ভুল সময়ের নক্ষত্ররা

একজন খেলোয়াড়ের আজন্ম লালিত স্বপ্ন থাকে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়ানোর। নিজ দেশের জার্সি গায়ে মাঠে জাতীয় সংগীত গাওয়ার অনুভূতির সঙ্গে কোনো কিছুরই তুলনা হয় না। তাগিদ থাকে এই জার্সি পরে অবিস্মরণীয় কিছু করার। কিন্তু কিছু খেলোয়াড় রয়েছেন, যাঁরা অবিস্মরণীয় কিছু করার পরও জাতীয় দলে নিজেকে পাকাপোক্ত করতে পারেননি। ভালো কোনো খেলোয়াড়ের জন্য আড়ালেই পড়ে যেতে হয়েছে তাঁদের। অথচ অন্য কোনো যুগে আগমন ঘটলে হয়তো ইতিহাসে অন্যভাবে লেখা হতে পারত তাঁদের নাম।

স্টুয়ার্ট ম্যাকগিল

ধরো তোমার দলে শেন ওয়ার্নের মতো খেলোয়াড় রয়েছে। আর অন্য কোনো স্পিনারকে দলে নেওয়ার কথা মাথায় আসবে? সর্বজয়ী অস্ট্রেলিয়া দলেই অবস্থা ছিল অনেকটা সে রকমই। দলের মূল স্পিনার হিসেবে যখন শেন ওয়ার্ন আছেন, তখন অন্য কাউকে দলে নেওয়ার কথা চিন্তা করাও পাপ। ঠিক এ কারণেই কপাল পুড়েছে স্টুয়ার্ট ম্যাকগিলের। বয়সে শেন ওয়ার্নের থেকে মাত্র এক বছরের ছোট ম্যাকের বেশ সুনাম ছিল ঘরোয়া লিগে। কিন্তু জাতীয় দলের জার্সির প্রশ্নেই যেন বারবার ছিটকে পড়তেন। কিন্তু যখনই সুযোগ পেয়েছেন বল হাতে দ্যুতি ছড়িয়েছেন ‘দ্য ম্যাক’। ‘ব্যাগি গ্রিন’ ক্যাপ পরে ৪৪ টেস্টে নিয়েছেন ২০৮ উইকেট। ওয়ানডে দলে খেলতে পেরেছিলেন মাত্র ৩ ম্যাচ। তাতেও ঝুলিতে পুরেছেন ৬ উইকেট। যদিও খেলোয়াড় হিসেবে কখনোই ওয়ার্নিকে ছাড়িয়ে যেতে পারেননি ম্যাকগিল; তবুও সর্বজয়ী অস্ট্রেলিয়া দলে না হয়ে যদি তাঁর আগমন এই অস্ট্রেলিয়া দলে হতো, তবে ইতিহাসে অন্যভাবেও লেখা হতে পারত তাঁর নাম।

ব্র্যাড হজ

সর্বজয়ী অস্ট্রেলিয়া দলের আরেক অভাগা তারকা ব্র্যাড হজ। বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ খেলার সুবাদে ক্রিকেট বিশ্বে বেশ পরিচিত নাম ‘দ্য ডজবল’। কিন্তু অজি জার্সিতে মেলে ধরার সুযোগ পাননি হজ। নিজেকে মেলে ধরার সময় যখন, তখন তাঁর পজিশনে খেলতেন রিকি পন্টিং, ম্যাথু হেইডেন, মাইকেল ক্লার্ক, মাইক হাসিরা। তাঁদের বিশ্রামে কিংবা ইনজুরিতে কালেভদ্রে ডাক পড়ত হজের। সেই সুযোগকে হেলায় হারাতে দেননি হজ। ফাঁকে ফাঁকে খেলতে নেমেই হাঁকিয়েছেন টেস্টে একটি দ্বিশতক আর ওয়ানডেতে সেঞ্চুরি! এত কিছুর পরও হজের জাতীয় দলে স্থান হয়েছিল মাত্র ৩ বছর। বল হাতে ওয়ানডেতে ১টি উইকেটের মালিকও হজ। ২০১৫ সালে শেষবারের মতো তাঁকে জাতীয় দলে দেখা গিয়েছিল, তা–ও টি-টোয়েন্টি দলে। ফার্স্ট ক্লাস এবং টি-টোয়েন্টিতে যথাক্রমে ৫১ ও ২ সেঞ্চুরির মালিক হজকে এখন আর মাঠে দেখা যায় না। গত বছরের বিগ-ব্যাশ মৌসুম শেষে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়েছেন ‘দ্য হজি’।

