বিশের বাঁশি, না বিষের বাঁশি?

শুরুটা করেছিলেন সৈয়দ রাসেল। শেষটা এসেছিল অলক কাপালির হাত ধরে।

জোহানেসবার্গের সেই ম্যাচে প্রথমে রাসেলের হাতে ক্রিস গেইলের মতো ব্যাটসম্যানের খাবি খাওয়া যে পরম আনন্দের অনুভূতি দিয়েছিল, আশরাফুল-আফতাবদের ঝোড়ো ব্যাটিংয়ের পর তা পূর্ণতা পায় রবি রামপালের ফুল লেংথের বলটা অলক যখন ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে ঠেলে দিলেন, তখন। গেইল, ব্রাভো, স্যামুয়েলস, সারওয়ানদের দলটা তখন যথেষ্ট সমীহ করার মতো। সে দলকেই বাংলাদেশ এভাবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে হেসেখেলে হারিয়ে দিল, একি চাট্টিখানি কথা!

ক্রিকেটের নবতর সংস্করণে বাংলাদেশ টেস্ট-ওয়ানডের চেয়েও বেশি সফল হবে—এ আশাবাদ তখন সবার মুখে মুখে। আশার বেলুন চুপসে যেতে সময় নেয়নি। বলা হয়, ক্রিকেটের তিন সংস্করণের মধ্যে টি-টোয়েন্টিই সবচেয়ে বেশি অনিশ্চয়তায় ভরা। ১৯ ওভার পর্যন্ত ম্যাচের নাটাই নিজের হাতে থাকলেও শেষ ওভারে যে তা ফসকে যাবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু অনিশ্চয়তার এই টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের ব্যর্থতার হাহাকারই যেন নিশ্চিত বিষয়। না হলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ১৪ বছর আগে পাওয়া ওই জয়ই এই সংস্করণের বিশ্বকাপে সবচেয়ে জ্বলজ্বলে স্মৃতি হয়ে থাকবে কেন এখনো? বিশ্বকাপ জিতে গেইল-ব্রাভোদের ক্যালিপসো-নৃত্য এরপর বিশ্ব দেখেছে দুবার। সাকিব-মুশফিকদের ফিরতে হয়েছে খালি হাতে—বারবার। শুধু বিশ্বকাপ কেন, টি-টোয়েন্টি সংস্করণটাই যেন বাংলাদেশের কাছে দুর্বোধ্য এক ধাঁধার নাম। অমীমাংসিত এক রহস্যের নাম। কখনো কখনো যার সমাধান হলেও বেশির ভাগ সময়েই পুরোনো চক্রের আবর্তে ঘুরপাক খেতে হয়। সাফল্যের বাঁশি বেজেছে কমই, ২০ ওভারের বিষে বরাবরই ম্লান হয়েছে বাংলাদেশ।

শরিফুল ও তাসকিন

তবু বিশ্বকাপ আসে। আশায় বুক বাঁধেন সবাই। এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। টুর্নামেন্টের আগে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডকে সিরিজ হারিয়ে বাংলাদেশ এবার আশার বেলুনে জ্বালানি ভরে রাখার কাজটা ভালোভাবেই সেরে রেখেছে। হ্যাঁ, হতে পারে অস্ট্রেলিয়া দলে ছিলেন না শীর্ষ সারির কিছু ক্রিকেটার, নিউজিল্যান্ডও এসেছিল আক্ষরিক অর্থেই দ্বিতীয় দল নিয়ে। তাতে কী? জয় তো জয়ই! জয়ের অভ্যাস নিয়ে বাংলাদেশ এবার বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছে, যাচ্ছে টগবগে আত্মবিশ্বাস নিয়ে, সেটাই–বা কম কিসে? ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টগুলোতে অন্যান্য দলের খেলোয়াড়দের তুলনায় বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের তেমন অংশগ্রহণ নেই, কিন্তু বিশ্বকাপের আগে জাতীয় দলের হয়ে এসব জয় অবশ্যই নিজেদের শক্তি-দুর্বলতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেবে সাকিব-মুশফিকদের। কয়েক বছর আগেও টি-টোয়েন্টি রর‌্যাঙ্কিংয়ে ১০-১১ অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ এবার যাচ্ছে র‌্যাঙ্কিংয়ের ৬ নম্বর দল হিসেবে। এটাও আশা জাগায়।

