ধোনি যেখানে আলাদা

২০২০ সালের ১৫ আগস্টের সন্ধ্যাটা যে এভাবে ধোনি-ঢেউয়ে এলোমেলো হবে, ক্রিকেট-দুনিয়ার কেউ অনুমানই করতে পারেনি! কী সৃজনশীল ভাবনায় ছোট্ট একটা বার্তায় জানিয়ে দিলেন আর ভারতীয় দলের হয়ে খেলবেন না তিনি, বিদায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট। বিদায়টা জানালেনও এমন দিনে, যেটি ভারতের স্বাধীনতা দিবস। স্বাধীনতা দিবসে নীল জার্সির দায়িত্ব থেকে ‘স্বাধীন’ হয়ে গেলেন ধোনি। পেছনে রেখে গেলেন ১৫ বছরের এক রঙিন যাত্রা।

সে যাত্রায় ধোনি দেখিয়েছেন, তিনি প্রথাগত পথে হাঁটেন না; ব্যাকরণ মেনে চলেন না। তিনি চলেন নিজের তৈরি সূত্র মেনে। কখনো কখনো ব্যর্থ হলেও বড় মঞ্চে ঠিকই দেখিয়েছেন সেই সূত্রের কার্যকারিতা। এ পথে হেঁটেই ২০০৭-এ ভারতকে জিতিয়েছেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। টেস্ট র৵াঙ্কিংয়ে ভারতের প্রথমবারের মতো ১ নম্বরে ওঠা তাঁর অধীনেই (নভেম্বর ২০০৯ থেকে আগস্ট ২০১১)। তাঁর নেতৃত্বেই ২৮ বছর পর বিশ্বকাপ জিতেছে ভারত। টি-টোয়েন্টি ও ৫০ ওভার—দুটি বিশ্বকাপ জয়ের গৌরব একমাত্র ধোনিই গায়ে মেখেছেন। ক্রিকেট ইতিহাসের একমাত্র অধিনায়ক হিসেবে আইসিসির তিনটি টুর্নামেন্ট জেতার অনন্য রেকর্ড তাঁর অধিকারে। ভারতকে সবচেয়ে বেশি ২৭টি টেস্টও জিতিয়েছেন তিনি। মিডল আর লোয়ার মিডল অর্ডার সামলে অসংখ্য ম্যাচ জিতিয়ে দুর্দান্ত ‘ফিনিশা’র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এই ব্যাটিং অর্ডারে নেমে একজন উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান যিনি ওয়ানডেতে ৫০.৫৭ গড়ে ১০ হাজার রান করেছেন, সেটিও কি কম অবিশ্বাস্য! এত এত সাফল্যে নিজের নামের অর্থই যেন বদলে ফেলেছেন: এম এস ধোনি, মানে মহেন্দ্র ‘স্পেশাল’ ধোনি!

১৫ বছরের ক্যারিয়ারে বেশির ভাগ সময়ই দলকে নেতৃত্ব দিয়েই কাটিয়েছেন। বরফশীতল মাথায় চমকে দেওয়া সব সিদ্ধান্তে দলকে এনে দিয়েছেন একের পর এক সাফল্য। ‘ক্যাপ্টেন কুল’ তকমাটা তাঁর নামে পেটেন্ট করা হয়নি এমনি এমনি! আইপিএলের দল চেন্নাই সুপার কিংসের কোচ স্টিভেন ফ্লেমিং খেলোয়াড়ি জীবনে ঠান্ডা মেজাজের অধিনায়ক হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। সেই তিনি যখন চেন্নাইয়ে ধোনিকে খুব কাছ থেকে দেখলেন, তাঁর উপলব্ধি হলো, ধোনির ভেতরটা আশ্চর্য রকম ঠান্ডা। ভেতরটা এত ঠান্ডা বলেই উত্তেজক মুহূর্তগুলো খুব ভালোভাবে সামলাতে পারে সে।