ভিক্টর ভালদেস

সর্বজয়ী অস্ট্রেলিয়া দল থেকে নজর আরেক সর্বজয়ী ফুটবল দলের দিকে দেওয়া যাক। ২০০৮ থেকে ২০১২, চার বছরে টানা ইউরো-বিশ্বকাপ-ইউরো জিতে ফুটবল বিশ্বে একচ্ছত্র আধিপত্য গড়ে তুলেছিল স্পেন। অন্যদিকে ক্লাব ফুটবলে বার্সেলোনা কাটাচ্ছে তাদের স্বর্ণযুগ। দুই স্বর্ণযুগে একসঙ্গে থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল জাভি, ইনিয়েস্তা, পুয়োল, ভালদেসের। বার্সেলোনার ইতিহাসের সেরা গোলরক্ষক হিসেবে তাঁকে ধরা হয় বটে, কিন্তু স্পেনের ইতিহাসে আফসোস হয়ে রয়েছেন ভালদেস। থাকবেনই–বা না কেন? জাতীয় দলের কান্ডারি হিসেবে তখন ইকার ক্যাসিয়াস। তাঁকে বসিয়ে ভিক্টর ভালদেসকে নামানোর সাহস হয়নি কোচ দেল ভস্কের। ২০১০ বিশ্বকাপ ও ২০১২ ইউরোতে দলে সুযোগ পেলেও একটি ম্যাচেও মাঠে নামার সুযোগ হয়নি ভালদেসের। স্পেনের জার্সি গায়ে মাত্র ২০ ম্যাচ খেলার সৌভাগ্য হয়েছে তাঁর। অন্য সময়ে জন্মালে হয়তো স্পেন ইতিহাসে অন্যভাবে লেখা হতে পারত তাঁর নাম।

মিকেল আর্টেটা

সর্বজয়ী স্পেন দলের আরেক তারকা মিকেল আর্টেটা। ভিক্টর ভালদেসের তো তা–ও জাতীয় দলে সুযোগ হয়েছিল শেষ পর্যন্ত, কিন্তু আর্টেটার সেই সুযোগ কখনোই হয়নি। একসময় স্পেন অনূর্ধ্ব-২১ দলের অধিনায়কের গায়ে চড়েনি জাতীয় দলের জার্সি। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে আর্সেনাল-এভারটনের মতো দলে খেলা আর্টেটাকে দলে নেওয়ার কথা মনেই আসেনি কোচদের। মাঝমাঠে জাভি-ইনিয়েস্তা-বুসকেটস-আলানসো-ফেব্রিগাসরা থাকলে অন্যদিকে নজর দেওয়ার সময় কোথায়? সে কারণেই হয়তো ‘লা ফুরিজা রোজা’ জার্সি গায়ে চড়েনি আর্টেটার। পরবর্তী সময়ে ক্ষোভে ইংল্যান্ড দলে খেলার চিন্তা করেছিলেন তিনি। অথচ স্পেনের তারকা ভরপুর সময়ে না জন্মালে হয়তো তাঁর নাম জাভি ইনিয়েস্তাদের মতো স্মরণীয় হয়ে থাকত।

