নারী বিশ্বকাপের ইতিহাস

প্রথম ক্রিকেট বিশ্বকাপ কবে অনুষ্ঠিত হয়েছিল? ক্রিকেট কিংবা সাধারণ জ্ঞানে একটু দক্ষতা থাকলে হয়তো অকপটেই বলে উঠবে—১৯৭৫ সাল। লর্ডসের মাটিতে প্রথমবারের মতো সে শিরোপা উঁচিয়ে ধরেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কিন্তু আমি যদি বলি আমার করা প্রশ্নের উত্তরটি তোমরা সবাই ভুল দিয়েছ, তবে? তবে রেগে ফুঁসে ওঠাটা দোষের কিছু হবে না। তবে আমার প্রশ্নের সঠিক উত্তর কিন্তু ১৯৭৫ নয়, ১৯৭৩। প্রথম পুরুষ বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭৫ সালে। কিন্তু ক্রিকেট ইতিহাসে বিশ্বকাপের সূচনা হয়েছিল নারী ক্রিকেট দিয়েই, তারও ২ বছর আগে।

আন্তর্জাতিক নারী ক্রিকেটের সূচনা হয়েছিল ১৯৩৪ সালে। সেবারই প্রথম ইংল্যান্ড পুরুষ দলের পাশাপাশি নারী দল ভ্রমণ করেছিল অস্ট্রেলিয়া। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের টেস্ট ম্যাচ দিয়ে শুরু হয় নারী ক্রিকেটের আনুষ্ঠানিক যাত্রা। ১৯৭১ সালে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক ওয়ানডে ম্যাচ। আর তখনই বিশ্বকাপের পরিকল্পনা মাথায় আসে ব্রিটিশ ব্যবসায়ী জ্যাক হেওয়ার্ডের মাথায়। মূলত ১৯৬৬ ফুটবল বিশ্বকাপ জেতার পরই ক্রিকেট বিশ্বকাপের পরিকল্পনা আসে তাঁর মাথায়। টেস্ট খেলতে দুই বছর পরপর ইংল্যান্ডে আসে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। ওয়ানডে ক্রিকেটের প্রচলন যেহেতু শুরুই হয়ে গেছে তাই সবাইকে ডেকে একটা বিশ্বকাপ আয়োজন করলে কেমন হয়? ফুটবলে চার বছর পর পর তো হচ্ছেই, ক্রিকেটেও হোক।

পরিকল্পনা তো হলো, এবার লক্ষ্য দল জোগাড় করা। এমনিতেই ক্রিকেট খেলে কয়েকটি মাত্র দেশ, আর নারী ক্রিকেট তো আরও কম। বিশ্বকাপে যোগ দিতে তাই প্রথম আমন্ত্রণ জানানো হলো টেস্ট খেলুড়ে দলগুলোকে। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড একবাক্যে রাজি। অন্যদিকে দক্ষিণ আফ্রিকা তখন বর্ণবাদের দায়ে নিষিদ্ধ ক্রিকেট থেকে। তাই তাদের আসার সুযোগ নেই। তিন দল নিয়ে তো আর বিশ্বকাপ হয় না, তাই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে আসার প্রস্তাব দেন হেওয়ার্ড। আসরে দলের সংখ্যা কম বলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দুই আলাদা দ্বীপরাষ্ট্র ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো ও জ্যামাইকা আলাদা দল হিসেবে অংশ নেয়। ইংল্যান্ডের অনূর্ধ্ব-২৫ দল বিশ্বকাপে যোগ দেয় ‘ইয়াং ইংল্যান্ড’ নামে। আর শেষ দল হিসেবে যোগ দেয় ‘ইন্টারন্যাশনাল ইলেভেন’ অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে বাদ পরা খেলোয়াড়দের নিয়ে তৈরি করা হয় এই দল। প্রথমে দক্ষিণ আফ্রিকার পাঁচজন খেলোয়াড়কেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল ‘ইন্টারন্যাশনাল ইলেভেন’ দলে। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার খেলোয়াড় বিশ্বকাপে অংশ নিলে ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো ও জ্যামাইকা বিশ্বকাপ বর্জন করবে—এই মর্মে তাদের বাদ দেওয়া হয়।

বিশ্বকাপের ফরম্যাটটা খুবই সাধারণ। ৬০ ওভারের প্রতিটি ম্যাচ, খেলা হবে লিগ পদ্ধতিতে। প্রতিটি দল প্রতিটি দলের বিপক্ষে খেলবে, সর্বোচ্চ পয়েন্টধারী দল জিতবে শিরোপা। প্রতি ম্যাচ জিতলে জয়ী দল পাবে ৪ পয়েন্ট। ম্যাচ টাই কিংবা পরিত্যক্ত হলে ১।

স্যার জ্যাক হেওয়ার্ডের সম্পূর্ণ অর্থায়নে মাঠে গড়াল প্রথম ক্রিকেট বিশ্বকাপ। ৬ ম্যাচে ৫ জয় আর ১ হারে ২০ পয়েন্ট নিয়ে প্রথম বিশ্বকাপ জিতে নিল ইংল্যান্ড। আর ৪ জয় ও ১টি পরিত্যক্ত ম্যাচ মিলিয়ে ১৭ পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় হলো অস্ট্রেলিয়া।

