সময় এখন ব্যাডমিন্টনের

সূর্যটা চলে গেছে দক্ষিণে। শীতল বাতাস আসছে উত্তর থেকে। ঝুপ করেই নেমে আসছে সন্ধ্যা। শরীরে ভারী জামাকাপড়। রান্নাঘরে চলছে পিঠাপুলির আয়োজন। বাড়ির পাশে এক চিলতে ফাঁকা জমিতে জমেছে ব্যাডমিন্টনের আসর। বাংলাদেশের শীত মানেই তো এই।

শীতের বিকেলে কিংবা রাতে বন্ধুবান্ধব, ভাইবোনের সঙ্গে কখনো ব্যাডমিন্টন খেলেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। তেমনি এমন কোনো গ্রাম কিংবা শহুরে মহল্লা খুঁজে পাওয়া কঠিন, যেখানে কোনো ব্যাডমিন্টন কোর্ট নেই। ফুটবল-ক্রিকেটের মতো হয়তো নয় কিন্তু অল্প জায়গায়, স্বল্প খরচে খেলা যায় বলে ব্যাডমিন্টনের জনপ্রিয়তাও এ দেশে কম নয়। নাইবা থাকল জাল, দরকার তো দুটি র‌্যাকেট, একটি শাটলকক (সেটা হতে পারে প্লাস্টিকেরও)। এই তো হয়ে গেল একটু গা গরম করার ব্যবস্থা।

তবে গা গরম করতে যাওয়ার আগে খেলাটির নিয়মকানুনও একটু জানা থাকা ভালো। পুনা না হয়ে খেলাটি কীভাবে ব্যাডমিন্টন হলো জেনে বন্ধুদের কাছে গল্পও করতে পারো। এরপর খেলতে খেলতে মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে শাটলককটা কোন জাদুমন্ত্রে বারবার দিক বদলে ফেলে। কিংবা এরপর মনে হতে পারে ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় হিসেবে কীভাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া যাবে সেটাও।

পুনা হলো ব্যাডমিন্টন

ইতিহাসটাই জানা যাক আগে। আধুনিক ব্যাডমিন্টনের বয়স বেশি হয়নি, মাত্রই শ দেড়েক। তবে ব্যাডমিন্টনের মতো খেলা হাজার বছর আগে থেকেই প্রচলিত ছিল পৃথিবীতে। পঞ্চম শতাব্দীতে চীনের লোকজন ‘তি জিয়ান জি’ বা শাটলে লাথি মারা নামে একটি খেলা খেলত। উদ্দেশ্য একই ছিল, শাটলকে মাটিতে পড়তে না দেওয়া। এর ৫০০ বছর পরেও চীন, জাপান, ভারত ও গ্রিসে ব্যাটলডোর (ব্যাট) ও শাটলকক খেলার কথা জানা যায়। ষোড়শ শতকে ইংল্যান্ডে বাচ্চাদের মাঝে বেশ জনপ্রিয়তা পায় খেলাটি।

অলিম্পিকের অন্যতম জনপ্রিয় খেলা ব্যাডমিন্টন
ছবি: রয়টার্স

তবে আধুনিক ব্যাডমিন্টন কিন্তু এই ভারতীয় উপমহাদেশেরই খেলা। ১৮৬০ সালের দিকে পুনা নামের একটি খেলা প্রচলিত ছিল ভারতে। মহারাষ্ট্রের পুনে অঞ্চলে উৎপত্তি বলেই এই পুনা নাম। ব্যাটলডোর ও শাটলককের মতো হলেও পুনাতে বাড়তি হিসেবে ছিল জাল বা নেটের ব্যবহার। ব্যবসা করতে এসে উপমহাদেশ দখল করে নেওয়া ইংরেজরা প্রেমে পড়ে যায় পুনার। কিছু ইংরেজ সেনা কর্মকর্তাই দেশে ফিরে যাওয়ার সময় সঙ্গে করে নিয়ে যান এই খেলাটিকেও।

১৮৭৩ সালে ইংল্যান্ডের গ্লস্টারশায়ারের ব্যাডমিন্টনে নিজের জমিদারিতে ডিউক অব বিউফোর্ট এক পার্টিতে পুনা খেলার আয়োজন করেন। খেলাটি ব্রিটেনের অভিজাত সমাজে এতটাই জনপ্রিয়তা পায় যে ‘দ্য ব্যাডমিন্টন গেম’ নামে বিভিন্ন জায়গায় প্রচলিত হয়ে যায়। এরপর ১৮৭৭ সালে বাথ ব্যাডমিন্টন ক্লাব প্রতিষ্ঠা পায়। ১৮৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্যাডমিন্টন অ্যাসোসিয়েশন, খেলাটির নিয়মকানুন বেঁধে দেয় এরাই। ১৯৩৪ সালে গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক ব্যাডমিন্টন ফেডারেশন (আইবিএফ)। এর পর থেকেই টমাস কাপ (পুরুষ) ও উবার কাপের (মেয়ে) মতো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়ে আসছে। ব্যাডমিন্টন অলিম্পিকে প্রবেশাধিকার পেয়েছে ১৯৯২ সালে।

