয়েই ক্লাসে হাজিরা দেওয়া। কিন্তু সকালের অমন হাড়ভাঙা খাটুনির পর কি আর বীজগণিতের সূত্রের মারপ্যাঁচ, ইংরেজি গ্রামার ঢুকতে চায় মাথায়! ঘুমে চোখ ঢুলু ঢুলু হওয়ার জোগাড়। কিন্তু স্বপ্ন, ধনুর্ভঙ্গপণ ও পরিশ্রমের জোরে দুটি বিষয়েই সাফল্য অর্জন করেছেন রংপুরের এই ছেলে।

বড় ভাই মুরাদ হোসেনকে দেখে ক্রিকেটার হওয়ার ইচ্ছা জাগে আকবরের। অঞ্জন সরকারের হাত ধরে রংপুর জেলা স্কুলের মাঠে হয় একাডেমিক ব্যাটে–বলে হাতেখড়ি। তত দিনে তাঁর কানে পৌঁছে গেছে নিজ জেলা ও বিকেএসপির ছাত্র জাতীয় দলের দুই ক্রিকেটার সোহরাওয়ার্দী শুভ ও নাসির হোসেনের নাম। ব্যস, মনের মধ্যে বাসা বেঁধে যায় বড় ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন। জেলা পর্যায়ে বাছাই পরীক্ষায় নাম লিখিয়ে বিকেএসপিতে ভর্তি হন ২০১২ সালে। এরপর তরতর করে শুধুই এগিয়ে চলা। অনূর্ধ্ব–১৯ দলের আগে খেলেছেন অনূর্ধ্ব–১৭ দলেও। আছে বিকেএসপির বয়সভিত্তিক দলগুলোকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতাও।

বিকেএসপির খেলা সামলে অনূর্ধ্ব–১৭ জাতীয় দলে জায়গা ঠিক রাখা। সেখানে পা হড়কালেই হাতছাড়া হয়ে যাবে অনূর্ধ্ব–১৯ দলে খেলার টিকিট। এত চাপের মধ্যেও ভালো রেজাল্ট করে দেখিয়েছেন এইচএসসিতে।

কিন্তু আকবরকে দেখে একটা জায়গায় খটকা লাগতে বাধ্য। ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি উচ্চতার একটার ছেলে কিনা উইকেটরক্ষক। ভাবা যায়! তাঁর ব্যাটিং–সামর্থ্য নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু দীর্ঘদেহী এই ছেলেটাই যদি বল হাতে দৌড়ে এসে বল করতেন। দৃশ্যটা আরেকটু সুখকর হতো বটে। এমন উচ্চতা নিয়েও উইকেটরক্ষক কেন? প্রশ্নটির জবাব আকবরকে হরহামেশাই দিতে হয়, ‘আমার মেজ ভাইয়ের পরামর্শেই উইকেটরক্ষক হওয়া।’ 

আবার আসা যাক খেলার কাছে হার না–মানা পড়াশোনার গল্পে। ২০১৬ সালে এসএসসি পরীক্ষা চলাকালে প্রথম বিভাগের খেলা চলছে। দুটোই চালিয়েছেন একসঙ্গে। মোদ্দা কথা, ২২ গজ সামলে পরীক্ষার হলও সামলেছেন দক্ষতার হাতে। শেষ পর্যন্ত মার্কশিটে উঠেছে এ প্লাস। 

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খেলাধুলা আর পড়াশোনার অবস্থান বিপরীত মেরুতে। খেলা আর পড়া একসঙ্গে হয় না, এটা তো একপ্রকার অলিখিত প্রিয় বুলিই। কথাটা আকবরকেও কম শুনতে হয়নি। কিন্তু কীভাবে মেলালেন দুই মেরুকে? ‘আমি যখন পড়ি, শুধু পড়ার চিন্তাই করি। আবার যখন খেলি, শুধু খেলার চিন্তাই করি। যখন যেটা করি পুরোপুরি মনোযোগ দিয়ে করি। খেলার জন্য পড়ায় পিছিয়ে যাব বা পড়ার জন্য কম খেলব, এ রকম ভাবা চলবে না।’

ভবিষ্যতে এমন আরও অনেক পুরস্কার উঠবে হাতে—এমনটাই আশা আকবরের।

এসএসসির পর খেলার চাপ যায় আরও বেড়ে। বিকেএসপির খেলা সামলে অনূর্ধ্ব–১৭ জাতীয় দলে জায়গা ঠিক রাখা। সেখানে পা হড়কালেই হাতছাড়া হয়ে যাবে অনূর্ধ্ব–১৯ দলে খেলার টিকিট। এত চাপের মধ্যেও ভালো রেজাল্ট করে দেখিয়েছেন এইচএসসিতে। হ্যাঁ, এ প্লাস পাওয়া হয়নি, কিন্তু পরীক্ষার আগে এক মাস পড়েই মানবিক বিভাগ থেকে পেয়েছেন ৪.৪২। আকবরের এই পথচলায় সহযোগী হিসেবে ছিলেন তাঁর রুমমেট মাহমুদুল হাসান কিরণ। তিনি অনূর্ধ্ব–১৯ জাতীয় দলের ফুটবলার। এ প্লাস পাননি, তবে এই ফুটবলারের রেজাল্টও ঈর্ষণীয়। ক্লাস এইট থেকে এইচএসসি পর্যন্ত রুমমেট থাকা কিরণের মুখ থেকে শোনা গেল আকবরের যত গুণ, ‘ওর খেলার প্রতিই মনোযোগ বেশি। কিন্তু পড়াশোনায় পিছিয়ে থাকা যাবে না, এই ভাবনাটাও ওর মাথায় কাজ করে। এর বাইরে অন্য কোনো দিকে ওর মনোযোগ নেই। এই জন্যই ও দুটি বিষয়েই সফল।’

খেলা ও পড়াশোনার বাইরে ব্যক্তি হিসেবেও আকবর বেশ রুচিশীল। দেশের বাইরে এবি ডি ভিলিয়ার্স ও জস বাটলার তাঁর পছন্দ। আর দেশে সাকিব আল হাসান। বিকেএসপির বড় ভাই ও জাতীয় দলের তারকা ক্রিকেটার সাকিবকে পছন্দ করার কারণটাও বেশ প্রশংসনীয়। কারণ, আবেগ দিয়ে ক্রিকেট খেলেন না নাম্বার ওয়ান অলরাউন্ডার। তবে তাঁর মিলটা বেশি পাওয়া যায় মুশফিকুর রহিমের সঙ্গে। দুজনই বিকেএসপির ছাত্র, উইকেটরক্ষক, মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান ও দুজনেরই আছে অনূর্ধ্ব–১৯ দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতা। আরও একটা বড় মিল আছে। এসএসসিতে এ প্লাস পেয়েছেন দুজনই। সবকিছুই কাকতালীয়ভাবে মিলে যাচ্ছে। কে জানে আকবরই হয়তো ভবিষ্যৎ জাতীয় দলের উইকেটরক্ষক!