প্রথম বিশ্বকাপের সাফল্য চমকে দেয় পুরো ক্রিকেট–বিশ্বকে। নারী বিশ্বকাপের দেখাদেখি পুরুষ বিশ্বকাপের পরিকল্পনাও বাস্তবায়ন হয়। ১৯৭৫ সালে ইংল্যান্ডেই অনুষ্ঠিত হয় প্রথম পুরুষ ক্রিকেট বিশ্বকাপ। সেই থেকে শুরু হয় ক্রিকেটের বিশ্বায়ন। ফুটবলের মতো প্রায় চার বছর পরপর নিয়মিতই অনুষ্ঠিত হয় নারী বিশ্বকাপ। ১৯৭৮ সালে মাঠে নামে দ্বিতীয় নারী ক্রিকেট বিশ্বকাপ। এবার অবশ্য ভারতের মাটিতে, চার দল নিয়ে। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ও ভারত। নেদারল্যান্ডস, ওয়েস্ট ইন্ডিজকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও শেষ সময়ে অর্থনৈতিক কারণে শেষ সময়ে নাম প্রতাহার করে নেয় তারা। চার দল নিয়ে রাউন্ড রবিন পদ্ধতিতে মাঠে নামে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ। এবার অবশ্য জিতলে দলের সঙ্গে যুক্ত হয় ২ পয়েন্ট। অপরাজিত থেকে বিশ্বকাপ জিতে নেয় অস্ট্রেলিয়া।

তবে তৃতীয় বিশ্বকাপ থেকে আস্তে আস্তে পরিবর্তন ঘটতে থাকে নারী বিশ্বকাপের। পুরুষ বিশ্বকাপের মতো প্রথমে রাউন্ড রবিন ও ফাইনাল সিস্টেম চালু করে তারা। নিউজিল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে পঞ্চম দল হিসেবে যোগ দেয় ‘ইন্টারন্যাশনাল ইলেভেন’। বিশ্বকাপের আগের দুই এডিশনে প্রতিটি দল একে অপরের মুখোমুখি হয়েছিল একবার। কিন্তু তৃতীয় আসরে সংখ্যাটাকে তুলে আনা হয় তিনে। পয়েন্টও করা হয় ৪। শীর্ষ দুই দল—অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ড মুখোমুখি হয় ফাইনালে। ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জিতে নেয় অস্ট্রেলিয়া।

তৃতীয় বিশ্বকাপের পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিটি বিশ্বকাপের ফরম্যাট ছিল একই রকম। যদিও নিয়মিতই দলের সংখ্যা কমবেশি হয়েছে। শুধু ২০১৩ বিশ্বকাপে আট দলকে ভাগ করা হয়েছিল দুই গ্রুপে। সেখান থেকে শীর্ষ ৬ নিয়ে হয়েছিল ফাইনাল সিক্স। কিন্তু ২০১৭ থেকে আবারও আগের নিয়মে ফিরেছে নারী ক্রিকেট বিশ্বকাপ। এবারও প্রথমে রাউন্ড রবিন ও সেখান থেকে শীর্ষ দুই দল নিয়ে অনুষ্ঠিত হবে বিশ্বকাপ ফাইনাল।

যদিও করোনার কারণে এবার বিশেষ কিছু নিয়ম সংযোজন করেছে উইমেন্স ক্রিকেট কাউন্সিল। যদি করোনার কারণে কোনো দলে খেলোয়াড়সংকট হয়, তবে ৯ জন নিয়েও মাঠে নামতে পারবে দলগুলো। চাইলে নিজেদের কোচিং স্টাফ থেকে কাউকে মাঠে নামাতে পারে। এ ছাড়া করোনার জন্য স্বাভাবিক হয়ে আসা নিয়মগুলো তো আছেই।

এ বছর নিউজিল্যান্ডে বসতে চলেছে নারী বিশ্বকাপের দ্বাদশ আসর। গত ১১ আসরের মধ্যে ৬ বার বিশ্বকাপ জিতেছে অস্ট্রেলিয়া। ৪ বার ইংল্যান্ড আর ১ বার নিউজিল্যান্ড। এবারই প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়েছে বাংলাদেশ। ওডিআই র‍্যাঙ্কিং অনুযায়ী বাংলাদেশ সরাসরি সুযোগ পেয়েছে বিশ্বকাপে। নিগার সুলতানা জ্যোতির অধীনে নিউজিল্যান্ডে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলছে বাংলার টাইগাররা। দক্ষিণ আফ্রিকা ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দুটো ম্যাচও খেলে ফেলেছে বাংলাদেশ। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ভালো লড়াই করেও ৩২ রানে হেরেছিল নিগার সুলতানা দল। দ্বিতীয় ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে হেরেছে ৯ উইকেটে। আরও ৫টি ম্যাচ রয়েছে বাংলাদেশের। পরের ম্যাচগুলোয় আরও ভালো খেলবে—এটাই সমর্থকদের প্রত্যাশা।