ঘূর্ণি রহস্যে এখনও ঘুরছে বাংলাদেশ

রশিদ খান

‘সময় বের করে নিতে পারলে বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যানকেও নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাতে পারত সে।’

ওই সময়ই বের করা হতো না জ্যাক ইভারসনের। রাখাল বনেছেন, আবাসন ব্যবসা করেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, বিয়ে করেছেন, সন্তানের বাবা হয়েছেন, তবু ক্রিকেটের জন্য সময় বের করা হচ্ছিল না। একদিন স্ত্রীর সঙ্গে হাঁটতে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডের পাশ দিয়ে। অন্ধ ক্রিকেটাররা এতটা ভালোবাসা নিয়ে ক্রিকেট খেলছিলেন সেখানে, দেখে তাঁরও লোভ হলো।

৩১ বছরের আগে ক্রিকেটকে পাত্তাই না দেওয়া লোকটি ৪ বছরের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট দলে। প্রথম সিরিজেই নিজের জাত চেনানো ইভারসনের ওটাই শেষ সিরিজ। চোট পেয়েছিলেন সেটা একটা কারণ, আরেকটি কারণ বাবার ব্যবসায় ঢুকে যাওয়ায় সময় বের করা হচ্ছিল না।

এতে ইভারসনের কিছু এসে যায়নি, ক্ষতিটা হয়েছে ক্রিকেটের। আরেক লেগ স্পিনার আর্থার মেইলি আগেই সতর্ক করেছিলেন, ইভারসনের মতো আর কেউ ক্রিকেটে আসবে না। সতর্কবার্তাটা ছিল মেইলির লেগ স্পিনের মতোই, ‘এটা খুবই বিপজ্জনক, যখন তুমি সব ভরসা এমন এক মেশিনের ওপর রাখছ, যার বিকল্প কোথাও নেই।’

আমিনুল ইসলাম বিপ্লব

বিকল্প কোথাও না পাওয়ার কারণ ছিল ইভারসনের বোলিং অ্যাকশন। বিশ্বের প্রায় সব লেগ স্পিনারের বল ধরার ঢং একই। কারও ক্ষেত্রে শুধু তর্জনী এবং কারও ক্ষেত্রে তর্জনী-মধ্যমা বলের সিমের ওপর রাখা, কবজির মোচড়ে বল ছেড়ে দেওয়া। ইভারসন এর ধারেকাছ দিয়েও যেতেন না। কীভাবে বল ধরেন, সেটা ইভারসনই বলেছিলেন, ‘মধ্যমা ও বুড়ো আঙুলের মধ্যে বল রাখো। এবার মধ্যমা হাতের তালুর সঙ্গে এমনভাবে মেশাও যেন বলের সিমের পেছনে মধ্যমার গাঁট থাকে। এই আঙুলই যখন হঠাৎ সোজা করবে, তখন সেটা স্প্রিংয়ের মতো কাজ করবে এবং বলটাকে যেদিকে ঘোরাতে চাও বুড়ো আঙুলের ওপর দিয়ে সেদিকে ছুড়ে মারবে। এখানে তর্জনীর কোনো কাজ নেই।’

এভাবে বল ছুড়েই লেগ স্পিন, টপ স্পিন ও গুগলি করতে পারতেন। শুধু যেদিকে ঘোরাতে চান, বুড়ো আঙুল সেদিকমুখো করে ছাড়লেই হতো। এমনটা আর কেউ কখনো করার সাহস পাননি।

এর মাঝেই আশ্চর্য ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম হ্যাটট্রিক এক লেগ স্পিনার অলক কাপালির। তবু ২০ বছর পেরিয়েও একজন লেগিকে দলে স্থায়ী হতে দেখা যায়নি।