শাটলককের জাদু

শাটলককটি কীভাবে দিক পরিবর্তন করে? কেন সব সময় নিচের ভারী কর্কটাই আগে নিচে পড়ে? জানতে হলে বুঝতে হবে বিজ্ঞান। বুঝতে হবে বায়ুগতিবিদ্যা। শাটলককের প্রায় পুরো ওজনটাই থাকে নিচের সরু অংশে। এ ছাড়া পালকের চেয়ে ওই অংশ বাতাসে কম বাধা পেয়েই এগিয়ে যেতে পারে। তাই যখনই শাটলকককে আঘাত করা হোক না কেন সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য মুহূর্তেই দিক পরিবর্তন করে সরু অংশটি সামনে এগিয়ে যায়। এরপর বাতাসের সঙ্গে সংঘর্ষে গতিজড়তাটা যখন কমে যায়, তখন প্রায় খাড়াভাবেই শাটলটা নিচে নেমে আসে। যেহেতু সরু অংশটাই বেশি ভারী, তাই ওই অংশটাই থাকে নিচের দিকে।

মজার ব্যাপার আরও আছে। ক্রিকেট বা টেনিস বলকে যত জোরে আঘাত করা হবে, সেই অনুপাতেই দূরে যাবে। কিন্তু শাটলকে যত জোরেই মারা হোক না কেন, নির্দিষ্ট একটা দূরত্বের বেশি যাবে না। এ ছাড়া শাটলটা সর্বোচ্চ উচ্চতায় উঠতে যতটা পথ পাড়ি দেবে, নিচে নামবে তার চেয়ে অনেক খাড়াভাবে।

ব্যাডমিন্টন খেলার নিয়মকানুন

কোর্ট | ব্যাডমিন্টন খেলার জন্য দরকার ৪৪ ফুট দৈর্ঘ্যের আয়তাকার একটি কোর্ট। প্রস্থটা নির্ভর করে একক কিংবা দ্বৈত খেলার ওপরে। একক ম্যাচে প্রস্থটা ১৭ ফুট হলেও দ্বৈতে প্রয়োজন ২০ ফুট চওড়া কোর্ট। নেট বা জালটা হতে হবে মাটি থেকে ৫ ফুট ১ ইঞ্চি উঁচু।

শাটল (কর্ক) | শাটলটি প্রাকৃতিক কিংবা কৃত্রিম দুই ধরনের উপাদান দিয়েই তৈরি হতে পারে। প্রাকৃতিক শাটলে ভিত্তির সঙ্গে ১৬টি পালক যুক্ত থাকে। শাটলটি ৬ থেকে ৭ সেন্টিমিটার লম্বা হবে। ওজন থাকবে ৪.৭৪ থেকে ৫.৫০ গ্রামের মধ্যে।

র‌্যাকেট | র‌্যাকেটের নির্দিষ্ট কোনো মাপ না থাকলেও ৬৮ সেন্টিমিটার বা ২৬.৮ ইঞ্চির বেশি লম্বা ও পাশে ২৩ সেন্টিমিটার বা ৯ ইঞ্চির বেশি হতে পারবে না। জালে বোনা অংশটি লম্বায় ২৮ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারবে।

স্কোর | আমাদের দেশে পাড়া-মহল্লায় ১৫ পয়েন্টের গেম হলেও আন্তর্জাতিকভাবে খেলা হয় ২১ পয়েন্টের গেম। র্যালিতে জিতলে পাওয়া যাবে ১ পয়েন্ট করে। দুই পক্ষেও পয়েন্টই যদি ২০ হয়ে যায়, তবে যে প্রতিদ্বন্দ্ব্বী আগে ২ পয়েন্টে এগিয়ে যাবে, সেই গেমটা জিতবে। তবে গেম যাতে অনন্তকাল ধরে না চলে, সে জন্য দুদলের পয়েন্ট সমান ২৯ হলেও যে আগে ৩০ পয়েন্ট পাবে, সে-ই জিতবে। এভাবে যারা আগে দুটি গেম জিতবে, তারাই ম্যাচ জিতে নেবে।

