সাংবাদিকের ফোন পেলে যা করেন সাকিব আল হাসান

: হ্যালো, সাকিব...?

: হুম্ তারেক ভাই...বলেন।

: কী অবস্থা...?

: এই তো...।

: ভালো আছেন?

: আছি আরকি...।

এরপর আর কারও প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে! ‘এই তো...আছি আরকি’—যেন পৃথিবীতে বলার মতো আর কিছু নেই! যেন আর কোনো অবস্থা থাকতে পারে না কারও! এক ‘এই তো’ দিয়ে সব অবস্থার বর্ণনা শেষ! ম্যাচ জিতলেও ‘এই তো’, ম্যাচ হারলেও ‘এই তো’, সাকিব সেঞ্চুরি করলেও ‘এই তো’, সাকিব বহিষ্কৃত হলেও ‘এই তো...!’ একটু ভালো সম্পর্ক হলে বড়জোর বলবেন, ‘আপনি তো সাংবাদিক...লিখে দেন একটা কিছু।’

সংবাদ সম্মেলনেও এই অবস্থার সৃষ্টি হয় মাঝেমধ্যে। হয়তো কোনো সাংবাদিক অনেক প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা সাকিব, বাংলাদেশ তো একের পর এক ম্যাচ হারছে। ব্যাটিং-বোলিং কিছুই ভালো হচ্ছে না। ফিল্ডিংও যাচ্ছেতাই। তো এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হলে আসলে কী করা উচিত?’ এক সেকেন্ডও না ভেবে মুখস্থ করা উত্তরের মতো সাকিব বলে দেবেন, ‘ভালো খেলতে হবে।’ যেন মহাগুরুত্বপূর্ণ এই তথ্য কেউ এর আগে জানতই না!

ব্রিবত সাংবাদিক তখন আরও কিছু শুনতে চাইবেন, ‘না মানে আরেকটু বিস্তারিত যদি বলতেন...।’ এবার সাকিব শব্দ খরচে একটু উদার, ‘ওই তো, ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং তিনটাতেই ভালো করতে হবে।’ সাকিবের এসব ‘শর্টকাট’ উত্তর যে ভুল তা নয়। কিন্তু পাঠককে তৃপ্ত করে লেখার জন্য তো আরও কিছু লাগে। সেই মসলাটুকু দিতেই তাঁর যত কৃপণতা।

সাকিবকে নিয়ে সবচেয়ে বড় সমস্যা টেলিফোনে। পেশার খাতিরে তাঁকে প্রায়ই ফোন করতে হয়। এবং এটা জেনেও যে অপর পাশে নির্লিপ্ত কণ্ঠ থাকবে। কোনো একটা কিছুর সোজা উত্তর জানতে কতভাবে যে ঘুরিয়ে করতে হয় প্রশ্ন নামের ‘বল’টা! কখনো শর্ট বল, কখনো একটু টার্ন, কখনো বা গুড লেংথে ফেলেই ছেড়ে দেওয়া। আর অপেক্ষায় থাকা, কখন সাকিব বলগুলো ডানে-বাঁয়ে ছেড়ে না দিয়ে সোজা ব্যাটে খেলতে শুরু করবেন।

এটুকু পড়ে কেউ ভেবো না সাকিবের বিরুদ্ধে অভিযোগনামা লিখতে বসেছি। হয়তো সাকিবের টেলিফোন কথোপকথনের সঙ্গী হিসেবে সাংবাদিকেরাই অচল। একবার তো শুনেছি সাকিব নাকি মুঠোফোনে দিন-রাত কথা বলতে পারেন। সে রকম বলে এক মডেল নিজেকে তাঁর ‘গার্লফ্রেন্ড’ই দাবি করে বসল। পরে অবশ্য সাকিব জানিয়েছিলেন, দাবিটা ঠিক নয়।

সাকিবের বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের ‘কমন’ অভিযোগ, তিনি ফোন ধরেন না। আর ধরলেও কথা বলেন এমনভাবে যে সেটা ‘হুঁ...হ্যাঁ’র মধ্যে সীমাবদ্ধ। ও দিয়ে সাকিবের সঙ্গে কথা হয়েছে দাবি করা গেলেও রিপোর্ট লেখা যায় না। অধিকাংশ সময় নিজে প্রশ্ন করে নিজেই একটা উত্তর বলে সাকিবের সম্মতি বা অসম্মতি আদায় করে ধরে নিতে হয়, সাকিব এটা বলেছেন বা ওটা বলতে চেয়েছেন। দেশের সবচেয়ে বড় ক্রিকেট তারকার মুখ থেকে বোমা মেরেও কথা বের করা কঠিন—সাংবাদিকদের জন্য এর চেয়ে বড় দুঃখ আর কী হতে পারে?

কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো, এই সাকিবই আবার মাঝেমধ্যে অনর্গল কথা বলেন। মনের জানালা খুলে দিয়ে একটার পর একটা কথার বোমা ফাটাতে থাকেন। এই ‘গুণ’টার জন্য দু-একবার ভীষণ ফেঁসেও গেছেন। জাতীয় দলের অধিনায়ক থাকার সময় একবার বলে দিলেন, দল গঠনে নাকি তাঁর মতামত নেওয়া হয় না। এ নিয়ে তখনকার প্রধান নির্বাচক আকরাম খানের সঙ্গে তুমুল গন্ডগোল। আরেকবার প্রথম আলোতে কলাম লিখে রাগিয়ে দিলেন দেশের সাবেক ক্রিকেটারদের। এই তো কিছুদিন আগে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ চলাকালীন প্রথম আলোতেই দেওয়া সাড়া জাগানো এক সাক্ষাৎকারে এমন সব কথা বললেন যে দেশে আগুনই লেগে যাওয়ার উপক্রম। সাকিব সেসব ঠিক বলেছেন, কী ভুল বলেছেন, তা নিয়ে নানা রকম মতামত আছে। নতুন করে সেই বিতর্কে না গিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে এটুকুই বলা যাক—টেলিফোনের অজানা প্রান্তের সাকিবের চেয়ে মুখোমুখি বসা সাকিব অনেক বেশি প্রাণবন্ত। সঠিক শব্দে পুরো বাক্য গঠন করে কথা বলতে তখন তাঁর কোনো সমস্যা হয় না।

কিন্তু সে সুযোগ কবারই বা আসে! বেশির ভাগ সময় তো মুঠোফোনই ভরসা এবং ভরসা সাকিবের ‘হুঁ...হ্যাঁ’তে। তাও যদি তিনি ফোনটা ধরেন আরকি।

পুনশ্চ: সাকিব ফোন ধরেন না, ফোনে কম কথা বলেন—এগুলো তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ নয়। একজন মানুষের চরিত্র এ রকম হতেই পারে। বাংলাদেশের সাকিবকে তো তবু প্রশ্ন করার জন্য সামনে পাওয়া যায়। অন্যান্য দেশের সাকিবদের অনেক সময় তাও পাওয়া যায় না।

(কিশোর আলোর আগস্ট ২০১৪ সংখ্যায় প্রকাশিত)