হুয়ান রোমান রিকুয়েলমে

আর্জেন্টিনায় তাঁকে ডাকা হতো ‘কুইক্সোটিক এনিগমা’ নামে। আক্ষরিক অনুবাদ করলে ‘খামখেয়ালি প্রহেলিকা’। ফুটবলের অলস সৌন্দর্য বলা হতো হুয়ান রোমান রিকুয়েলমেকে। ফুটবলের প্লেমেকাররা সাধারণত খুবই পরিশ্রমী হয়ে থাকেন। কিন্তু তিনি ছিলেন তার পুরোপুরি উল্টো। মাঠে ঠিকই নিজেকে উজাড় করে দিতেন রিকুয়েলমে। ম্যারাডোনা–পরবর্তী সময়ে আর্জেন্টিনা দলে খেলার দরুন তাঁর ওপরেই সবার আশা ছিল একটা শিরোপা জেতার। অথচ ১১ বছরের আর্জেন্টিনা ক্যারিয়ারে মাত্র ৫৭ ম্যাচ খেলেছেন রিকুয়েলমে। ২০১০ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় বিশ্বকাপ দলে জায়গা হয়নি তাঁর। অথচ মেসির সঙ্গে জুটি করে বেইজিং অলিম্পিকে স্বর্ণপদক জেতা ‘এল আল্টিমো’ জাতীয় দলে জুটি করতে পারলে কী করতে পারতেন, তা আর কখনোই জানা যাবে না। আর্জেন্টিনা নিজেদের অধরা শিরোপা উঁচিয়ে ধরতে পারত তাঁদের হাত ধরেই।

মার্টিন হুয়ান দেল পোত্রো

আগের পাঁচজনের জন্য প্রতিপক্ষ ছিলেন নিজের দেশের তারকারা। কিন্তু দেল পোত্রোর প্রতিপক্ষ তাঁর সমসাময়িক খেলোয়াড়েরা। ২০০৫ সালে প্রফেশনাল টেনিসে অভিষেক হওয়া দেল পোত্রোর শুরুটা ছিল অসাধারণ। কিন্তু একই সময়ে টেনিসে আগমন ঘটে বিশ্বসেরা তিন তারকা—রজার ফেদেরার, রাফায়েল নাদাল ও নোভাক জোকোভিচের। একে একে টেনিস দুনিয়াকে গ্রাস করে নেন ‘তাঁরা তিনজন’। অভিষেকের পর থেকে ৫৬টি গ্র্যান্ড স্লামের ৪৮টিই উঠেছে তিনজনের হাতে। পোত্রোর কপাল পুড়েছে এখানেই। বেশির ভাগ গ্র্যান্ড স্লামযাত্রা শেষ হয়েছে তিন মোড়লের হাতেই। নামের পাশে মাত্র একটি গ্র্যান্ড স্লাম দেল পোত্রোর। সেটিও আবার রজার ফেদেরারকে হারিয়ে। ২০১৬ অলিম্পিকে নিজ দেশ আর্জেন্টিনাকে এনে দিয়েছেন রৌপ্যপদক। এই তিনজন না এলে হয়তো নামের পাশে আরও কয়েকটি গ্র্যান্ড স্লাম বেশি থাকত এই আর্জেন্টাইন টেনিস তারকার।

ভুল সময়ে জন্ম বলে আসলে কোনো কথা নেই, নিজে যোগ্যতা দিয়ে চাইলেই স্থান করে নেওয়া যায় ইতিহাসে। ওপরে যাঁদের কথা বলা হয়েছে, সবাই সমর্থকদের মনে জায়গা করে নিয়েছেন নিজ কর্ম দিয়ে। কোনো কিছুতে ব্যর্থ হয়ে হতাশ হয়ে পোড়ো না। নিজের কাজ ঠিকমতো করে গেলে একদিন ইতিহাসে না হলেও মানুষের মনে জায়গা হবে তোমার!