সামলাতে পারেন বলেই প্রথাগত টিম মিটিং করেন না। আইপিএলের ফাইনালে মাঠে নামার আগে সতীর্থদের নিয়ে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে শুধু দুই মিনিটের একটা বক্তৃতায় নিজেদের করণীয় জানিয়ে দেন। আর সেটিই সতীর্থের কাছে হয়ে যায় সাফল্যের মন্ত্র! শুধু থেমে থেমে মিহি গলায় নিজেদের করণীয় বললেই হয় না। সেটি মাঠে করেও দেখাতে হয়। এখানেও ধোনি ক্যারিশমা দেখান। উইকেটের পেছন থেকে চোখের ইশারায় দেওয়া ইঙ্গিতগুলো যেন বোলার কিংবা ফিল্ডারদের কাছে বিজ্ঞ চিকিৎসকের কার্যকর দাওয়ার মতো। মনে আছে, বার্মিংহামে ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনালে মুশফিকুর রহিম-তামিম ইকবালের গড়া তৃতীয় উইকেটে ১২৩ রানের জুটিটা কীভাবে ভেঙেছিল। খণ্ডকালীন বোলার কেদার যাদবের বলে তামিম কীভাবে বোল্ড হয়েছিলেন, সেটিও নিশ্চয়ই মনে আছে। যাদবকে আক্রমণে আনা থেকে শুরু করে তাঁর বোলিং কৌশল পুরোটাই ছিল ধোনির মস্তিষ্কপ্রসূত। ওই জুটিটা ভাঙার পর বাংলাদেশ আর স্বচ্ছন্দে এগোতে পারেনি। ভালো সম্ভাবনা জাগিয়েও জেতার মতো স্কোর পায়নি। রবিচন্দ্রন অশ্বিন একবার বলেছিলেন, আইপিএলে ক্রিস গেইলকে তিনি কীভাবে ফিরিয়েছিলেন, ‘গেইল যথারীতি রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছে। মাহি ভাইয়ের কাছে গিয়ে বললাম, এ তো আজ আমার ক্যারিয়ার শেষ করে দেবে! মাহি ভাই বললেন, নিজের শক্তির ওপর ভরসা রাখ। বোলিং প্রান্ত থেকে যখন ছোটা শুরু করেছি, তখনই উইকেটের পেছন থেকে ইশারা দিলেন মাহি ভাই, কোনটা করব। সেটাই করলাম, আর তাতেই কাজ হলো। গেইল আউট!’

এই শটেই নিশ্চিত হয় নিজেদের মাটিতে ভারতের বিশ্বকাপজয়

উইকেটের পেছন থেকে পুরো মাঠ এভাবেই নিয়ন্ত্রণ করেছেন ধোনি। এমনকি বিরাট কোহলি তিন সংস্করণে ভারতের অধিনায়ক হওয়ার পরও। ডেথ ওভারে কোহলি চলে গেছেন ডিপ মিড উইকেট, লং অন বা লং অফের সীমানার কাছে। বোলার আর ফিল্ডারদের সব দিকনির্দেশনা তখন ধোনিই দিয়েছেন। কোহলিও নির্ভারচিত্তে ধোনিকে মাঠ সামলানোর কাজটা ছেড়ে দিয়েছেন। শুধু মাঠ সামলানো নয়, দলের অনেক কৌশলগত সিদ্ধান্তও ধোনির মাথা থেকে আসা। ক্যারিয়ারের প্রথম ছয় বছর লোয়ার মিডল অর্ডার কিংবা মিডল অর্ডারে খেলা রোহিত শর্মার দুর্দান্ত ওপেনার হওয়া হতো না, যদি না তিনি অধিনায়ক হিসেবে একজন ধোনিকে না পেতেন। ২০১১ বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ফাইনালে যুবরাজ সিংকে না পাঠিয়ে আকস্মিকভাবে নিজেই ৫ নম্বরে নেমে পড়াটা ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাসেরই অন্যতম চমক–জাগানিয়া কৌশলগত সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচিত। চকিতে চমকে দেওয়া ধোনির এমন সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে একাধিক বই লেখা যায়।

আবেগকে হৃদয়ের ছোট্ট কুঠুরিতে তালাবদ্ধ রেখে কীভাবে পেশাদার হতে হয়, সেটি ধোনির চেয়ে বেশি কজন করে দেখিয়েছেন? সংবাদমাধ্যম কিংবা দর্শকেরা যখন নানা ইস্যুতে তাঁকে সমালোচনার তিরে বিদ্ধ করেছে, নিশ্চুপ থেকেছেন, একটি উত্তরও দেননি। যেন এসব দেখতে, শুনতে তাঁর বইয়েই গেছে! দলের অভাবনীয় সাফল্যে ভীষণ আবেগতাড়িত হননি আবার ব্যর্থতায় দুমড়েমুচড়েও যাননি। ১৫ বছর সবাই তাঁর এই নিরাবেগ চেহারাটাই দেখে অভ্যস্ত। কিন্তু এই ধোনিই আবার জাতীয়তাবাদে ভীষণ উদ্বুদ্ধ। অনেকটা সেনাদের মতো। ওহ, তিনি তো সেনাই! সম্মানসূচক ভারতের সেনাবাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তাই হননি, হাতে-কলমে সেনাজীবনটাও দেখেছেন। প্রতিকূল পরিবেশে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এমনকি ‘পদ্মভূষণ’ পুরস্কার নিয়েছেন সামরিক বাহিনীর উর্দি পরে। ধোনির অনুশীলন সরঞ্জামাদির ব্যাগটা পর্যন্ত মিলিটারির জংলা রঙের।

