বেবি এবি ডি

হাই ব্যাক লিফট, একটু ঝুঁকে ব্যাটিং স্টান্স; সবুজ জার্সির পেছনে জার্সি নম্বর ১৭! প্রথম দেখায় যে কেউ এবি ডি ভিলিয়ার্স বলে ভুল করতেই পারে। করাটা অমূলক নয়। স্টাম্প ছেড়ে তাঁর বেরিয়ে আসা কিংবা উইকেটের চারপাশে শটের দক্ষতা দেখে তাঁকে ‘মিস্টার ৩৬০ ডিগ্রি’ ভাবতে ভুল হবে না কারও। কিন্তু ১৮ বছর বয়সী এই ছেলেটা এবি ডি ভিলিয়ার্স নন। বরং তাঁরই শিষ্য ডেভিল্ড ব্রেভিস।

সম্প্রতি আইপিএলের নিলামের সুবাদে ডেভিল্ড ব্রেভিস নামটা এখন অনেকের কাছেই পরিচিত। অবাক হওয়ার মতোই ব্যাপার। আইপিএলের দলগুলো আজকাল নিজ দেশের খেলোয়াড় ছাড়া বিদেশি খেলোয়াড়দের খুব একটা পাত্তা দেয় না। আমাদের সাকিব আল হাসানকে কেনেনি কেউই, মুস্তাফিজুর রহমানকেও মাত্র দুই কোটি রুপিতে কিনেছে দিল্লি। সেখানে অচেনা–অজানা এক ডেভিল্ড ব্রেভিসকে তিন কোটি রুপি দিয়ে দলে ভিড়িয়েছে মুম্বাই ইন্ডিয়ানস। কিন্তু কেন এই অখ্যাত ব্রেভিসের দিকে নজর পুরো বিশ্বের?

এবারের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের দর্শকদের কাছে অবশ্য ব্রেভিস নামটা বিস্ময়কর ঠেকবে না। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের লক্ষ্যই থাকে ভবিষ্যতের তারকা খুঁজে বের করা। আর এবারের আসরে নজরকাড়া তারকা এই ডেভিল্ড ব্রেভিস। দল দক্ষিণ আফ্রিকা বেশি দূর যেতে না পারলেও ব্যাট হাতে ভেঙে দিয়েছেন ১৮ বছরের পুরোনো এক রেকর্ড। এক যুব বিশ্বকাপে শিখর ধাওয়ানের সর্বোচ্চ ৫০৫ রানের রেকর্ডকে সরিয়ে নিজের নাম লিখেছেন রেকর্ড বইয়ে। দুই শতকের সঙ্গে তিন অর্ধশতকে করেছেন ৫০৬ রান। আর বল হাতে নিয়েছেন ৭ উইকেট। অবধারিতভাবে বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ও হয়েছেন তিনিই।

আর এই প্রোটিয়া তারকার এমন উত্থানের পেছনের মানুষটা কে জানো? এবি ডি ভিলিয়ার্স। এবি ডি যে স্কুল থেকে পাস করেছেন, সেখান থেকেই বেরিয়েছেন ডেভিল্ড ব্রেভিস। শুধু তাঁরাই নন, একই স্কুল থেকে বেরিয়েছেন ফাফ ডু প্লেসি, জ্যাক রুডলফ, নিউজিল্যান্ডের নিল ওয়াগনারের মতো ক্রিকেটাররা। সেই অ্যাফিস স্কুলের পুনর্মিলনীতে প্রথম পরিচয় হয় ব্রেভিস আর ডি ভিলিয়ার্সের। সেখানেই ভিলিয়ার্সের কাছ থেকে ব্যাটিং টিপস নেওয়া শুরু করেন ব্রেভিস। তাঁর টেকনিক আর খেলার ধরনে যেন নিজেকেই খুঁজে পাচ্ছিলেন ভিলিয়ার্স। তাই আর না করেননি, আস্তে আস্তে সিনিয়র-জুনিয়রের সম্পর্কটা গড়ায় গুরু-শিষ্যে।