এর মধ্যেও যে একটু বেদনার বিউগল বাজছে না, তা নয়। টপ অর্ডারে তামিম ইকবালের মতো অভিজ্ঞ একজনের অনুপস্থিতি অবধারিতভাবে বাংলাদেশের পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনছে। শুরুতে দ্রুত রান তোলার দায়িত্বটা তাই ভাগাভাগি করে নিতে হবে লিটন দাস, সৌম্য সরকার, মোহাম্মদ নাঈমদের। তবে আশার বিষয়, ওপেনারদের এমন এক সংকটকালেই বিশ্বমঞ্চে নিজের আগমনী বার্তা দিয়েছিলেন তামিম। ২০০৭ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে ভারতের বিরুদ্ধে তামিমের ওই দুর্দান্ত ইনিংস কে ভুলতে পারে? সেই তামিমের অনুপস্থিতিতে ওপেনারদের সংকটকালে এবার অন্য কেউ কি নিজের জাত চেনাবেন? হোক বিশ্বকাপটা ওয়ানডের না, তা–ও আশা করতে তো দোষ নেই!

সাকিব ও নাসুম
মাহমুদউল্লাহ

এবার বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় ‘প্লাস পয়েন্ট’ হতে পারে মিডল অর্ডারে অভিজ্ঞ কয়েকজনের উপস্থিতি। তামিম না থাকলেও আছেন সাকিব আল হাসান, অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ ও মুশফিকুর রহিম—পাঁচ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রতিটিতে খেলার অভিজ্ঞতা আছে যাঁদের। টি-টোয়েন্টির সেরা ১০ বোলারের একজন মোস্তাফিজুর রহমান। চলতে থাকা আইপিএলে রাজস্থান রয়্যালসের বড় ভরসার জায়গা তিনি, বলও করছেন দুর্দান্ত। তাসকিনের গতির সঙ্গে মোস্তাফিজের চাতুরী মিলিয়ে নিজেদের দিনে বাংলাদেশের পেস বিভাগ যথেষ্ট চমক জাগাতে পারে। সাকিব তো আছেনই, সঙ্গে স্পিনিং অলরাউন্ডার হিসেবে আফিফ হোসেন, মেহেদী হাসান, মাহমুদউল্লাহ, শামীম হোসেন; পেস বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে সাইফউদ্দিনের উপস্থিতি—সব মিলিয়ে দলটা বেশ ভারসাম্যপূর্ণ। একাদশে ব্যাটিং শক্তি বাড়ানোর জন্য কম বোলার নিয়ে খেলতে হবে বা বোলিংয়ের ধার বাড়ানোর জন্য একজন ব্যাটসম্যানকে বেঞ্চে বসাতে হবে, তেমন সম্ভাবনা কম।

ওমানে বাংলাদেশের খেলার অভিজ্ঞতা না থাকলেও আরব আমিরাতে আছে। মোস্তাফিজ-সাকিব এখন আইপিএল খেলছেন সেখানেই। আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটের প্রথম শ্রেণিতে বা ঢাকা প্রিমিয়ার যেমন কন্ডিশনে খেলা হয়, তার চেয়ে বিশ্বকাপের কন্ডিশনের পার্থক্য যে খুব বেশি, সেটা বলা যাবে না। ম্যাচের পরিস্থিতি বুঝে খেললে নিয়মিত জয়ের বন্দরে পৌঁছানো অসম্ভব নয়। প্রথম রাউন্ডে দলগুলো খর্ব শক্তির হলেও অপরিচিত। পচা শামুকে যেন পা না কাটে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। ইতিহাস বলে, শুরু ভালো করলে বাংলাদেশ গোটা টুর্নামেন্ট ভালো করে।

আফিফ হোসেন

তবে এবার শুধু শুরু নয়, সব ম্যাচেই ভালো করার চেষ্টা করতে চাইবে বাংলাদেশ। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ব্যর্থতার খেরোখাতা পুড়িয়ে ফেলার যে এখনই সময়!