শেষ টার্ন

শেন ওয়ার্ন আর নেই—কথাটা শুনে বিশ্বাসই হচ্ছিল না। আঙুলের তুড়িতে যিনি সারা বিশ্বের তাবৎ ব্যাটসম্যানকে নাচিয়েছেন, মাঠছাড়া করেছেন, তিনি এভাবে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন? এই তো কয়েক দিন আগে তাঁর ডকুমেন্টারি সিরিজ বের হলো। তিন দিন আগেও তিনি ইংল্যান্ডের কোচ হতে চাইলেন, ১২ ঘণ্টা আগে অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি রড মার্শের মৃত্যুতে টুইট করলেন। আর এরই মধ্যে হঠাৎ খবর এল ওয়ার্নি আর নেই। পুরো বিশ্বের প্রত্যেক ব্যাটসম্যানের হৃদয়ে কাঁপন ধরিয়েছেন যিনি, তাঁর হৃদয়টা এভাবে হুট করে থেমে যাবে, কেউ ভেবেছিল?

অবশ্য শেন কিথ ওয়ার্ন বরাবরই এমনটাই ছিলেন। তাঁর মতিগতি ধরতে পারা বড্ড কঠিন। সেটা মাঠের ভেতরেই হোক কিংবা বাইরে, আজীবনই বৈচিত্র্যময় এক চরিত্র তিনি। ‘বল অব দ্য সেঞ্চুরি’র কথাই ধরো। আগের বছরই ‘ব্যাগি গ্রিন’ ক্যাপে অভিষেক হয়েছে তাঁর। অ্যাশেজ খেলতে নেমেছেন প্রথমবারের মতো। ক্রিজের ওপাশে অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান মাইক গ্যাটিং। ২৩ বছর বয়সী সোনালি চুলের ওয়ার্ন ধীরলয়ে এলেন, আলতো করে ছাড়লেন বলটা। পড়ল লেগ স্টাম্পের খানিকটা বাইরে। লেগ স্টাম্পে গার্ড নেওয়া গ্যাটিং খেলতে চাইলেন প্রপার ডিফেন্সিভ শট। এরপর কী হলো কে জানে, বলটাকে দেখা গেল গড়িয়ে চলে যাচ্ছে সীমানার দিকে। আর যাওয়ার আগে উড়িয়ে গিয়েছে গ্যাটিংয়ের অফ স্টাম্প!

তৎক্ষণাৎ গ্যাটিং, আম্পায়ার কিংবা উইকেটের পেছনে থাকা ইয়ান হিলি, কেউই বোঝেননি কী হলো। ওয়ার্ন তখন নিজের প্রথম অ্যাশেজ উইকেট পাওয়ার আনন্দে উদ্বেল। লর্ডসের বিশাল স্ক্রিনে দেখা মিলল ওয়ার্ন-জাদুর। ঘূর্ণি স্পিনের মোহ, সৌন্দর্য যে এতটা সুন্দর করে কেউ ফোটাতে পারে, সেটা হয়তো সেদিনের সেই বল না দেখে থাকলে কেউ বুঝতেই পারত না। ২৩ বছর বয়সী ওয়ার্ন সেদিন ৪৫ ডিগ্রিতে বল ঘুরিয়েছিলেন প্রায় ২ ফুট! ওয়ার্ন যেন সেদিন ওয়ার্নিং দিয়েছিলেন সবাইকে, তিনি আসছেন!

ওয়ার্ন আজীবন উড়ে বেড়িয়েছেন, আদেশ-উপদেশ কোনোটাই তিনি গায়ে লাগাননি। নইলে কি আর ২১ বছর বয়সে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট একাডেমি থেকে বের করে দেওয়া হয় তাঁকে? ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরুর আগেই তিনি নাম করেছিলেন ‘ব্যাড বয়’ হিসেবে। এরপরও অস্ট্রেলিয়া দলে ঢুকেছেন নিজের যোগ্যতাবলে। ঢুকেও যে ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছেন, তা নয়। অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের সেরা কোচ জন বুকানন কিংবা অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ, কারও সঙ্গেই তাঁর সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না। খেলোয়াড়ি জীবনে তর্কাতর্কিতে জড়িয়েছেন, কোচের আদেশ-উপদেশ কোনোটাই গায়ে লাগাননি। তবু তাঁদের যদি একজন স্পিনার বেছে নিতে বলা হয়, তবে চোখ বন্ধ করে সেটা হবেন ওয়ার্ন।

অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি স্পিনার শেন ওয়ার্ন
ছবি: টুইটার

২০০৫ অ্যাশেজ, ইংল্যান্ড দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে প্র্যাকটিস মাঠে আগমন ঘটল একটা মেশিনের। মেশিনের নাম ‘মার্লিন’। ব্রিটিশ লিজেন্ড কিং আর্থারের সভাসদ ছিলেন মার্লিন। আর তাঁর নামেই নামকরণ করা হয়েছে এই যন্ত্রের। যন্ত্রের কাজটা অবশ্য বেশ সোজা, এটা একটা বোলিং মেশিন। তবে যে-সে বোলিং মেশিন নয়; বরং বিজ্ঞানী হেনরি প্রায়োরের ১৫ বছর দীর্ঘ সাধনার ফসল এই বোলিং মেশিন। এই মেশিন শেন ওয়ার্নে পারদর্শী। প্রতি অ্যাশেজে ইংলিশ ব্যাটসম্যানদের নাকানি-চুবানি খাওয়ানো ওয়ার্নের প্রতিটি বল, প্রতিটি টার্ন জানে এই মেশিন। গত ১২ বছরে ওয়ার্নের করা প্রতিটি বলকে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করা আছে এই যন্ত্রের ভেতর। ১৯৯৩ সালের পর আবারও ‘বল অফ দ্য সেঞ্চুরি’র মুখোমুখি হলেন মার্ক গ্যাটিং। সেটাকে লোকজনের সামনে ফ্রন্টফুট ডিফেন্স করে বুঝিয়ে দিলেন এই মেশিনের কার্যকারিতা। ইংলিশ ব্যাটসম্যানদের ওয়ার্ন-ভীতি কমানোর জন্য এর চেয়ে ভালো কিছু ছিলই না। রাজকীয় বেশে সেই অভিনব যন্ত্র দিয়ে চলল ইংল্যান্ডের ব্যাটিং অনুশীলন।

অ্যাশেজ শুরু হলো, বল হাতে পপিং ক্রিজের সামনে এলেন স্পিন-জাদুকর। ৫ ম্যাচ শেষে ইংল্যান্ডের মোট উইকেট পড়েছিল ৯৩টি। ১৯.৯২ বোলিং গড়ে তার ৪০টিই তুলে নিলেন শেন ওয়ার্ন। হলেন ম্যান অব দ্য সিরিজ। সে রেকর্ড এখনো অক্ষত! ওয়ার্নকে বোঝা যে অসাধ্য এক ব্যাপার, তার প্রমাণ যেন আরেকবার দিলেন তিনি নিজেই।

শেন ওয়ার্ন নিজের জীবনটা কাটিয়েছেন রাজার বেশে। না কাউকে তোয়াক্কা করেছেন, না কারও বাধায় বাধাপ্রাপ্ত হয়েছেন। নানা বিতর্কে থেমে গেছে তাঁর ওয়ানডে ক্যারিয়ার। তা নিয়ে আফসোস করেননি ওয়ার্ন। কারণ, এত কিছু না পেয়েও সবটা পাওয়া হয়েছে তাঁর। টেস্টে ৭০৮ উইকেট, বিশ্বকাপ সেমি, ফাইনাল দুটিতেই ম্যান অব দ্য ম্যাচ। হয়েছেন লেগ স্পিনের অবিসংবাদিত রাজা। লেগ স্পিনের অপর নাম তিনি। মাঠের ভেতরে কিংবা বাইরে, কোনো জায়গাতেই জীবনকে অপূর্ণ রাখেননি, বিস্মিত করতে বাকি রাখেননি কাউকে। ৫২ বছর বয়সে তাই তাঁর জীবনাবসানও হয়ে রইল সবার কাছে এক অবিশ্বাস্য টার্ন। জীবনের মতো মৃত্যুতেও তিনি হয়ে রইলেন দুর্বোধ্য।