ফোন নম্বর বিনিময় থেকে শুরু করে হাতে–কলমে ব্যাটিং দেখিয়ে দেওয়া, কোনো কিছুতেই কার্পণ্য ছিল না ভিলিয়ার্সের। স্কুলজীবনে ভিলিয়ার্স ছিলেন ‘জ্যাক অব অল ট্রেডস’। ক্রিকেট, টেনিস, ব্যাডমিন্টন থেকে এমন কোনো খেলা নেই, যাতে পারদর্শী ছিলেন না তিনি। নিজেরই জুনিয়র খেলোয়াড়ের এমন আগ্রহ দেখে নিজে আর বসে থাকতে পারেননি। যতটা পেরেছেন সহায়তা করেছেন। তাঁকে আইডল মেনে আসা ব্রেভিস তাই অনুমতি নিয়েই নিজের জার্সি নম্বর হিসেবে বেছে নিয়েছেন ‘১৭’।

ব্রেভিস প্রথম সবার নজর কাড়েন দক্ষিণ আফ্রিকার দল ইস্টার্নসের বিপক্ষে ২৫ বলে ৪৬ রানের ঝোড়ো ইনিংস দিয়ে। নির্বাচকসহ পুরো দক্ষিণ আফ্রিকার নজরে আসেন এই ব্যাটসম্যান। এর পর থেকে শুধু ছাড়িয়ে গেছেন নিজেকে। আর অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ ছিল তাঁর লাইমলাইটে আসার সুযোগ। সেটা ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছেন ১৮ বছর বয়সী ক্রিকেটার।

এক শ্রীলঙ্কা বাদে বিশ্বকাপের প্রতিটি ম্যাচেই পঞ্চাশোর্ধ্ব রান ছিল তাঁর। ইংল্যান্ড আর আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে আউট হয়েছেন ৯৬ ও ৯৭ রান করে। তবে সবচেয়ে নজরকাড়া ছিল তাঁর ব্যাটিং স্টাইল। যুব দলগুলোতে যেখানে খেলোয়াড়দের লক্ষ্য থাকে উইকেটে টিকে থেকে রান করা, সেখানে ব্রেভিসের স্ট্রাইক রেট ছিল প্রায় ২০০। নিজেকে প্রমাণ করতে ধীরস্থির ব্যাটিং নয়, বরং বেছে নিয়েছিলেন আগ্রাসী মনোভাব। ফলও মিলেছে হাতেনাতে। পুরো দল যেখানে রান করতে ব্যর্থ, সেখানে রানের বন্যা বইয়েছেন ব্রেভিস।

আর ব্যাটিং স্টাইল নিয়ে না বললেই নয়, উইকেটের চারপাশে মিনি এবি ডি হয়ে উঠেছিলেন তিনি। হেঁটে হেঁটে স্টাম্প ছেড়ে বেরিয়ে আসা, হাঁটু গেড়ে স্লগ সুইপ, কাভার ড্রাইভ—প্রতিটা শটেই যেন গুরুর ছোঁয়া। সবকিছু দেখেই মনে হয়েছে, এবি ডি ভিলিয়ার্স ফিরে এসেছেন অবসর ভেঙে। টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ ছয়, সর্বোচ্চ চার, সর্বোচ্চ শতক—সবই এসেছে ব্রেভিসের ব্যাট থেকে।

ভালো খেলার সুবাদে ডাক এসেছে দক্ষিণ আফ্রিকার পেশাদার ক্রিকেট লিগ থেকে। সেখানে নেমেই রানের ফুলঝুরি ছোটানো শুরু করেছেন। আর আইপিএলে তো তাঁকে নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে গিয়েছিল মুম্বাই, চেন্নাই আর পাঞ্জাবের মধ্যে। যদিও তাঁর পছন্দ ছিল গুরু এবি ডি ভিলিয়ার্সের বেঙ্গালুরু, কিন্তু শেষমেশ ভিড়েছেন মুম্বাই ইন্ডিয়ানসেই। এখন সময় সামনের সময়টা নিজের করে নেওয়ার।

ডি ভিলিয়ার্সের ভাষায় ক্রিকেট খেলাটা যতটা না স্কিলের, তার চেয়ে বেশি মস্তিষ্কের। এ কারণে গায়ে যতই জোর থাকুক, মাথা না খাটালে এগোনো সম্ভব নয়। কম বয়সেই আলোচনায় আসা ব্রেভিসকে পথটা চলতে হবে এই কথা মাথায় নিয়েই। যুব ক্রিকেটে মাঠ কাঁপানো অনেকেই পেশাদার ক্রিকেটে পা রাখতে না রাখতেই খেই হারিয়েছেন, ব্রেভিস নিশ্চয় সে ভুল করবেন না।