যেভাবে সপ্তম ব্যালন ডি’অর জিতলেন মেসি

সবাইকে ছাড়িয়ে সপ্তমবারের মতো ব্যালন ডি’অর উঁচিয়ে ধরলেন মেসিই

২০১২ সালে চতুর্থবারের মতো ব্যালন ডি’অর জিতেছিলেন লিওনেল মেসি। সেই অনুষ্ঠান শেষে ডাচ কিংবদন্তি ইয়োহান ক্রুইফ বলে বসলেন, ‘চতুর্থ ওর কাছে কিছুই নয়, ও চাইলেই পঞ্চম, ষষ্ঠ; এমনকি সপ্তম ব্যালন ডি’অরও জিততে পারে।’ সেদিন ক্রুইফের কথা অনেকটা অবিশ্বাস্যই ঠেকেছিল। তবে যে গতিতে এগোচ্ছিলেন মেসি, তাতে প্রশ্ন তোলার সাহসও পাচ্ছিলেন না কেউ।

৯ বছর পর ক্রুইফের সে কথাই সত্য হলো। একসময় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর আগ্রাসনে যেটাকে অসম্ভব মনে হচ্ছিল, সেটাকেই সম্ভব করেছেন তিনি। সপ্তম ব্যালন ডি’অর জিতে রোনালদোর সঙ্গে ব্যবধানটা ৭-৫ করেছেন মেসি। এতবার ব্যালন উঁচিয়ে ধরার রেকর্ড আর নেই কারও।

প্যারিসের থিয়েখ দু’শাতেলে হোটেলে তারার মেলা বসেছিল সেদিন। সাবেক–বর্তমান খেলোয়াড়েরা তো ছিলেনই, আরও যুক্ত হয়েছিলেন ফর্মুলা ওয়ান রেসার ফের্নান্দো আলোনসো আর এস্তেবান ওকোন। সেজে এসেছিলেন মিউজিক ডুয়ো ডাফট প্যাঙ্কের মতো করে। এমনকি ‘স্পাইডারম্যান নো ওয়ে হোম’ সিনেমার প্রচারণার জন্য এসেছিলেন স্বয়ং স্পাইডারম্যান টম হল্যান্ড আর জেন্ডায়াও। এত সব তারকার মধ্যেও উজ্জ্বল ছিলেন লিওনেল মেসি। ঝলমলে এক ব্লেজারে অনুষ্ঠানের সব আলো কেড়ে নিয়েছিলেন আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি। শেষ পর্যন্ত আলোটা তাঁর দিকেই থাকল, সবাইকে ছাড়িয়ে সপ্তমবারের মতো ব্যালন ডি’অর উঁচিয়ে ধরলেন মেসিই।

গত ছয়বারের মতো, এবারের ব্যালন ডি’অর জয়ের রাস্তাটা অবশ্য এতটা মসৃণ ছিল না। এক দশকের বেশি সময় ধরে ব্যালন ডি’অরকে নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করেছিলেন মেসি ও রোনালদো। সেই অবস্থানকে নড়বড়ে করে দিয়েছিলেন লুকা মদরিচ। যদিও বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সে শিরোপা আবার নিজের কবজায় নিয়ে এসেছিলেন মেসি।

কিন্তু বয়সের ছাপ ছিল স্পষ্ট। গত মৌসুমেই সবদিক দিয়ে এগিয়ে ছিলেন রবার্ট লেভানডফস্কি। করোনা মহামারির দোহাই দিয়ে ফ্রান্স ফুটবল যদি ব্যালন ডি’অর বাতিল না করত, তবে মেসি-রোনালদোর রাজত্বে হানা দেওয়ার তালিকায় মদরিচের পর লেভানডফস্কির নামটাও উচ্চারিত হতো। সেটা হয়নি, সর্বজয়ী হয়েও সেরা হওয়ার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি জোটেনি বায়ার্ন তারকার ঝুলিতে।

সে আক্ষেপেই বুঝি মৌসুমের শুরুর দিন থেকে ছড়ি ঘোরানোর শুরু। টানা ১৫ ম্যাচে গোল, গার্ড মুলারের রেকর্ড ভেঙে বুন্দেসলিগার এক মৌসুমে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড; রেকর্ডবুকে যেন শুধু লেভানডফস্কি আর লেভানডফস্কি।

অন্যদিকে মাঠের ভেতরে-বাইরে দুই জায়গাতেই সমস্যার অন্ত নেই মেসির। প্রথমত, বেহাল বার্সা, খেলোয়াড়দের বেতন দেওয়ার অবস্থায়ও নেই তারা। পত্রপত্রিকায় খবর আসছে, এই বুঝি দেউলিয়া হয়ে গেল বার্সেলোনা। অন্যদিকে মৌসুমের শুরুটা ঠিক জুতসই হয়নি তাঁর। প্রথম ১৭ ম্যাচে মাত্র ৪ গোল। বার্সেলোনা কিংবা আর্জেন্টিনা—কোনো জায়গাতেই নিজেকে সেভাবে মেলে ধরতে পারছিলেন না মেসি। ম্যাচের পর ম্যাচ গোল নেই, লিগেও নেই ভালো অবস্থানে। সব মিলিয়ে বার্সেলোনা আর মেসি দুজনেরই হযবরল একটা অবস্থা। চ্যাম্পিয়নস লিগেও বিদায় বলতে হলো বায়ার্নের কাছে হেরে।

বহু প্রতীক্ষার পর শিরোপা হাতে মেসির উদ্‌যাপন দেখতে পেরেছে বিশ্ব

মৌসুমের চাকা ঘুরতে না ঘুরতেই ফিরতে লাগল মেসির ফর্ম, মাঠের বাইরের অবস্থা কোনোমতে ঠেস দিয়ে চললেও ভেতরে বরাবরের মতোই বার্সাকে একাই টেনে নিয়ে চললেন মেসি। শেষ দিন পর্যন্ত চলল লিগ শিরোপার জন্য লড়াই, জিতলেন কোপা দেল রে, সেই সঙ্গে পিচিচি ট্রফি (লা লিগার সর্বোচ্চ গোলদাতা)। এত কিছুর পরও মৌসুমটা ঠিক মেসিময় লাগছিল না। কারণটা স্বাভাবিক, লিওনেল মেসি এসব নিয়মিতই করেন। বরং মাঠের বাইরে বার্সেলোনার নাজুক অবস্থান তাঁর অর্জনগুলোকে যেন সামান্য হলেও ফিকে করে দিয়েছে। তার ওপর বছরটা হলো আন্তর্জাতিক শিরোপার। এই বছরের ব্যালন ডি’অর–দৌড় ঠিক করে দেবে আন্তর্জাতিক শিরোপাই। লিওনেল মেসি তাই পাখির চোখ করলেন সেটাকেই।

বছরের পর বছর তাঁকে এই একটা জিনিস নিয়ে খোঁচা শুনতে হয়েছে। লিওনেল মেসি সব জিতেছেন ক্লাবের হয়ে। আর্জেন্টিনার হয়ে মেসির গল্পটা শুধুই হতাশার। ক্লাবের সর্বজয়ী মেসি আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে দিলেই কোথায় যেন হারিয়ে যান। হাতছোঁয়া দূরত্বে শিরোপা রেখে ফেরত আসতে হয়েছে টানা তিন বছর। মনঃকষ্টে অবসর নিয়েছেন, আবার ফিরেও এসেছেন দেশকে কিছু দেওয়ার প্রত্যয়ে। কতটা কষ্ট বুকে জমা হলে একজন বলতে পারেন, আমি আমার ক্যারিয়ারের সব অর্জন একটা বিশ্বকাপের জন্য উৎসর্গ করতে রাজি। সুযোগটাও আস্তে আস্তে কমে আসছিল, এই কোপা আমেরিকা আর সামনের বিশ্বকাপই কাগজে–কলমে ছিল তাঁর শেষ সুযোগ। সেটাতেই করেছেন বাজিমাত। এবার আসা সুযোগটাকে হাতছাড়া করেননি, আঁকড়ে ধরেছেন। ৪ গোলের সঙ্গে করলেন ৫টি অ্যাসিস্ট। এত দিন বারবার কথা উঠেছে তাঁর অধিনায়কত্ব নিয়ে। সেটাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চললেন ফাইনালে।

ফাইনালের মঞ্চটা অবশ্য তাঁর বড্ড চেনা। এ মঞ্চে অনেকবার উঠেছেন, মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেছেন। এবারও সেটা হতে দেননি দি মারিয়া। ব্রাজিলকে আরেকটি ‘মারাকানাজো’ উপহার দিয়ে শিরোপা নিজেদের করে নেয় আর্জেন্টিনা। ২৮ বছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটল লিওনেল মেসির হাত ধরে। আফসোস শুধু একটি জায়গাতেই, ম্যারাডোনা নিজ চোখে তা দেখে যেতে পারলেন না।

মারাকানা স্টেডিয়ামের মাঝখানে বসে লিওনেল মেসির সে কান্না, শিরোপা হাতে উদ্‌যাপন; বহু প্রতীক্ষার পর এ দুটি দৃশ্যের দেখা পেয়েছে বিশ্ব। বহু বছরের বহু প্রতীক্ষা পেরিয়ে লিওনেল মেসি যখন শিরোপাটা উঁচিয়ে ধরলেন, তখনই অনেকটা নিশ্চিত হয়েছিল তাঁর ব্যালন ডি’অর। বাকিটা ছিল সময়ের অপেক্ষা।

এর মাঝে কম কিছু হয়নি, বার্সেলোনার সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় মেসি দল ছেড়েছেন। ক্যারিয়ারের শুরু থেকে বার্সেলোনার জার্সি গায়ে দিয়ে বড় হওয়া মেসিকে হঠাৎই দেখা গেল পিএসজির জার্সিতে। যেটা কয়েক মাস আগেও অসম্ভব মনে হচ্ছিল, সেই দুঃস্বপ্নই সত্যিতে পরিণত হয়েছে বার্সেলোনা–সমর্থকদের জন্য। বার্সা ছেড়ে অজানা গন্তব্যের উদ্দেশে পাড়ি দেওয়া মেসিকে সাদর সম্ভাষণ করেছিলেন প্যারিসবাসী। প্যারিসের রাস্তা ছেয়ে গিয়েছিল মেসি মেসি চিৎকারে। সে অনুযায়ী পিএসজিকে এখনো কিছু দিতে পারেননি তিনি। সময়টা কেটেছে চোট আর বাজে ফর্মে।

মেসির নামে পাশে এখন সাতটি ব্যালন ডি’অর

আর তাঁর বাজে ফর্মের মধ্যেই একে একে জেগে উঠছিলেন টেক্কা দেওয়ার মতো প্রতিদ্বন্দ্বী। চ্যাম্পিয়নস লিগ আর ইউরোজয়ী জর্জিনিও, বুন্দেসলিগায় অসাধারণ এক মৌসুম কাটানো রবার্ট লেভানডফস্কি আর একেবারে শেষ দিকে ফ্রান্সকে একা হাতে নেশনস লিগ জেতানো করিম বেনজেমা। কেউই কারও থেকে কম ছিলেন না। কিন্তু দিন শেষে সাংবাদিক আর অধিনায়কেরাই ঠিক করে দেন, কার হাতে উঠবে শিরোপা। আর সেটা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল মেসির হাতে কোপা আমেরিকা ওঠার দিনই। দিদিয়ের দ্রগবার কাজ ছিল শুধু আনুষ্ঠানিকভাবে সেটা ঘোষণা করা।

আর সেটা হতেই আনন্দে ফেটে পড়লেন দুনিয়ার আপামর মেসি–সমর্থক। বিশেষ করে তাঁর তিন ছেলেকে তো সামলে রাখাই সম্ভব হচ্ছিল না। বাবার অর্জন যেন তাদেরও অর্জন। শুধু মেসিই ছিলেন ভাবলেশহীন। আগেও তিনি বারবার বলেছেন, ব্যক্তিগত শিরোপা টানে না তাঁকে। তিনি খেলেন নিজের আনন্দের জন্য, যেদিন আর এই আনন্দ পাবেন না, সেদিন আর তাঁকে ফুটবলে দেখাও যাবে না। পাঁচটা হোক কিংবা সাতটা, ব্যালন ডি’অর পান কিংবা না পান, কোনোটাতেই তাঁর কিছু যায়–আসে না। তাই তো শিরোপা নিতে উঠে অকপটে স্বীকার করলেন, গতবার ব্যালন ডি’অর দেওয়া উচিত ছিল। আর দিলে সেটা পাওয়া উচিত ছিল লেভানডফস্কিরই। কজন খেলোয়াড় এমন অকপটে স্বীকারোক্তি দিতে পারেন।

মেসি পারেন। পারেন বলেই হয়তো সাতটি ব্যালন ডি’অর নামের পাশে নিয়েও তাঁর বিন্দুমাত্র অহংকার নেই। যে অর্জন নিয়ে যৌবনেই মাথা ঘামাননি, তা নিয়ে শেষ বয়সে এত মাতামাতি করার কী আছে? বরং তাঁর চোখ কাতারে, পরের বছর যেখানে বসছে সোনালি ট্রফির আসর। ২০১৪ সালে যেটা হয়নি, সেটা ২০২২-এ নিজের করে পেতে চান তিনি।