বাংলার ‘হকআই’ রোমান সানা

হঠাৎ করেই তির-ধনুকের কথা বললে কার কথা মনে পড়বে? সুপার হিরো জগতের সঙ্গে ওঠাবসা থাকলে প্রথমেই একজনের কথা মনে আসতে বাধ্য। সামনে রোবট আর্মি হোক, কিংবা ভিনগ্রহী দস্যু—সেগুলো নস্যি নিত্যনতুন ডিভাইসের তির-ধনুকের কাছে। অন্যদের যেখানে সুপার সুট, সিরাম, গডলি পাওয়ার, স্পাই টেকনিক আছে, সেখানে তাঁর সম্বল মাত্র তির-ধনুকখানি। অথচ তাঁকে ছাড়া দলটাই যেন দিশেহারা। নামটা ক্লিন্ট বার্টন, কিংবা ছোট করে বললে, ‘হকআই’।

সুপার হিরো আমাদেরও একজন আছেন, বাংলার ‘হকআই’। কমিক বুক কিংবা সিনেমার পাতার কোনো সুপার হিরো নন, একদম জলজ্যান্ত মানুষ, কাজ তিরটা শুধু টার্গেটে লাগানো। তিনি রোমান সানা। ৭০ মিটার দূরে থাকা বুলস আই হিট করাটাই যেন তাঁর নিত্যনিয়মিত কাজ। ওই বুলস আই করেই বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন সানা। আর্চারিতে এশিয়া জয় করেছেন সানা।

আর্চারি খেলাটা বাংলাদেশে তেমন পরিচিত না হলেও বিশ্বে এর জনপ্রিয়তা অনেকদিন থেকেই। ১৯০০ সালে দ্বিতীয় অলিম্পিক থেকে আর্চারি অলিম্পিকের অংশ। যদিও ১৯১২ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত বাদ দেওয়া হয়েছিল আর্চারিকে। কিন্তু এখন সদর্পে মাতিয়ে বেড়াচ্ছে অলিম্পিক।

সানার অবশ্য বিশ্বমঞ্চে কাঁপানো এই প্রথম না। ২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশের হয়ে খেলা শুরু করার পর থেকে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপের স্বর্ণপদক তাঁর থেকে ছিনিয়ে নিতে পারেননি কেউই। টানা সাত বছর ধরে এই পদক গলায় ঝুলিয়ে যাচ্ছেন সানা। অলিম্পিকে সুযোগ পাওয়ার পরপরই হুন্দাই বিশ্ব আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে জেতেন ব্রোঞ্জ। লন্ডন আর বেইজিং অলিম্পিকে খেলা অভিজ্ঞ ইতালির মাওরো নেসপলিকে হারিয়ে বিশ্ব আসরে জেতেন বাংলাদেশের প্রথম পদক। ব্যাংককে এশিয়া কাপ স্টেজ ওয়ানে স্বর্ণ জেতেন ২০১৪ সালে। ২০১৭ সালে কিরগিজস্তানে আন্তর্জাতিক আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপেও জেতেন স্বর্ণপদক। তবে সবচেয়ে বড় চমকটা দেখিয়েছেন সানা এই বছরের জুলাইয়ে। বিশ্ব আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে সবাইকে ঘোল খাইয়ে ব্রোঞ্জপদক নিয়ে এসেছিলেন সানা। ব্রোঞ্জ আনাটা যত বড় আনন্দ ও গর্বের বিষয় ছিল, তার থেকে বড় গর্বের বিষয় ছিল আরেকটা। ওয়ার্ল্ড আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপের সেমিফাইনাল খেলা চারজন সরাসরি সুযোগ পান অলিম্পিকে। যে রেকর্ড বাংলাদেশের ইতিহাসে কেউ করতে পারেননি, সেটাই করেছেন সানা। অলিম্পিকের মতো আসরে সরাসরি উড়বে বাংলাদেশের পতাকা। এর আগেও গলফার সিদ্দিকুর রহমান খেলেছেন অলিম্পিক, কিন্তু তা র৵াঙ্কিংয়ে সেরা ৬০–এ থাকার ‘কোটা’য়। সরাসরি নয়।

রোমান নামটা শুনলেই মনে পড়ে সেই বিখ্যাত রোমান সভ্যতার নাম। পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পুরোটা বীরদর্পে শাসন করে বেড়িয়েছেন এ সময়।

তবে এবার সব ছাড়িয়ে গেলেন সানা। গত জুলাইতে যে সেমিতে আটকে পড়েছিলেন, এবার আর অন্য কিছু আটকাতে পারল না তাঁকে। তড়তড় করে উঠে গেলেন এশিয়া কাপ র৵াঙ্কিং টুর্নামেন্টের ফাইনালে। সেখানে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন চীনের শি ঝেনকি। হাতের তির–ধনুক তো আছে সেই তিরকে ভেদ করতেই, তা–ই না? সেটাই করলেন। প্রথম সেটে ড্র আর পরের সেটে হারের পর ঘুরে দাঁড়ালেন। টানা তিন সেট জিতে ফাইনাল আর স্বর্ণ দুই–ই বগলদাবা করলেন রোমান সানা।

