বিশ্বকাপ রূপকথার নায়কেরা

সময়ের সেরা খেলোয়াড়দের সঙ্গে সঙ্গে আলো কাড়ছে তরুণ তুর্কিরাও। তবে আমরা আলোটাকে ফিরিয়ে নিতে চাই পুরোনো সময়ে। আইসিসি বিশ্বকাপের বর্তমান ট্রফি চালু হওয়ার পর যাঁরা নিজেদের মতো করে বিশ্বকাপের ক্যানভাসে এঁকেছেন, এবারের অবতারণা তাঁদের নিয়েই।

শচীন টেন্ডুলকার

তাঁকে ভারতীয়রা ডাকে ‘ক্রিকেট দেবতা’ আর ক্রিকেট–ভক্তরা মানে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্রিকেটার হিসেবে। বিশ্বকাপের মঞ্চে তাঁর পারফরম্যান্স সে প্রমাণ দেবে। ৬টি সেঞ্চুরিতে ২২৭৮ রান বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি রান। হয়েছিলেন ২০০৩ বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়। সেবার ৬৭৩ রান করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকও ছিলেন। ৬টি হাফ সেঞ্চুরি আর ১টি সেঞ্চুরি করা শচীনকে সেবার অদম্যই দেখাচ্ছিল। তাঁর কাঁধে চড়ে ফাইনালে পৌঁছে যায় ভারত। কিন্তু দুর্দান্ত অস্ট্রেলিয়ার কাছে ফাইনালে হেরে বিশ্বকাপ ছোঁয়া থেকে এক পা দূরে থেমে যেতে হয় তাঁকে। বিশ্বকাপ না পাওয়ার সে আক্ষেপ পূরণ হয় ২০১১–তে। ঘরের মাঠে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে ট্রফি জিতে নেয় ভারত। আর শচীনের ক্যারিয়ার পায় পূর্ণতা।

রিকি পন্টিং

সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার নিয়ে তর্ক-বিতর্ক থাকতেই পারে। তবে সবচেয়ে সফল অধিনায়কের নাম জিজ্ঞেস করলে দ্বিধা ছাড়াই বলতে হবে তাঁর নাম। তখনকার ক্রিকেট বিশ্বে অস্ট্রেলিয়াকে প্রতাপশালী করার পেছনে বড় ভূমিকা পন্টিংয়ের। তাঁর নেতৃত্বে ২০০৩ এবং ২০০৭–এ দুবার ট্রফি জেতে অস্ট্রেলিয়া। ১৯৯৯–এও ছিলেন দলের কার্যকরী সদস্য। বিশ্বকাপের সবচেয়ে বেশি রান সংগ্রাহকের তালিকায় তাই শচীনের পরই তাঁর নাম।

মার্টিন ক্রো

নিউজিল্যান্ড প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলল ২০১৫–তে। অথচ ১৯৯২–এ তারাই ছিল শিরোপার যোগ্য দাবিদার। কিন্তু সেবার কিউইদের রথ থেমে যায় সেমিফাইনালে, পাকিস্তানের কাছে ৪ উইকেটে হেরে। মার্টিন ক্রো ছিলেন সেই নিউজিল্যান্ডের ক্যাপ্টেন ফ্যান্টাসটিক। সেমিতে বাদ পড়েও বিশ্বকাপে ম্যান অফ দ্যা টুর্নামেন্ট তিনিই। ৪৫৬ রান করে ওই আসরের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন মিডল অর্ডার এই ব্যাটসম্যান। চারটি হাফ সেঞ্চুরির সঙ্গে ছিল একটি সেঞ্চুরিও। দলকে কীভাবে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হয়, তার যোগ্য উদাহরণ ছিলেন ক্রো। মাত্র ৫৩ বছর বয়সে ২০১৬ সালে পরলোকগমন করেন এই কিংবদন্তি স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান।

