মহারাজা স্কুলের মহারাজ!

হালকা-পাতলা গড়ন, লম্বাও বেশি নন। সনদ বলছে, বয়স ২৩ হতে চলল। কাছ থেকে দেখলে অবশ্য এতটা বয়সও অনুমান করা কঠিন। গায়ে এখনো কৈশোরের গন্ধ। এই ছোটখাটো গড়নের তাইজুল ইসলাম গড়ে ফেললেন বড়সড় কীর্তি। টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের হয়ে সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড, সঙ্গে ব্যাট হাতে দুই ইনিংসেই দারুণ গুরুত্বপূর্ণ দুটি ইনিংস। দেশের মাটিতে বাংলাদেশের দ্বিতীয় টেস্ট জয়ের নায়ক নাটোরের তাইজুল।

অভিষেক টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে পেয়েছিলেন ৫ উইকেট। তৃতীয় টেস্টেই আবার শুধু নিজেকেই নয়, ছাড়িয়ে গেলেন বাংলাদেশের সবাইকে। যদিও ‘নায়ক’ শব্দটায় তাঁর জোর আপত্তি, পাদপ্রদীপের আলোয় বেশ অস্বস্তি। জীবনযাপন, চলনবলনে তিনি সাধারণ। ক্রিকেট দর্শনও সাধারণ। সাধারণ থাকতে পারাটাই তাই অসাধারণত্ব। আধুনিক ক্রিকেটে সাধারণ কাজটিই যে যায় না করা সাধারণভাবে!

উঠেও এসেছেন তিনি সাধারণ পরিবার থেকে। বাবা ইসকেনদার শেখ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। সচ্ছলতার সঙ্গে পরিচয় খুব একটা ছিল না। ইচ্ছা ছিল ছেলেকে পড়াশোনা করিয়ে মানুষ করবেন। কিন্তু ছেলের পড়াশোনা ভালোই লাগে না! মন ছুটে যায় শুধু খেলার মাঠে। পড়তেন নাটোর শহরের মহারাজা জেএন স্কুল অ্যান্ড কলেজে। কিন্তু পরীক্ষার খাতায় নম্বর যত না পেতেন, স্কুলের মাঠে তার চেয়ে অনেক বেশি পেতেন উইকেট। মহারাজা জেএন স্কুলের হয়ে রাজশাহী বিভাগীয় পর্যায়ে আন্তস্কুল টুর্নামেন্ট খেলেছেন বেশ কবার। বাবাকে সাহায্য করার জন্য মাঝেমধ্যে দোকানে বসতেন। বাকি সময় শুধু ক্রিকেট। বাবা-মাও একসময় হাল ছেড়ে দিয়ে সবার কাছে দোয়া চাইতে শুরু করলেন, ছেলে অন্তত ক্রিকেটে যেন অনেক দূর যায়!

নিজ শহর ছেড়ে একপর্যায়ে খেলতে আসেন রাজশাহী লিগে। স্থানীয় কোচদের নজরে পড়েন সেই সময়। ২০০৯ সালে ডাক পান বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলে। সুযোগ পেয়ে যান ঢাকা প্রিমিয়ার লিগেও। এগিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে পাথেয় পেয়ে যান, যখন নজর কাড়েন রাজশাহী বিভাগীয় দলের কোচ খালেদ মাসুদের। রাজশাহী দলের তখন দারুণ তিনজন বাঁহাতি স্পিনার—সোহরাওয়ার্দী শুভ, সাকলাইন সজীব, সানজামুল হক। তার পরও তাইজুলকে দেখে মুগ্ধ মাসুদ জাতীয় লিগের শেষ দিকে তিনটি ম্যাচে সুযোগ দেন তাইজুলকে। ২০১১ সালের এপ্রিলে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেকেই পেয়ে যান ছয় উইকেট, পরের দুই ম্যাচে আরও আটটি। জাতীয় দলের দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করেন ২০১৩-১৪ মৌসুমের পারফরম্যান্সে। ৫৫টি উইকেট পান ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির মৌসুমে, এর মধ্যে বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগেই চার ম্যাচে তিনবার ১০ উইকেটসহ পান ৩৭ উইকেট। গত মে মাসে সুযোগ পান ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের বাংলাদেশ ‘এ’ দলে। দুই মাস পর আবার ওয়েস্ট ইন্ডিজে, এবার জাতীয় দলে! অভিষেকেই বাংলাদেশের ষষ্ঠ বোলার হিসেবে পান পাঁচ উইকেট। তৃতীয় টেস্টে তো নাম লেখালেন ইতিহাসেই।

খালেদ মাসুদ যখন তাইজুলকে দেখেছিলেন, তাঁর মনে ধরেছিল তাইজুলের ‘সেকেলে’ ঘরানার বোলিং। এই টি-টোয়েন্টির যুগে টিকে থাকতে তূণে অনেক অস্ত্র থাকতে হয় স্পিনারদের, অস্ত্রভান্ডার হতে হয় বৈচিত্র্যময় ও সমৃদ্ধ। কিন্তু তাইজুলের বোলিংয়ে নেই বৈচিত্র্যের সমাহার, নেই কোনো জাদুকরি অস্ত্রও। বোলিংয়ের ভাষাটা সহজ, একই জায়গায় টানা বল করে যান ফ্লাইট দিয়ে। ফ্লাইট ও লুপ আর লাইন-লেংথই তাঁর অস্ত্র। উইকেটে যদি প্রাণ থাকে, তাহলে টার্ন-বাউন্স মিলিয়ে এই সহজ বোলিংটাই কতটা দুর্বোধ্য হতে পারে, সেটা জিম্বাবুয়ের ব্যাটসম্যানরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। ব্যাটে-বলে করতেই হাপিত্যেশ করে মরেছে জিম্বাবুইয়ানরা, একের পর এক উইকেটে তাইজুলের নাম উঠে গেছে রেকর্ড বইয়ে।

ব্যাটিংয়ে এমনিতে ভালো করার সুনাম খুব একটা ছিল না। কিন্তু ওই যে, চরিত্রেই মিশে আছে লড়াই। ব্যাট হাতেও ফুটে উঠেছে সেই প্রতিজ্ঞা। জটিলতায় ভরা আর মৌলিকত্ব হারিয়ে ফেলার এই যুগে তাইজুল যেন এক ঝলক মুক্ত বাতাস। তাঁর বোলিং ফিরিয়ে নিয়ে যায় যেন সেই ষাট-সত্তর দশকের ক্লাসিক্যাল বাঁহাতি স্পিনের জগতে। মাঠের বাইরেও তিনি যেন হারানো দিনের চরিত্র। আলো ঝলমল জগতে নিজেকে সব সময়ই রাখতে চান সাদাকালো।

তাইজুলের বোলিং সাধারণ, বলা সাধারণ। ক্রিকেট দর্শন সাধারণ। জীবনদর্শন সাধারণ। এই সময়ে এতগুলো সাধারণকে যিনি এক বিন্দুতে মিলিয়ে এগিয়ে যেতে পারেন, তিনিই তো সবচেয়ে অসাধারণ!

(কিশোর আলোর নভেম্বর ২০১৪ সংখ্যায় প্রকাশিত)