যত কাণ্ড ক্রিকেট মাঠে!

বল লাগলেও পড়ল না বেল

বাংলাদেশ দিয়েই শুরু হোক। ২০০৫ সালের সেই ন্যাটওয়েস্ট সিরিজটা বাংলাদেশ নিশ্চয়ই ভুলবে না। কার্ডিফে তখনকার পরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়াকে যে হারিয়ে দিয়েছিল পুঁচকে বাংলাদেশ। সেই সিরিজটা ভুলতে পারবেন না দুজন ক্রিকেটারও। মোহাম্মদ আশরাফুল আর ক্রিস ট্রেমলেট। ভিন্ন ভিন্ন কারণে অবশ্য। আশরাফুল সেই সিরিজে দুর্দান্ত খেলেছিলেন বলে প্রাপ্তি দিয়ে সিরিজটাকে মনে রাখবেন। আর ট্রেমলেটের মনে থাকবে অপ্রাপ্তির কারণে। হ্যাটট্রিকটা ‘পেয়ে’ও না পাওয়ার দুঃখে!

সিরিজের চতুর্থ ম্যাচ বাংলাদেশের বিপক্ষে অভিষেক হয়েছিল ট্রেমলেটের। নিজের পঞ্চম ও ইনিংসের দশম ওভারে পর পর দুই বলে ট্রেমলেট ফেরালেন শাহরিয়ার নাফীস ও তুষার ইমরানকে। দাঁড়িয়ে গেলেন হ্যাটট্রিকের সামনে। আশরাফুলকে বল করলেন। আশরাফুল বলটা ঠেকালেন। ভেতরের কোনায় লেগে বল উইকেটে পড়ে লাফিয়ে গিয়ে পড়ল স্টাম্পের বেলের ওপর। কিন্তু ন্যাড়া মাথায় বেল পড়লেও এই বেলা স্টাম্পের বেলের নট নড়নচড়ন! এভাবে বল লেগেও বেল পড়ল না! ট্রেমলেট অবাক। ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়েরা অবাক। আম্পায়ার, টিভি ভাষ্যকার, দর্শক—সবাই অবাক। সবচেয়ে অবাক এবং খুশি দেখাল আশরাফুলকেই। জীবনের প্রথম তিনটি উইকেটই হ্যাটট্রিক করে পেয়েছিলেন—এই গর্ব আর সঙ্গী হলো না ট্রেমলেটের। আর আশরাফুল? ৫২ বলে ১১টি চার ও ৩ ছক্কায় খেললেন ৯৪ রানের বিস্ফোরক এক ইনিংস!

এর চেয়েও অবাক করা কাণ্ড ঘটেছে ১৯৯৭-৯৮ ফয়সালাবাদ টেস্টে। মুশতাক আহমেদ বল করছিলেন প্যাট সিমকক্সকে। বল ব্যাটসম্যান, ব্যাটকে তো বটেই, ফাঁকি দিল স্টাম্পকেও। দুই স্টাম্পের মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে গেল বল। কিন্তু পড়ল না বেল! স্টাম্পগুলো পুঁতে রাখাই হয় এমনভাবে, এর ভেতর দিয়ে বল বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু ‘অনন্তীয়’ ঘটনা ঘটে অসম্ভবটাই সম্ভব হয়েছিল। সিমকক্স সেই ইনিংসে ৮১ করেছিলেন। ম্যাচের সেরা খেলোয়াড়ও হয়েছিলেন!

১৯৫৮ সালে হেডিংলি টেস্টে ঘটেছিল আরেক মজার ঘটনা। ইংল্যান্ডের হয়ে ইনিংস উদ্বোধন করতে নেমেছিলেন একজন রাগবি ও একজন ফুটবল খেলোয়াড়। আর্থার মিলটন ইংল্যান্ড জাতীয় দলের হয়ে ফুটবল খেলেছেন। তাঁর ওপেন-সঙ্গী মাইক স্মিথও জাতীয় রাগবি দলের হয়ে খেলেছিলেন।

ক্রিকেটে লালকার্ড পেলেন গ্লেন ম্যাকগ্রা

জন থায়ের মাত্র সাতটি ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ খেলেছেন, সেটিও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে। তাঁকে মনে রাখার কী দায় পড়েছে ইতিহাসের! মনে অবশ্যই রেখেছে। না হলে এত দিন বাদে কেন তাঁর নাম উচ্চারণ করা? কিন্তু মনে রেখেছে একদম অন্য কারণে। ডুবে যাওয়া টাইটানিকের নিহত যাত্রীদের মধ্যে ছিলেন তিনিও। টাইটানিক ট্র্যাজেডির শিকার ইতিহাসের একমাত্র ক্রিকেটার! সেই যাত্রাতেই বেঁচে গিয়েছিলেন রিচার্ড উইলিয়ামস নামের আরেক খেলোয়াড়, তিনি অবশ্য খেলতেন টেনিস। পরে ১৯২০ সালে উইম্বলডনও তিনি জিতেছিলেন।

১৯৪৮-৪৯ সালে একটি তিন দিনের ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল ভারতের মহারাষ্ট্র ও কাটিওয়ার। প্রথম দুই দিনে দুর্দান্ত ব্যাটিং করে ৪৪৩ রান সংগ্রহ করেছিলেন কাটিওয়ারের ব্যাটসম্যান ভুসাহেব নিমবালকার। আর মাত্র ৯ রান করলেই তিনি ছুঁয়ে ফেলতে পারতেন ডন ব্র্র্যাডম্যানের ৪৫২ রানের বিশ্ব রেকর্ডটি। কিন্তু তৃতীয় দিনে আর ব্যাটই করতে নামেননি নিমবালকার। অনেককে বলতে শোনা যায় যে তৃতীয় দিনে বিয়ের পিঁড়িতে বসার কথা ছিল বলেই নাকি আর মাঠে নামেননি। রেকর্ডের চেয়ে বিয়ের আনন্দই বোধ হয় বেশি!