ল্যান্স ক্লুজনার

১৯৯৯ বিশ্বকাপ, সেবারও আয়োজক ইংল্যান্ড। মিডল অর্ডারে নামা এক প্রোটিয়া ব্যাটসম্যান লাইমলাইটে এসেছেন মারকুটে ব্যাটিং আর দলের প্রয়োজনে কার্যকরী মিডিয়াম পেসে ব্রেকথ্রু আনার মাধ্যমে। দলের অন্তিম মুহূর্তে এসে একাই জিতিয়ে নেন দলকে। যে কারণে সেবারের টুর্নামেন্টে আট ম্যাচে চারবারই ম্যাচসেরার তকমা তাঁর দখলে। ২৫০ রান এবং ১৭ উইকেট নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়েছিলেন সেমিফাইনালে। সেমিফাইনাল ম্যাচেও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার একই দশা। ২১৪–এর লক্ষ্যে ব্যাট করতে নামা প্রোটিয়ারা ১৭৫ রানে হারায় ৬ উইকেট। তখন ক্রিজে নামা ক্লুজনার আবারও একাই দলকে টানছেন। ৪৯ ওভার শেষে আফ্রিকার স্কোর ২০৫/৯, শেষ ওভারে চাই ৯ রান, হাতে একটা উইকেট। স্ট্রাইকে থাকা ক্লুজনার প্রথম দুই বলে দুটো চার মেরে জয় প্রায় নিশ্চিতই করে ফেললেন। ওভারের বাকি চার বলে চাই একটি রান। পরের বলে রান হলো না। চতুর্থ বল কোনোমতে ব্যাটে লাগিয়েই ক্লুজনার দিলেন দৌড়। তিনি পৌঁছে গেলেন ননস্ট্রাইকে, কিন্তু তাঁর সঙ্গী খেয়াল করেনি এই দৌড়, কয়েক মুহূর্ত পর যখন দৌড়ালেন, ততক্ষণে উইকেট ভেঙে জয়ের উল্লাস শুরু করেছেন ওয়াহ-পন্টিংরা। স্কোর সমান হলেও টুর্নামেন্টের নিয়ম অনুযায়ী গ্রুপ পর্বে দুই দলের খেলায় জয়ী অস্ট্রেলিয়া খেলবে ফাইনাল। ট্রফি থেকে এক পা দূরে থাকতেই ফিরতে হলো ক্লুজনারকে। কিন্তু সেবারের একক বীরত্বে ক্লুজনারকে এখনো ভোলেনি তাঁর ভক্তরা।

ক্লাইভ লয়েড-ভিভ রিচার্ডস

রিকি পন্টিংয়ের আগেই ক্যাপ্টেন হিসেবে দুবার বিশ্বকাপ জয়ের কৃতিত্ব এই ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানের। ১৯৭৫ এবং ৭৯–এর বিশ্বকাপে তাঁর হাতেই ওঠে ট্রফি। তখন অবশ্য খেলা হতো ৬০ ওভারে। ১২০ ওভার দৈর্ঘ্যের ক্রিকেটে ব্রিটিশদের তাদের মাটিতেই নাকানিচুবানি খাইয়েছিলেন লয়েড-গ্রিনিজ-রিচার্ডস-গার্নার-হোল্ডিংরা। তখনকার উইন্ডিজ ছিল ভয়ানক। একটুও ছাড় দিত না কাউকে। ৭৯–এর বিশ্বকাপে তো বড় অবদান ছিল স্যার ভিভ রিচার্ডসের। অলরাউন্ডার হিসেবে গ্রেটদের তালিকায় সবার ওপরেই রাখা হয় তাঁকে। ১৩৮ রানের ইনিংস খেলেছিলেন বোথাম-বয়কটদের দুর্দান্ত ইংল্যান্ডের সঙ্গে। স্যার ভিভের ব্যাপারে আরও একটি মজার তথ্য হলো, ইতিহাসের একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে ক্রিকেট এবং ফুটবল বিশ্বকাপে খেলেছেন। ১৯৭৪ সালে এন্টিগার হয়ে ফিফা বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে অংশ নিয়েছিলেন। আর ফুটবলে বাছাইপর্বকেও বিশ্বকাপের অংশ ধরা হয়।

সনাথ জয়সুরিয়া

মারকুটে ব্যাটসম্যানদের কথা যখন হচ্ছে, তখন জয়সুরিয়ার নাম আনতেই হয়। ক্রিকেটে ‘পিঞ্চ হিটিং’ টার্মটা তাঁর খেলার ধরন থেকেই উৎপত্তি। ওপেনিং করতে নেমে বোলারদের বেধড়ক পিটিয়ে নাভিশ্বাস তুলে দিতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। ১৯৯৬ বিশ্বকাপ জেতা লঙ্কান দলে তাঁর অবদান অনেক। শুধু ব্যাট হাতেই নয়, ব্রেকথ্রু এনে দিতেন বোলিং করেও। বাঁহাতি স্পিনে বিশ্বকাপের মঞ্চে নিয়েছেন ২৭ উইকেট, সঙ্গে ১১৬৫ রানও আছে। তাই তো শ্রীলঙ্কার তো বটেই, ক্রিকেটেরই অন্যতম কিংবদন্তি তিনি।

