শ্রেষ্ঠত্বের রথবদল ইউরোপিয়ান ফুটবলে

পর্দা নামল ইউরোপের শীর্ষ ঘরোয়া লিগগুলোর। ঘটেছে সিংহাসনের পালাবদল। চিরচেনা চ্যাম্পিয়নদের হটিয়ে ইতালি, স্পেন, ফ্রান্সের লিগ শিরোপা জিতেছে ইন্টার মিলান, আতলেতিকো মাদ্রিদ, লিলে। পরিবর্তন এসেছে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগেও, লিভারপুলকে হটিয়ে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পুনরুদ্ধার করেছে ম্যানচেস্টার সিটি। এমনকি স্কটল্যান্ড ও পর্তুগালেও দীর্ঘ সময় পর চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ পেয়েছে যথাক্রমে রেঞ্জার্স ও স্পোর্টিং সিপি। কেবল পরিবর্তন আসেনি জার্মানিতে। বায়ার্ন মিউনিখের দাপট রুখতে পারেনি ডর্টমুন্ড, লাইপজিগ, লেভারকুসেন দলগুলো।
সিরি আ জেতার উচ্ছ্বাস ইন্টার মিলান শিবিরে।

শুরুটা করা যাক ইতালি থেকে।

ইতালিয়ান সিরি ‘আ’ চ্যাম্পিয়ন ও জুভেন্টাস যেন এত দিন একে অন্যের প্রতিশব্দ হয়ে ছিল। একচ্ছত্র দাপটে টানা ৯ মৌসুম শিরোপা জিতলে এমনটাই তো হওয়ার কথা। দোর্দণ্ড সেই জুভেন্টাস এবার সিরি ‘আ’ শেষ করল টেবিলের ৪ নম্বরে থেকে। তাহলে চ্যাম্পিয়ন কে? একসময়ের প্রতাপশালী ইন্টার মিলান। ইউরোপ তো বটেই, মিলান শহরের দুই ক্লাব ইন্টার মিলান ও এসি মিলানের খ্যাতি জগৎজোড়া। আর্থিক ক্ষতি ও বেশ কিছু বড় খেলোয়াড়দের হারিয়ে দল দুটি কয়েক বছর ধরেই ধুঁকছিল। তারই সুযোগে জুভেন্টাস জিতেছে টানা ৯ মৌসুমের শিরোপা। তবে এবারের গল্প ভিন্ন। মিলান শহরের দুটি ক্লাবই শুরু থেকে খেলেছে দুর্দান্ত ফুটবল। তবে ইন্টার মিলান ছিল অদম্য। তারই পুরস্কার লিগ শেষ হওয়ার আগে শিরোপা নিশ্চিত হয়ে যাওয়া।

৩৮ ম্যাচে ২৮ জয়, ৭ ড্রর বিপরীতে মাত্র ৩টি হারে ইন্টার মিলানের সংগ্রহ ৯১ পয়েন্ট। লিগের রানার্সআপ হওয়া এসি মিলানের সংগ্রহ ৭৯ পয়েন্ট। বোঝাই যাচ্ছে, হারানো জৌলুশ ফিরে পেয়ে নেরাজ্জুরিরা (ইন্টার মিলানের ডাকনাম) লিগে একচ্ছত্র দাপট দেখিয়ে শিরোপা জিতেছে। অন্যদিকে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর জুভেন্টাস এবার শুরু থেকে মলিন ছিল। শেষ ম্যাচে নাপোলির বদান্যতায় তারা লিগে চতুর্থ স্থান পেয়েছে। নয়তো সামনের বার তারা উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগে জায়গা পেত না। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যার হাত ধরে জুভেন্টাসের লিগ শিরোপা জেতার দাপট শুরু হয়েছিল, সেই অ্যান্তনিও কন্তের হাত ধরে তাদের আধিপত্য ভেঙে ১১ বছর পর নিজেদের শিরোপা জিতেছে ইন্টার মিলান। সিরি ‘আ’তে তৃতীয় স্থান পাওয়া দলটি নতুন ইতালিয়ান শক্তি আতালান্তা।

ইন্টারের মতো দাপুটে শিরোপা জেতা হয়নি আতলেতিকো মাদ্রিদের। তবে সাত বছর পর স্প্যানিশ লা লিগায় রিয়াল-বার্সার দৌরাত্ম্য ভেঙেছে তারা। দিয়েগো সিমিওনের অধীনে থাকা আতলেতিকো মাদ্রিদ তাদের নগর প্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদের সঙ্গে প্রায় সেয়ানে সেয়ান লড়াই করে শিরোপা জিতেছে। শেষ দিনেও নাটকীয় পরিস্থিতি পার করে লুইস সুয়ারেজের গোলে শ্রেষ্ঠত্ব নিশ্চিত করে আতলেতিকো।

৩৮ ম্যাচে ৮৬ পয়েন্ট নিয়ে লিগ টেবিলের প্রথম হয়েছে তারা। মাত্র ২ পয়েন্টে পিছিয়ে থেকে দ্বিতীয় হয়েছে জিনেদিন জিদানের শিষ্যরা। অন্যদিকে বার্সেলোনা শিরোপা–দৌড় থেকে ছিটকে পড়ে শেষ ম্যাচের আগেই। ৭৯ ও ৭৭ পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয় ও চতুর্থ স্থান নিশ্চিত করেছে বার্সেলোনা ও সেভিয়া।