সার্ভিস | এককে সার্ভিসকারীর পয়েন্ট শূন্য বা জোড়সংখ্যক হলে ডান পাশ থেকে ও বিজোড় হলে বাঁ পাশ থেকে সার্ভ করতে হবে। সার্ভিসকারী ও প্রতিপক্ষ কোনাকুনি দাঁড়াবে। সার্ভিসের সময় দুই পায়েরই কিছু অংশ মাটিতে রাখতে হবে।

দ্বৈত খেলার সময় ডান দিকের খেলোয়াড় কোনাকুনিভাবে বিপক্ষের কোর্টে সার্ভিস করবে। যাকে সার্ভিস করা হবে, সেই শুধু গ্রহণ করতে পারবে।

টুকরা কিছু তথ্য

  • জনপ্রিয়তায় বিশ্বে ফুটবলের পরেই অবস্থান ব্যাডমিন্টনের।

  • সবচেয়ে দ্রুতগতির র‌্যাকেট স্পোর্ট হলো ব্যাডমিন্টন।

  • আন্তর্জাতিক ব্যাডমিন্টনের শতকরা ৭০ ভাগ শিরোপাই গেছে চীন ও ইন্দোনেশিয়ায়।

  • সবচেয়ে ভালো শাটলকক তৈরি হয় হাঁসের পালক থেকে।

  • বিশ্বের সবচেয়ে বড় শাটলককটি আছে যুক্তরাষ্ট্রের কানসাস সিটি মিউজিয়ামে। সত্যিকারের শাটলের চেয়ে ৪৮ গুণ বড় শাটলটি ১৮ ফুট লম্বা ও ওজনে ২ হাজার ৫০০ কেজি।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় শাটলকক

বাংলাদেশে ব্যাডমিন্টন

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তেমন সুবিধা না করতে পারলেও বাংলাদেশ ব্যাডমিন্টন ফেডারেশন নিয়মিতই জাতীয়, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ও লিগের আয়োজন করে থাকে। নভেম্বরে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ জাতীয় প্রতিযোগিতায় পুরুষ এককে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন আয়মান ইবনে জামান, মহিলা এককে এলিনা। দুজনেই প্রথমবারের মতো জিতেছেন জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ।

বাংলাদেশে ব্যাডমিন্টন খেলে জাতীয় পুরস্কার জেতা খেলোয়াড়ের সংখ্যাও কম নয়। সৈয়দা মরিয়ম তারেক, কামরুন নাহার ডানা, মনোয়ার আলম বাবুল, কিসমাতুল হাকিম, গোলাম আজিজ জিলানি ও শেখ আবুল হাসেমরা স্বীকৃতি পেয়েছেন জাতীয় পর্যায়েই।

ব্যাডমিন্টন খেলার সুযোগ

ফেডারেশনের পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন ক্লাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে। সবচেয়ে ভালো প্রশিক্ষণ সুবিধা আছে নিট কনসার্ন ক্লাবে। ক্লাবটি অবশ্য ঢাকায় নয়, নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত।

আন্তর্জাতিক ব্যাডমিন্টন

ফুটবল-ক্রিকেটের মতো ব্যাডমিন্টনের প্রসারটা ইংল্যান্ডে হলেও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশটির সাফল্য খুবই কম। এখানে রাজত্ব চীন, ইন্দোনেশিয়ারই। ১৯৭৭ সালে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ শুরু হওয়ার পর একক, দ্বৈত ও মিশ্র দ্বৈত মিলিয়ে চীনারা জিতেছে ৫৮টি সোনা। ইন্দোনেশিয়া জিতেছে ২০টি। এ ছাড়া ডেনমার্ক ও দক্ষিণ কোরিয়া পেয়েছে ১০টি করে সোনা। ২০১৪ সালে ডেনমার্কে হওয়া সর্বশেষ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জিতেছেন চীনের চেন লং। মেয়েদের বিভাগে চ্যাম্পিয়ন স্পেনের ক্যারোলিনা মারিন। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে সবচেয়ে বেশি ৫টি সোনা জিতেছেন চীনের লিন ড্যান।

চীনাদের জয়জয়কার অলিম্পিকেও। ১৬টি সোনা জিতেছে চীন, কাছাকাছি থাকা দক্ষিণ কোরিয়া ও ইন্দোনেশিয়া জিতেছে ৬টি করে সোনা।

অলিম্পিক ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের বাইরে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট হলো অল ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়নশিপ। সেই ১৮৯৯ সাল থেকে নিয়মিত হয়ে আসছে টুর্নামেন্টটি।