মুত্তিয়া মুরালিধরন

ওয়ার্ন নাকি মুরালি, কার বোলিংয়ে বেশি বিষ? সেটার পরিষ্কার জবাব দেওয়া মুশকিল। তবে বিশ্বকাপকে টানলে এখানে এগিয়ে যাবেন মুরালিধরন। জাদুকরি অফ স্পিন আর বিষাক্ত দুসরা দিয়ে যে কত ব্যাটসম্যানকে নাকানি-চুবানি খাইয়েছেন! ৬৮ উইকেট নিয়ে তাই তো বিশ্বকাপের সবচেয়ে বেশি উইকেটধারীর তালিকায় দ্বিতীয় তিনি। খেলেছেন ২০০৭ এবং ২০১১ বিশ্বকাপের ফাইনাল। কিন্তু সাঙ্গাকারার মতো তাঁর ভাগ্যেও জোটেনি শিরোপার ছোঁয়া।

কুমার সাঙ্গাকারা

বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি রান সংগ্রাহকের তালিকায় তিনি তৃতীয়। বাঁহাতি উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যানের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের রান ১৪ হাজারের বেশি। এই তালিকায় শচীন টেন্ডুলকারের পরেই তাঁর অবস্থান। টানা দুবার বিশ্বকাপ ফাইনালে খেললেও শিরোপার স্বাদ মেলেনি এই লঙ্কানের ভাগ্যে। তবু ক্রিকেট–ভক্তরা তাঁকে মনে রাখবে দৃষ্টিনন্দন ব্যাটিং আর দুর্দান্ত উইকেট কিপিংয়ের জন্য।

চামিন্দা ভাস

পর্যাপ্ত গতি, দুই দিকে সুইং করানোর ক্ষমতা এবং দারুণ লাইন-লেন্থ, চামিন্দা ভাসের শক্তিমত্তা ছিল এখানেই। নতুন বলে তাঁর মতো ধারালো বোলার কমই ছিল। ব্যাটসম্যানদের আউট করতে পারতেন যেকোনো উইকেটেই। ২০০৩ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেছিলেন। সেবার ২৩ উইকেট নিয়ে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহকও ছিলেন এই বাঁহাতি।

গিলক্রিস্ট-হেইডেন

ওপেনিংয়ে তাঁদের মতো মারকুটে জুটি এখনো পায়নি ক্রিকেট–বিশ্ব। বোলারদের কে বেশি পেটাতেন, গিলক্রিস্ট না হেইডেন—এটা নিয়ে তর্ক করে সারা রাত পার করে দেওয়া যাবে। ক্রিকেটে সাধারণত এক প্রান্তের ব্যাটসম্যান যখন মেরে খেলেন, অপর প্রান্তের জন একটু রক্ষণাত্মকই খেলেন। তাঁদের সেই গতে বাঁধার উপায় নেই। চার-ছয় মেরে বোলারদের লাইন-লেন্থ এলোমেলো করে দিতে কেউ কারও চেয়ে কম ছিলেন না। ব্যক্তিগত অর্জনেও তাই দুজনেই এগিয়ে। ২০০৩ ও ২০০৭ বিশ্বকাপজয়ী অজি দলের অন্যতম চালিকাশক্তি ছিলেন এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যানদ্বয়।

গ্লেন ম্যাকগ্রা

শুরুটা সবচেয়ে বেশি রানের মালিককে দিয়ে করলে শেষটা হোক বিশ্বকাপ ইতিহাসের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারিকে দিয়ে। ছিপছিপে দেহ নিয়ে ছোট ছোট পা ফেলে দৌড়ে এসে যে বল করতেন, তাতে খুব বেশি গতি থাকত না। কিন্তু নিঁখুত লাইন ও লেন্থ, উচ্চতার কারণে পাওয়া অতিরিক্ত বাউন্স আর সুইংয়ের কারণে প্রায়ই বিপর্যয়ে পড়তেন বিপক্ষের ব্যাটসম্যানরা। অপরাজেয় অস্ট্রেলিয়ানদের বোলিং লাইনআপের সেরা তূণটি ছিলেন ম্যাকগ্রা। নতুন-পুরোনো যেকোনো বল হাতে, শুকনা-ভেজা যেকোনো উইকেটেই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। ৭১ উইকেট নিয়ে তাই বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহক হওয়াটাও তাঁকেই মানায়।