লেগ স্পিন নিয়ে কথা বলতে গিয়ে লেগ স্পিন জগতের সবচেয়ে ব্যতিক্রম ব্যক্তি নিয়েই পড়ে থাকলে চলবে? বরং লেগ স্পিন কেন শিল্প, সে আলোচনায় যাওয়া যাক। এবারও আর্থার মেইলি ভরসা। যে যুগে সবাই নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ব্যস্ত ছিল, সে যুগেই বলটাকে যত পারা যায় ঘোরানোয় আগ্রহী ছিলেন মেইলি। এ কারণে তাঁর গর্বও ছিল। সর্বোচ্চ বিনয় দেখিয়ে গর্বের কথা জানিয়েও ছিলেন একবার। সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের কোনো দুর্বলতার কথা কেউ কখনো বলতে পারেননি। অনুজ ব্র্যাডম্যানের ভক্ত ছিলেন মেইলিও। তবু ব্র্যাডম্যানের ইস্পাতদৃঢ় টেকনিকে ছোট্ট একটা খুঁত পেয়েছিলেন এই লেগ স্পিনার। নিজের সেরা সময় পার করে আসার পরও একবার ব্র্যাডম্যানকে অতিরিক্ত বাঁক নেওয়া বলে বিভ্রান্ত করে আউট করেছিলেন। সে অভিজ্ঞতা থেকে বলেছিলেন, কেউ পরখ করে দেখার সুযোগ পায়নি, তবে ব্র্যাডম্যানের যদি কোনো দুর্বলতা থাকে, সেটা ওই বেশি বাঁক নেওয়া লেগ স্পিনেই।

আব্দুল কাদির

বাঁক নেওয়ানোর দক্ষতাতে মেইলির কাছাকাছি না হলেও ব্র্যাডম্যানকে ওই লেগ স্পিনেই একবার বোল্ড করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটের সে সময়কার সবচেয়ে বিখ্যাত লেগ স্পিনার ক্ল্যারি গ্রিমেট। আউট করেই ব্র্যাডম্যানকে বেশ অকথ্য ভাষায় ড্রেসিংরুমের পথ দেখিয়ে দিয়েছিলেন মেজাজি লেগ স্পিনার। কারণ, বেশ কিছুদিন ধরেই ব্র্যাডম্যান অনুযোগ করছিলেন, লেগ স্পিন ভুলে ফ্লিপার আর গুগলিতেই বেশি মেতেছেন গ্রিমেট। তাই ব্র্যাডম্যানকে লেগ স্পিনেই বোল্ড করে এর প্রতিশোধ নিয়েছেন গ্রিমেট। তবে প্রকাশ্যে নিজের আবেগ ওভাবে প্রকাশ করায় আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারেও পর্দা নেমেছিল এই স্পিনারের।

ব্র্যাডম্যানের ফ্লিপার বা গুগলি নিয়ে অমন আপত্তি অবশ্য বিস্ময়কর। হাজার হলেও লেগ স্পিন শিল্পটাকে আমূল বদলে দিয়েছে তো এই গুগলিই। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বার্নার্ড বসানকুট টেনিস বল দিয়ে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করতে গিয়ে এক সোনার খনি আবিষ্কার করে ফেলেন। লেগ ব্রেকের আশা করে খেলতে গিয়ে গুগলিতে পরাস্ত হয়ে ব্যাটসম্যানদের সেই যে মাথা চুলকানো শুরু হলো, সেটা থামেনি এই যুগে এসেও। বরং কালের বিবর্তনে গুগলির ব্যবহার আরও ভয়ংকর করে তুলেছে লেগ স্পিনারদের। আশির দশকে মৃতপ্রায় লেগ স্পিনকে বাঁচিয়ে তোলার কৃতিত্ব তো ওই গুগলিরই। আবদুল কাদির নামের এক জাদুকর এসেছিলেন, যাঁর হাতে ছিল দুই ধরনের গুগলি। এদিক থেকে শেন ওয়ার্নই ব্যতিক্রম। চোট থেকে বাঁচার জন্য ক্যারিয়ারের অর্ধেক সময় গুগলি ফেলা ছেড়ে দিয়েও দারুণ সফল। ওই যে মেইলি বলেছিলেন, দারুণ বাঁক নিতে জানলে ব্র্যাডম্যানেরও খুঁত বের করা যায়।