১৯৩৮-৩৯ সাল। তখন টেস্ট ক্রিকেট ছিল ‘টাইমলেস’। ফল নির্ধারণ না হওয়া পর্যন্ত খেলা চলতেই থাকত। ডারবানে দক্ষিণ আফ্রিকা আর ইংল্যান্ডের মধ্যকার ম্যাচটি গড়িয়েছিল নবম দিনে। ইংল্যান্ড ব্যাটিং করছিল ৬৯৬ রানের লক্ষ্য নিয়ে। ৫ উইকেট হারিয়ে ৬৫৪ রান সংগ্রহও করে ফেলেছিল সফরকারীরা। দল জয়ের পথে। কিন্তু শেষ কয়েকটা রান আর জমা করা হয়নি স্কোরবোর্ডে। ইংল্যান্ডগামী জাহাজটা ছেড়ে যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছিল বলে খেলা ছেড়ে তাদের ছুটতে হয়েছিল বন্দরে!

১৮৭৭ সালের মার্চে মেলবোর্নে অনুষ্ঠিত প্রথম আনুষ্ঠানিক টেস্ট ম্যাচটিতে ইংল্যান্ডকে ৪৫ রানে হারিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। ঠিক ১০০ বছর পর মেলবোর্নেই আরেকটি ম্যাচ আয়োজন করা হয় প্রথম সেই ম্যাচটির শতবর্ষ উদ্যাপনের জন্য। অদ্ভুতভাবে এবারও জয় পায় অস্ট্রেলিয়া। ঠিক ওই ৪৫ রানের ব্যবধানেই!

ক্রিকেটের নিয়ম অনুযায়ী একই বোলার পরপর দুটি ওভার বল করতে পারেন না। কিন্তু এমন নজিরও আছে ক্রিকেট ইতিহাসে। ১৯৫১ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এই কাজ করেছিলেন নিউজিল্যান্ডের অ্যালেক্স মোইর। চা-বিরতির ঠিক আগের ও পরের ওভারে বল করেছিলেন এই কিউই বোলার। এমন ঘটনা এর আগে ঘটেছিল আর একবারই। ১৯২১ সালের অ্যাশেজ সিরিজের একটি টেস্টে।

খেলার মধ্যে বৃষ্টি শুরু হলে নিশ্চয়ই কারও ভালো লাগে না। তবে বৃষ্টির কিন্তু উপকারিতাও আছে! আজ যে এক দিনের ক্রিকেটের এত রমরমা, এর মূলে কিন্তু আছে এই বৃষ্টির বাধা। ১৯৭১ সালে ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার প্রথম যে এক দিনের ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেটা আদতে একটা পাঁচ দিনের টেস্ট ম্যাচই হওয়ার কথা ছিল। বৃষ্টির কারণে প্রথম চার দিন পণ্ড হওয়ায় পঞ্চম দিনেই একটি এক দিনের ম্যাচ অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। অস্ট্রেলিয়া জিতেছিল ৫ উইকেটে। এর পর থেকেই শুরু ওয়ানডে ক্রিকেট!

খুলে গেল লু ভিনসেন্টের ট্রাউজার

ক্রিকেট মাঠে লাল কার্ড! নিউজিল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া ওয়ানডে ম্যাচে এমন ঘটনা ঘটেছিল। শেষ বলে নিউজিল্যান্ডের জয়ের জন্য দরকার ছিল ৪৫ রান। ম্যাচটা শেষ হয়ে গেছে। আনুষ্ঠানিকতার শেষ বলটি করতে এসে পেসার গ্লেন ম্যাকগ্রা হুট করে বনে গেলেন স্পিনার! স্পিনারদের মতো ছোট্ট রানআপ পেরিয়ে এসে বল ডেলিভারি করার আগে করলেন আরেক অদ্ভুত কাণ্ড। গড়িয়ে গড়িয়ে ছুড়ে দিতে চাইলেন বল, আন্ডারআর্ম ডেলিভারি যাকে বলে! পরে মিষ্টি হেসে বোঝালেন, স্রেফ মজা করছিলেন! কিন্তু আম্পায়ার বিলি বাউডেন সিরিয়াস ভঙ্গিতে পকেট থেকে লাল কার্ড বের করে দেখিয়ে দিলেন! সবাই হতবাক! পেসার না হয় স্পিনার হয়েছিল, আম্পায়ার এভাবে রেফারি হয়ে গেলেন কীভাবে। বাউডেনও হেসে দিয়ে বোঝালেন, তিনিও মজাই করছিলেন!

এটিও ঘটেছিল নিউজিল্যান্ডের একটি ওয়ানডেতে। কিউই ক্রিকেটার লু ভিনসেন্টের ট্রাউজারের ফিতে একেবারে ‘লু’জ হয়ে গিয়েছিল। চার বাঁচাতে বাউন্ডারি লাইনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। ডাইভ দিয়ে মাটিতে গড়িয়ে এগোনোর সময় ভিনসেন্টের পাজামা নেমে যায়। কী কেলেঙ্কারি কাণ্ড! ওই অবস্থাতেই ভিনসেন্ট থ্রো করেন। ভিনসেন্ট অবশ্য পরে মিষ্টি হেসে বলেছিলেন, সুপারম্যান আন্ডারওয়্যার দেখালে দোষ নেই, আমি দেখালেই দোষ!

(কিশোর আলোর অক্টোবর ২০১৪ সংখ্যায় প্রকাশিত)