ক্যাপ্টেন কুলই নন, ধোনির আরেক নাম ‘রহস্য’ও! নিজেকে সব সময়ই রহস্যের বলয়ে আবদ্ধ রাখতেই যেন পছন্দ করেন ভারতের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক। এ কারণেই হয়তো সংবাদমাধ্যম এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে তাঁর এত দূরত্ব। কোনো সাংবাদিক তাঁর ঘনিষ্ঠ হতে পারেননি। কখনো কাউকে কাউকে খুব কাছে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন কিন্তু একটা সীমারেখা ঠিকই টেনে রেখেছেন। যেটি অতিক্রম করতে পারেননি কোনো সাংবাদিক। এখনকার খেলোয়াড় কিংবা অ্যাথলেটরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কত সক্রিয়। ধোনি ঠিক উল্টো। হ্যাঁ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর কোটি কোটি অনুসারী আছেন, কিন্তু সেখানে কখনো তাঁর ব্যক্তিগত কিংবা পেশাগত জীবনটা পুরোপুরি উন্মোচন করেননি। সবাইকে চমকে দিয়ে বিদায়টা অবশ্য এই প্ল্যাটফর্মেই জানিয়েছেন। সেটিও হয়তো নিজের ‘রহস্যময়’ চরিত্রের কারণে।

মাঠে যেমন চকিতে চমকে দেওয়া সব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, নিজের ক্যারিয়ার নিয়েও সিদ্ধান্তগুলো কম চমকপ্রদ নয়। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সিরিজের মাঝপথে হঠাৎ অধিনায়কের অবসর ঘোষণা দিলেন; কোনো বিদায়ী টেস্ট, বিদায়ী ভাষণ কিংবা বিদায়ী সংবাদ সম্মেলনেরও সুযোগ দেননি—ভারতের টেস্ট ইতিহাসে আর কোনো অধিনায়কের এভাবে বিদায় বলার ঘটনা নেই। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ভারতীয় দলের অধিনায়কত্ব ছাড়ার ঘোষণাটাও যথেষ্ট চমকপ্রদ। তাঁর নেতৃত্বেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিন ওয়ানডে ও তিন টি-টোয়েন্টি ম্যাচের সিরিজ খেলার কথা ছিল ভারতের। সেই সিরিজ শুরুর দিন দশেক আগে ধোনি ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডকে (বিসিসিআই) জানিয়ে দিলেন, সীমিত ওভারের ক্রিকেটেও আর অধিনায়কত্ব করবেন না!

গত বিশ্বকাপের পর থেকে নিজেকে একেবারেই আড়াল করে রেখেছিলেন ধোনি। তাঁর অবসর নিয়ে কত কথাই হলো এ সময়ে। শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপের ওই ম্যাচটিই ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ হয়ে থাকল। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শুরু করেছিলেন রানআউটে, শেষটাও হলো রানআউট দিয়ে। শুরু আর শেষটার এই মিল যেমন তাঁর ক্যারিয়ারের মতোই চমকে ভরা!

১৫ বছরের ক্যারিয়ারটা যেখানে শেষ করেছেন, তৃপ্তির একটা হাসি খেলে যেতেই পারে ঝাড়খন্ড থেকে উঠে আসা ‘মাহি’র মুখে। পশ্চিমবঙ্গের খড়গপুর রেলস্টেশনের একজন টিটিইর জীবন যে এমন বর্ণাঢ্য হতে পারে, এত সাফল্যের মণিমুক্তাখচিত হবে, সেটি ধোনি নিজেও ভেবেছিলেন আজ থেকে ২০ বছর আগে? প্রয়াত সুশান্ত সিং অভিনীত বলিউডের এম এস ধোনি: দ্য আনটোল্ড স্টোরির সৌজন্যে ধোনির জীবনের গল্পটা অবশ্য অজানা নয়।

ধোনির সিনেমার নামে বলা হয়েছিল আনটোল্ড স্টোরি বা অজানা গল্প। সব সময়ই রহস্যে নিজেকে ঢেকে রাখতে অভ্যস্ত ধোনি মুচকি হাসতে পারেন, কটা গল্পই আমার জেনেছেন? যদি কেউ অনুরোধ করতে যান, আরও গল্প শোনান না, প্লিজ। ধোনি মুখ ঘুরিয়ে বলতে পারেন, ‘নাহ, থাক!’ এমন রহস্যে ঘেরা আকর্ষণীয় চরিত্র ক্রিকেট ইতিহাসে কটা এসেছে?

(কিশোর আলোর সেপ্টেম্বর ২০২০ সংখ্যায় প্রকাশিত)