২০০৮ সালে আর্চারি ফেডারেশনের প্রতিভা অন্বেষণ ক্যাম্প ছিল খুলনা শহরে। সেখানেই খেলা দেখতে এসেছিলেন নবম শ্রেণির ছাত্র রোমান। আর্চারিতে আগ্রহ দেখে কলেজের সহসভাপতি হাসান স্যার তাঁকে বুঝিয়ে দেন আর্চারির নিয়মকানুন। সেখান থেকেই ট্রায়াল আর নিজের জায়গা করে নেওয়া। সানাকে মনে ধরে কোচ সাজ্জাদ হোসেনের। সেখান থেকে তাঁকে অনেকটা জোর করেই ঢাকায় নিয়ে আসেন কোচ। মা-বাবা রাজি ছিলেন না। রোমানেরও যে খুব একটা ইচ্ছা ছিল, তা–ও না। ফুটবলটাই তাঁর কাছে বেশি প্রিয় ছিল। ছোটখাটো চাকরি করা বাবা আবদুল গফুর সানা আর গৃহিণী মা বিউটি বেগমের নিজেদের সবচেয়ে ছোট সন্তানকে এত সহজেই ছাড়তে চাননি। কিন্তু কোচ সাজ্জাদ আহমেদ একপ্রকার জোর করেই খুলনা থেকে বিকেএসপিতে নিয়ে আসেন সানাকে। ভাগ্যে যা থাকে আরকি, ফুটবল ছেড়ে আর্চারিতেই উঠেপড়ে লাগলেন সানা। ক্যাম্প শুরুর দিনে ফেডারেশন সাধারণ সম্পাদক কাজী রাজীব উদ্দিন ঘোষণা দিলেন, সবচেয়ে বেশি স্কোর করা আর্চারের জন্য আছে পুরস্কার। সেটা কার পকেটে গিয়েছিল তা তো বুঝতেই পারছ।

জাতীয় পতাকাকে স্যালুট যে কোনো খেলোয়াড়ের জন্য বড় অর্জন
ছবি: সংগৃহীত

কিন্তু সুপারহিরোদের গল্প হবে আর কোনো পতন থাকবে না, তা হয় নাকি? সুপার হিরোর গল্প মানেই তো শেষ থেকে শুরু। মাত্র দুই বছর ফেডারেশনের অধীনে থাকার পরেই এল সেই জঘন্য সময়। ফেডারেশনের রাডার থেকে ছিটকে পড়লেন সানা। ফেরত গেলেন নিজের ছোট্ট গ্রামে। সে সময় মনেই হয়েছিল আর কখনো তির-ধনুক হাতেই নেওয়া হবে না তাঁর। এর মধ্যে পেলেন আরেকটা দুঃসংবাদ। ২০১২ সালে এক মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ভেঙে ফেললেন নিজের পায়ের দুই হাড়। হাসপাতালের বেডেই ছিলেন তিন মাস আর তারপর হাঁটাচলা করতে করতে পাঁচ মাস।

গাড়ি দূর্ঘটনায় সব হারিয়ে মেলায় খেলা দেখিয়ে বেড়াতেন ছোট্ট ক্লিন্ট। কিন্তু ছোট হলে কী হবে, পয়সা রোজগারের জন্য হলেও তো সেরাদের সেরা হতে হবে, নাকি? তা আর হচ্ছে কোথায়? ফলাফল ছুড়ে ফেলে দেওয়া। মেলার মধ্যেই মারামারিতে ইনজুরি আর কখনো ভালো হবেন না ভেবে মেলা থেকে ছুড়ে ফেলা। কিন্তু তত দিনেই ‘সোর্ডসম্যান’-এর নজরে পড়ে গিয়েছিলেন। সেই রাস্তায় জখম হয়ে যাওয়া বার্টনের মধ্য থেকেই এক নতুন মানুষ তুলে আনলেন সোর্ডসম্যান। রোমান সানার জীবনে সোর্ডসম্যান হয়ে এসেছিলেন কোচ জিয়াউর রহমান। ২০০৮ সালে ট্রায়ালে অনেকের মধ্যে একজন কোচ ছিলেন তিনিও। তাঁকে সুযোগ দিলেন আনসারের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার। দিলেন একটা চাকরি। ব্যস, ওটুকুই দরকার ছিল টার্গেটের সামনে দাঁড় করানোটা। সেই থেকে শুরু, বাংলাদেশ গেমসের স্বর্ণ তো কেউ তাঁর কাছ থেকে কেড়েই নিতে পারেননি। ভেঙেছেন বাংলাদেশে আর্চারির সব রেকর্ড। সবকিছু ছাড়িয়ে সানার নামটা যে এখন বিশ্বজুড়ে।

রোমান নামটা শুনলেই মনে পড়ে সেই বিখ্যাত রোমান সভ্যতার নাম। পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পুরোটা বীরদর্পে শাসন করে বেড়িয়েছেন এক সময়। তির-ধনুক নিয়ে এই রোমানের রাজত্ব দেখার অপেক্ষায় আমরা সবাই।

(কিশোর আলোর অক্টোবর ২০১৯ সংখ্যায় প্রকাশিত)