রূপকথার মতো ফ্রান্সের সেরা এখন লিলে।

ফ্রান্সের চিত্রটি বেশ ভিন্ন। সেখানে রূপকথার মতো লিগ শিরোপা নিশ্চিত করেছে লিলে। প্যারিস সেন্ট জার্মেইয়ের মতো তারকা ঠাসা দলকে পেছনে ফেলে লিগ শিরোপা জেতা যেন রোমাঞ্চকর এক গল্প। কেবল পিএসজি নয়, শক্তিমত্তায় এগিয়ে ছিল মোনাকো, অলিম্পিক লিঁওর মতো দলগুলো। ২০১৭ সালেও রেলিগেশনের হুমকিতে পড়া লিলের ঘুরে দাঁড়ানো প্রশংসা কুড়াচ্ছে ভক্ত-সমালোচক সবার থেকে। সেই সঙ্গে পিএসজির অস্বাভাবিক শক্তির কারণে একপেশে হয়ে যাওয়া ফ্রেঞ্চ লিগে লিলের জয় প্রমাণ করল, লিগ জিততে হতে হয় লম্বা দৌড়ের ঘোড়া। উল্লেখ্য, ১০ বছর পর লিগ শিরোপা ধরা দিয়েছে তাদের হাতে।

৮৩ পয়েন্ট নিয়ে শিরোপা জেতা লিলে থেকে এক পয়েন্টে পিছিয়ে দ্বিতীয় হয়েছে নেইমার-এমবাপ্পের পিএসজি। লিগ ওয়ানের তৃতীয় ও চতুর্থ স্থান দুটি যথাক্রমে মোনাকো ও অলিম্পিক লিঁওর।

ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে নিজের শেষ লিগে শিরোপা হাতে সের্হিও আগুয়েরো।

ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে গত পাঁচ বছরে তৃতীয় শিরোপা জিতল ম্যানচেস্টার সিটি। শেষ দিকে হেসেখেলে লিগ নিশ্চিত করলেও গার্দিওলার শিষ্যদের শুরুটা ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। ডিসেম্বর মাসেও টেবিলের আট নম্বরে ছিল তারা। তবে ধারাবাহিকভাবে পারফরম্যান্সে উন্নতি আনার পুরস্কার পেয়েছে তিন ম্যাচ বাকি থাকতেই। ক্লাবের কিংবদন্তি সের্হিও কুন আগুয়েরোর বিদায়বেলায় এর চেয়ে বড় উপহার আর কীই–বা হতে পারে!

ম্যানচেস্টার সিটির ৮৬ পয়েন্টের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সংগ্রহ ৭৪ পয়েন্ট। লিভারপুল ও চেলসি যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ স্থান দখল করে আগামী মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ নিশ্চিত করেছে।

টানা নবম শিরোপা, তাই টি-শার্টেও ‘৯’ লিখে উদ্‌যাপন বায়ার্নের খেলোয়াড়দের।

ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগের মধ্যে কেবল জার্মানিতেই আসেনি রথবদল। টানা নবম বুন্দেসলিগা জিতেছে জার্মান পাওয়ার হাউস বায়ার্ন মিউনিখ। গত মৌসুমের ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নরা ঘরোয়াতেও একই রকম দাপুটে। লেভানডফস্কি-মুলারদের নিয়ে গড়া হ্যান্স ফ্লিকের দলকে কোনো রকম প্রতিদ্বন্দ্বিতাই করতে হয়নি। লাইপজিগ আর ডর্টমুন্ডের ক্রমাগত পয়েন্ট হারানো বরং বাভারিয়ানদের লড়াইয়ের রাস্তা সহজ করেছে। তাই ১৩ পয়েন্টের ব্যবধান নিয়ে চ্যাম্পিয়ন বায়ার্নের জন্য বুন্দেসলিগা যেন হয়ে উঠেছে হাতের মোয়া। তাদের জয়রথ কেউ থামাতে পারে কি না, সে জন্য চোখ রাখতে হবে সামনের মৌসুমে।

১৯ বছরের অপেক্ষার অবসান, তাই স্পোর্টিং সিপি খেলোয়াড়দের উচ্ছ্বাস যেন আকাশছোঁয়া।

শীর্ষ পাঁচ লিগের বাইরে রথবদল এসেছে পর্তুগালেও। ১৯ বছর পর পোর্তো ও বেনফিকার যুগলবন্দী দাপট ভেঙেছে স্পোর্টিং সিপি। পর্তুগালের সেরা তিন ক্লাবের তালিকা করলে স্পোর্টিংয়ের নাম সব সময়ই আসে, কিন্তু লিগ জেতার ক্ষেত্রে তারা যেন কিছুতেই সাফল্য ছুঁতে পারছিল না। অবশেষে তরুণ কোচ রুবেন আমোরিম মুছলেন সেই দুর্ভাগ্য। তাঁর প্রধান অস্ত্র ছিলেন তরুণ পর্তুগিজ স্ট্রাইকার পেদ্রো গনসালভেস। স্পোর্টিংয়ের ৮৫ পয়েন্টের বিপরীতে রানার্সআপ পোর্তোর সংগ্রহ ৮০ পয়েন্ট।

অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন স্টিভেন জেরার্ডের রেঞ্জার্স ফুটবল ক্লাব।

নজর কেড়েছে স্কটল্যান্ডের লিগ জেতা রেঞ্জার্সও। সেল্টিকের ৯ বছরের দাপট ভেঙে ১০ বছর পর শিরোপা জিতল তারা। এই যাত্রায় এক অনন্য কৃতিত্বও গড়েছে স্কটিশ ক্লাবটি, এবারের লিগে একবারের জন্যও হারেনি তারা। আর এতে একই সঙ্গে নিজের ক্যারিয়ারের প্রথম লিগ শিরোপা জিতলেন দলটির কোচ লিভারপুল কিংবদন্তি স্টিভেন জেরার্ড।