দাবার বোর্ডে মুখোমুখি বাবা-ছেলে

‘বড় হয়ে তুমি কি গ্র্যান্ডমাস্টার হতে চাও?’

প্রশ্নটা করতেই ছেলেটির চটপটে উত্তর, ‘আমি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হতে চাই।’ স্বপ্নের চেয়েও যেন দুই ধাপ এগিয়ে ভাবে ছেলেটি!

রোহান গাভাস্কার পারেননি বাবা সুনীল গাভাস্কারকে ছাড়িয়ে যেতে। শচীন টেন্ডুলকারের ছেলে অর্জুন টেন্ডুলকার পারবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে। ক্রিকেটে এমন গল্প আরও অনেকই পাওয়া যাবে। কিন্তু দাবায়? হ্যাঁ, বাংলাদেশেই দাবা পরম্পরার এমন গল্প তৈরি হচ্ছে। তাহসিন তাজওয়ার জিয়া যে বাংলাদেশের পাঁচ গ্র্যান্ডমাস্টারদের অন্যতম জিয়াউর রহমানের ছেলে।

তাহসিনের বয়স মাত্র ১১ বছর। পড়াশোনা করছে ধানমন্ডির সেন্ট জুডস ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের তৃতীয় শ্রেণিতে। দাবায় ওর বর্তমান রেটিং ১৮০৬। এখন থেকেই বাবাকে হারানোর স্বপ্ন দেখে তাহসিন। ঘরে বসে বাবার সঙ্গে অনুশীলনে প্রায়ই মুখোমুখি হয়। সেখানে বাবার সঙ্গে ড্র-ই করে বেশির ভাগ সময়। জিতেছেও দু-তিনবার। তবে গত ডিসেম্বরে প্রিমিয়ার দাবা লিগে মুখোমুখি দেখা গেল বাবা-ছেলেকে প্রথম। বাবা গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান খেলেছেন শেখ রাসেল মেমোরিয়াল স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে। ছেলে তাহসিন খেলেছে গোল্ডেন স্পোর্টিং ক্লাবে। সাড়ে তিন ঘণ্টায় ৬৮ চালে জিতেছেন বাবা। তবে ছেলের লড়াই দেখে দারুণ মুগ্ধ জিয়া, ‘আমার তো মনে হচ্ছিল হেরেও যেতে পারি। ও দারুণ খেলছিল।’ বাবার ময়নাতদন্তে ছেলের হারের কারণ, অনভিজ্ঞতা ও কিছু চালে সূক্ষ্ম ভুল।

তাহসিনের মা তাসনিম সুলতানাও গর্বিত ছেলের এমন পারফরম্যান্সে, ‘সত্যি কথা বলতে কী ও এত ভালো খেলেছে যে সবাই বলছিল যে ড্রও করে ফেলতে পারে। এমন ভালো কিন্তু সচরাচর ও খেলে না। জিয়া তো নিজেই অবাক! আমাকে বকা দিয়ে বলেছে, তোমার ছেলে এত ভালো খেলছে কেন? আমার তো মানসম্মান নিয়ে টানাটানি।’ মা বলেন আর হাসেন। যে হাসিতে ছড়িয়ে থাকে গর্ব।

পরিবারের থেকে তাহসিনের দাবায় হাতেখড়ি। ওর রক্তে দাবার নেশা। দাদা পয়গামউদ্দিন ছিলেন আশির দশকের দাবাড়ু। জাতীয় দলে খেলেছেন। খেলেছেন প্রথম বিভাগের দল পূরবী ক্রীড়াচক্রে। তাহসিনের বয়স যখন তিন, তখন তাকে হাতির দাঁতের দাবার বোর্ড উপহার দেন দাদা। সেই বোর্ড নিয়েই দাদা-নাতির দিন কাটত। তবে তাহসিনের আগ্রহটা বাড়িয়ে দিয়েছেন বাবা জিয়াউর রহমান। খেলার পাশাপাশি কোচিংও করান জিয়া। বাবা যখন ছাত্রদের শেখান, তখন মন দিয়ে চালগুলো দেখে ছেলে। তাহসিনকে রেটিং পেতে অনেক টুর্নামেন্ট খেলতে হয়েছে। বাবার সঙ্গে বিদেশ ভ্রমণের কারণেই এসব বড় টুর্নামেন্টে খেলার সুযোগ হয়েছে তার। অভিষেকও হয়েছে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট দিয়েই।

ম্যাগনাস কার্লসেন যে দাবার বর্তমান বিশ্বচ্যাম্পিয়ন, সেটাও জানা তাহসিনের। এতটুকু ছেলে স্বপ্ন দেখে কার্লসেনকেও একদিন ছাড়িয়ে যাওয়ার!

বাবার সঙ্গে খেলতে সব সময়ই ভালো লাগে তাহসিনের, ‘বাবার সঙ্গে খেলতে অনেক আনন্দ। বাবাকে হারিয়ে দিলে বেশি খুশি লাগে।’

এমনিতেই ফেডারেশনের পাইপলাইনে দাবাড়ু নেই বললেই চলে। দেশের সর্বকনিষ্ঠ ফিদে মাস্টার ফাহাদ রহমানের পর আর কোনো দাবাড়ু উঠেও আসছে না। তাহসিনের জন্য তাই সঠিক যত্নের প্রয়োজন বলে মনে করেন মা তাসনিম, ‘আমরা যদি ওকে সঠিক প্রশিক্ষণ ও পরিচর্যা করতে পারি, তাহলে অবশ্যই জিয়ার চেয়ে কম বয়সে গ্র্যান্ডমাস্টার হতে পারবে। আর জিয়ার চেয়ে দুই ধাপ ওপরে চলে যাবে ইনশা আল্লাহ।’

পারিবারিক ঐতিহ্যের পথ ধরে একদিন উঠে আসবে আরেকজন গ্র্যান্ডমাস্টার, হয়তোবা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন।

(কিশোর আলোর জানুয়ারি ২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত)