রূপকথার মতো

২০০৭ সালে শেন ওয়ার্নের অবসরের পর অস্ট্রেলিয়ায় গরুখোঁজা শুরু হলো লেগ স্পিনারের। শেন ওয়ার্নের সময়ে ক্রমাগত ভালো খেলা স্টুয়ার্ট ম্যাকগিলকে ভাবা হয়েছিল ভবিষ্যতের জন্য। কিন্তু হঠাৎ ম্যাকগিলও অবসরে গেলে নির্বাচকেরা খুঁজে নিয়ে এলেন ওয়ার্নের কাছাকাছি অ্যাকশনে বল করা স্টিভ স্মিথকে, যাঁকে প্রথম দেখে স্বয়ং শেন ওয়ার্ন প্রশংসা করে বলেছিলেন, ‘সে আমাদের জন্য বিশেষ কিছু হতে পারে।’ সেই স্টিভ স্মিথই বদলে গিয়ে আজ হয়েছেন বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন, একেবারে যেন রূপকথার গল্পের নায়কের মতো।

রূপকথার গল্প কে না পড়েছে। রূপকথার গল্পের খুব সুন্দর একটা প্যাটার্ন থাকে। গল্পের নায়ক কিংবা নায়িকার জীবন শুরুতে খুব সুন্দরই যায়, কিন্তু মাঝে হঠাৎ করে তাদের জীবনে সমস্যা আসে। এরপর থেকেই যেন তাদের জীবনের চাকা ঘুরতে থাকে। জীবনের এই কঠিন মুহূর্তকে বলা হয় ‘টার্নিং পয়েন্ট’। এই একটা পয়েন্টে এসেই সব গল্পের প্রধান চরিত্র তার জীবনের দিশা খুঁজে পায়। সেটা হতে পারে নায়িকার আবির্ভাব বা নতুন কিছু করে দেখানোর নেশা কিংবা স্বপ্নপূরণের ইচ্ছা। তবে বাস্তব জীবন নাটক-সিনেমার চেয়ে বড্ড বেশি অদ্ভুত। এখানে রূপকথার গল্পের মতো সব হাতের কাছে পাওয়া যায় না, তা আদায় করে নিতে হয়, ছিনিয়ে নিতে হয় প্রাপ্যটুকু। স্টিভ স্মিথের গল্পটা এর চেয়ে কম কিছু নয়।

আজকে যে স্টিভ স্মিথকে দেখছ বলিষ্ঠ হাতে ভারত-ইংল্যান্ডের পেস বোলিং সামলাচ্ছেন, অফসাইডের বাইরের বলগুলো আছড়ে ফেলছেন কাভারের ওপর দিয়ে সীমানার বাইরে, সেই স্মিথই এককালে অফসাইডের বল ব্যাটেই লাগাতে পারতেন না। অফসাইডের বল ব্যাটে লেগে কাভারের বদলে যেত উইকেটরক্ষকের হাতে।

স্মিথের অভিষেক হয়েছিল ঘরোয়া ক্রিকেটে, ২০০৮ সালে। সেবার ঘরোয়া কেএফসি টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি হয়ে নির্বাচকদের নজরে চলে এসেছিলেন স্মিথ। তখন থেকেই ভবিষ্যৎ ওয়ার্ন ভাবা হচ্ছিল তাঁকে। ২০০৯-১০ ঘরোয়া মৌসুমের পারফরম্যান্স তাঁকে জায়গা করে দেয় অজি দলে। যদিও তখনো তাঁর ব্যাটিং ফেলে দেওয়ার মতো কিছু ছিল না, অনূর্ধ্ব দলগুলোতে ব্যাটিং পারফরম্যান্স দেখালেও ঘরোয়া লিগে ঠিক নিয়মিত হতে পারছিলেন না। এ জন্যই হয়তো তাঁকে বোলার হিসেবেই প্রথমে দলে অভিষেক করায় অস্ট্রেলিয়া। ২০১০ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে অভিষেকে খুব একটা খারাপ করেননি; বরং তাঁকে যে কারণে নেওয়া হয়েছিল, ২০১০ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, সেখানে নেমেই বাজিমাত করে দিয়েছিলেন বোলিং দিয়ে। পুরো টুর্নামেন্টে ৭ ম্যাচ খেলে ১১ উইকেট নিয়ে হয়েছিলেন দ্বিতীয় সেরা বোলার। ফলাফল হিসেবে অস্ট্রেলিয়া দল তাঁকে অভিষেক করিয়ে দিল সাদা জার্সিতে। ৪২১ নম্বর ব্যাগি গ্রিন ক্যাপ পেলেন স্টিভেন পিটার ডেভেরাক্স স্মিথ। স্মিথের ‘বিগিনার্স লাক’ বেশ ভালোই ছিল বলা যায়। পাকিস্তানের বিপক্ষে মরা পিচে ৩ উইকেট আর শেষ দিকে একটা ৭৭ রানের ইনিংস তাঁকে জায়গা করে দিল পরের অ্যাশেজেও।

প্রত্যেক নায়কের গল্পে একটা টার্নিং পয়েন্ট আসে। যে মুহূর্ত থেকে তাঁর জীবনের পরিবেশ, পরিস্থিতি, লক্ষ্য—সব বদলে যায় নিমেষেই। স্মিথের জীবনে সেই টার্নিং পয়েন্ট হয়ে এল ২০১১-১২ অ্যাশেজ। শেষ টেস্টে ব্যাট হাতে লড়তে দেখে ব্যাটিং অর্ডারেও দেওয়া হয়েছিল প্রমোশন। কিন্তু তাতে কিসের কী? দুর্দান্ত ইংলিশ লাইনআপের কাছে নিজেকে খুঁজেই পেলেন না স্মিথ। না বল হাতে, না ব্যাট হাতে। কোনোভাবেই সিরিজে খেলা দেখাতে পারলেন না স্মিথ। বাজে ফলের দরুন বাদ পড়লেন দল থেকে। এই বাদ পড়া সেই বাদ পড়া নয়; বরং অস্ট্রেলিয়া টিম থেকে বাদ পড়া। অস্ট্রেলিয়া দল থেকে বাদ পড়ার অর্থ একটাই হতে পারে, আবার এই দলে সুযোগ পেতে হলে আশাতীত ভালো পারফর্ম করতে হবে। নইলে ‘ব্যাগি গ্রিন’ টুপিটা আর কখনো মাথায় চাপানো সম্ভব হবে না।

দল থেকে বাদ হওয়ায় উঠেপড়ে লাগবেন কী, উল্টো আরও ডিপ্রেশনে চলে গেলেন স্মিথ। ‘ব্যাগি গ্রিন’ টুপি আর কখনো মাথায় চাপানো সম্ভব হবে না, এই ভাবনাতেই দিনরাত কেটে যেত, খেলবেন আর কোন সময়? এমন সময় স্মিথের জীবনে নায়িকা হয়ে আবির্ভাব ঘটল ড্যানি উইলিসের। ড্যানির সঙ্গে স্মিথের পরিচয় তাঁর ক্যারিয়ারের তুঙ্গে থাকার সময়ে। তাই ক্যারিয়ারের খারাপ সময়ে স্মিথের পাশে যখন কেউ নেই, তখন পাশে এসে দাঁড়ালেন ড্যানি। ড্যানি ছিলেন সাঁতারু, কিন্তু কখনোই জাতীয় পর্যায় পেরিয়ে আন্তর্জাতিকে পা দেওয়া হয়নি তাঁর। তাই ব্যর্থতার মর্ম, কষ্ট—সবটাই বুঝতেন খুব ভালোমতো। সে সময় স্মিথের পাশে এসে ড্যানি কতগুলো শর্ত দিলেন। যদি স্মিথ রানে ফেরেন, ঘরোয়া ক্রিকেটে হাফ সেঞ্চুরি করতে পারেন, তবেই তাঁকে নিয়ে যেতে পারবেন ডিনারে। আস্তে আস্তে বাড়তে থাকল শর্ত। স্মিথ তখন রাজকন্যা, রাজত্ব—দুই-ই পাওয়ার লোভে লোভাতুর। এই লোভকেই কাজে লাগালেন ড্যানি উইলিস। স্মিথের সেরাটা বের করে আনলেন তাঁর ভেতর থেকে।

প্রত্যেক নায়কের গল্পে একটা টার্নিং পয়েন্ট আসে। যে মুহূর্ত থেকে তাঁর জীবনের পরিবেশ, পরিস্থিতি, লক্ষ্য—সব বদলে যায় নিমেষেই। স্মিথের জীবনে সেই টার্নিং পয়েন্ট হয়ে এল ২০১১-১২ অ্যাশেজ।

স্মিথের ব্যাটিং স্টাইল কখনোই প্রথাগত অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানদের মতো ছিল না। মিডল স্টাম্পে গার্ডের বদলে লেগ স্টাম্পে গার্ড নিতেন স্মিথ, যে কারণে বোলার যেমন দেখতে পেত তিনটি স্টাম্প, তেমনি অফের বল খেলতে গিয়ে বেশি ঝুঁকে পড়তেন স্মিথ। স্মিথ বুঝেছিলেন, তাঁর ভালোবাসা-সাধনা যেখানে, এই ব্যাটিং দিয়েই অস্ট্রেলিয়া দলে ফিরতে হবে। অ্যাশেজের খেলাগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে ধরনা দিতে থাকলেন ব্যাটিং–গুরুর কাছে। একে একে ১৫ জন ব্যাটিং–গুরু পাল্টালেন স্মিথ। কিন্তু প্রত্যেকেরই একই কথা, ‘তোমার ব্যাটিং স্টাইল চেঞ্জ করতে হবে।’ কিন্তু ব্যাটিং স্টাইল চেঞ্জ করতে অনড় স্মিথ। বরং টেকনিকে সামান্য পরিবর্তন আনলেন, গার্ড আগের জায়গাতেই থাকল, শুধু ব্যাটিংয়ের সময় একটু অফ স্টাম্পের দিকে শাফল করে খেলা শুরু করলেন। এতেই যেন ব্যাটে-বলে মিলতে শুরু করল। কিন্তু কাজটা এতটাও সোজা ছিল না। এবি ডি ভিলিয়ার্স একবার বলেছিলেন, ‘ক্রিকেট যতটা না মাঠের খেলা, তার চেয়ে বেশি মগজের খেলা। একবার মগজে এঁটে গেলে, আত্মবিশ্বাস চলে এলে খেলাতে আর কেউ দমাতে পারবে না।’ স্মিথ সেটাই করে দেখালেন। দুই বছর পর ভারত সিরিজে ডাক পেলেন স্মিথ।

২০১৩ সালে ভারত সিরিজে স্মিথ ডাক পেলেন বদলি ব্যাটসম্যান হিসেবে। সেই সফরে ১৫ জনের বদলে ১৭ জন ক্রিকেটার নিয়ে গিয়েছিলেন কোচ মিকি আর্থার। স্মিথের সেই দলে সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা বড্ড ক্ষীণ। কিন্তু কথায় আছে, ‘ভাগ্য সাহসীদের পক্ষেই থাকে।’ স্মিথও প্রস্তুত ছিলেন। বাজে গেল অস্ট্রেলিয়ার প্রথম দুই ম্যাচ। এরপর কোচ মিকি আর্থার দলের ১৫ জন সদস্যের কাছ থেকে একটা রিপোর্ট চাইলেন যে তাঁরা কীভাবে এই সিরিজে ফিরে আসতে পারেন, কার কোন সমস্যা, কী কী উন্নতি করতে পারেন নিজে বা সতীর্থেরা। দুই দিন সময় দেওয়ার পরও সেই রিপোর্ট দেননি ১৭ জনের মধ্যে ৪ জন। চারজন ছিলেন সহ-অধিনায়ক শেন ওয়াটসন, মিচেল জনসন, জেমস প্যাটিনসন ও উসমান খাজা। কোচ মিকি আর্থার অধিনায়ক আর ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে বাড়ি পাঠিয়ে দেন এই ৪ জনকে আর দল সাজাতে শুরু করেন বাকি ১৩ জনকে নিয়ে। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটীয় কেলেঙ্কারি ‘হোমওয়ার্ক গেট’ কেলেঙ্কারি নামে পরিচিত। কপাল খুলে গেল স্মিথের আর সুযোগ পেয়েই ৯২ রানের ইনিংসে বাজিমাত। সেই শুরু। আর সেখান থেকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি স্মিথকে। যদিও সেই সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া, কিন্তু পুনর্জীবন পেয়েছিল স্মিথের ক্যারিয়ার।

পরের অ্যাশেজের আগে অস্ট্রেলিয়ান ‘এ’ দলের হয়ে স্মিথকে পাঠানো হলো ইংল্যান্ডে। সেখানকার সেঞ্চুরি দেখে অধিনায়ক মাইকেল ক্লার্ক নিজে দলে ডেকে নিলেন। গত অ্যাশেজে তাঁর অদ্ভুত স্টাইলে ব্যাটিং বা বাজে বোলিংয়ে হেসে খুন হয়েছিলেন ইংলিশ পণ্ডিতেরা, সেটাই ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন স্মিথ। ইংলিশ বোলারদের একহাত দেখিয়ে তুলে নিলেন ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি। ৫ ম্যাচে ৩৮ গড়ে রান করলেন ৩৪৫। স্মিথের পুরোনো ক্যারিয়ার আর নিন্দুককে বুড়ো আঙুল দেখানোর সূচনা সেখান থেকেই।

স্টিভ স্মিথ ও ড্যানি উইলিস।

এরপর থেকে পুরো গল্পটা স্মিথের উত্থানের। দলে একের পর এক সেঞ্চুরি করে জায়গা করে নিয়েছেন। মাইকেল ক্লার্কের অনুপস্থিতিতে তুলে নিয়েছেন অধিনায়কের আর্মব্যান্ড। নেতৃত্ব পেয়েই ভাঙচুর শুরু করলেন রেকর্ডবুকে। স্যার ডন ব্রাডম্যানের ভারতের বিপক্ষে এক সিরিজে করা সর্বোচ্চ ৭১৫ রানের রেকর্ড ভেঙে করলেন ৭৬৯ রান! গড় ছিল ১২৮!

স্মিথের ক্যারিয়ারে রূপকথার মতো উত্থানের পাশাপাশি পতন এসেছে, ‘স্যান্ডপেপার গেট’–কাণ্ডে নিষিদ্ধ হয়েছেন এক বছর। হারিয়েছেন ক্যাপ্টেন্সি। নাক উঁচু অস্ট্রেলিয়ান দলে আর কখনো হয়তো অধিনায়কত্ব পাবেনও না। কিন্তু একবার যে নায়ক পাহাড় চড়ে রাজকন্যার হাত ধরার মন্ত্র জেনে ফেলে, সে রাজপুত্রের আর হারিয়ে যাওয়ার ভয় নেই। সেই রাজপুত্র হারিয়ে যায়ও না। স্টিভ স্মিথ-ড্যানি উইলিস যেন রূপকথা থেকে তুলে আনা কোনো গল্প।