শেন ওয়ার্ন

শেন ওয়ার্ন বা ম্যাকগিল হতে না পারলে দরকার গুগলি ফেলার ক্ষমতা। সেই গুগলির এখন স্বর্ণযুগ চলছে। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের জোয়ারে লেগ স্পিনারদের রমরমা। সেটা অবশ্যই গুগলি করতে জানা স্পিনারদের। সে গুগলিও হতে হবে প্রচণ্ড গতির, যা দেখে রেগি শোয়ার্জ ও বিল ও’রিলিরা তৃপ্তি পাবেন। বিশ্বে এখন প্রায় সব দেশেই লেগ স্পিনারদের কদর বেড়েছে। প্রতিটি দলেই আছেন ভালো মানের লেগ স্পিনার। শুধু লেগ স্পিনের কদর বুঝতে পেরেছে বলেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এক দশক পেরোনোর আগেই সমীহ জাগানো এক দল হয়ে উঠেছে আফগানিস্তান।

এর মাঝেই আশ্চর্য ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম হ্যাটট্রিক এক লেগ স্পিনার অলক কাপালির। তবু ২০ বছর পেরিয়েও একজন লেগিকে দলে স্থায়ী হতে দেখা যায়নি। বিশ্বে যেখানে প্রায় সব দেশে দু–তিনজন শীর্ষ মানের লেগ স্পিনার দলে জায়গা পাওয়ার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে, সেখানে বাংলাদেশের ভাঁড়ার শূন্য। জুবায়ের হোসেন ধূমকেতু হয়ে হারিয়ে গেছেন, তানভীর হায়দারের পরীক্ষা–নিরীক্ষা বহু আগেই ব্যর্থ হয়েছে। আমিনুল ইসলাম ও রিশাদ হোসেনের দিকেই আপাতত চেয়ে আছে বাংলাদেশ।

স্টুয়ার্ট ম্যাকগিল

লেগ স্পিন একটি শিল্প আর সে শিল্পকে প্রাণ দিতে হলে সবাইকেই এগিয়ে আসতে হয়। একসময় অস্ট্রেলিয়া যখন একের পর এক লেগ স্পিনার উপহার দিচ্ছিল, গুগলির জন্মস্থান হয়েও ইংল্যান্ড শূন্য হাতে বসে ছিল। কারণ, নিজেদের মাঠে ‘স্টিকি’ উইকেট বানিয়ে সিমার, স্লো বোলার আর অফ স্পিন দিয়েই যে অস্ট্রেলিয়াকে ঘায়েল করার মন্ত্র পেয়েছিল ইংলিশরা। দীর্ঘ মেয়াদে তাতে দলটির লাভ হয়নি কোনো; বরং দারুণ এক শিল্পকে হাত ফসকে দিয়ে অন্যদের বিশ্ব ক্রিকেটে রাজত্ব করার সুযোগ দিয়েছে তারা। বাংলাদেশও এখন ঘরের মাঠে এমন উইকেট বানানোয় ব্যস্ত, যাতে বল ঘোরানোর দক্ষতার খুব একটা দরকার হয় না। বলের গতির পার্থক্য এনে শুধু লাইন–লেংথ ধরে রাখলেই চলে। তাতে দেশের মাটিতে উইকেটের বন্যা বইয়ে দিলেও আসল পরীক্ষায় বারবার ফেল করছেন মিরাজরা।

এমন পরিবেশ লেগ স্পিনারদের বেড়ে ওঠার আশা জাগায় না। লেগ স্পিন আর গুগলির মায়াজাল দেখার আশাও তাই দিন দিন সুদূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। ক্রিকেট বোর্ড যত দ্রুত তাদের ভুল বুঝতে পারে, ততই ভালো। না হলে কবজির মোচড়ে ব্যাটসম্যানদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানোর দৃশ্য কল্পনার বস্তু হয়েই উঠবে বাংলাদেশের জন্য।