সাদা-কালো বোর্ডের রঙিন পরম্পরা

তাহসিন তাজওয়ার জিয়া
তাহসিন তাজওয়ার জিয়া

বসার ঘরের শোকেসে থরে থরে সাজানো ট্রফি আর পদক। কোনোটা ঘরোয়া টুর্নামেন্টে জেতা। কোনোটা আবার আন্তর্জাতিকে। বয়স মাত্র ১৩ বছর। এই বয়সেই তাহসিন তাজওয়ার জিয়া দেখে ফেলেছে দাবার ‘অন্য ভুবন’।
দেশের আর আট-দশজন কিশোর দাবাড়ু যখন গ্যারি কাসপারভ, ম্যাগনাস কার্লসেন, বিশ্বনাথন আনন্দের মতো হওয়ার স্বপ্ন দেখে তাহসিন তখন এদের সঙ্গে গল্প করে, বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের হাত থেকে নেয় উপহার আর অটোগ্রাফ।
এমনটা শুনে অবাক হওয়ার কিছু নেই। দাবার বিশ্বতারকাদের সঙ্গে তাহসিনের যোগাযোগের পেছনের কারিগর বাবা জিয়াউর রহমান। দেশের পাঁচ গ্র্যান্ডমাস্টারের অন্যতম জিয়ার একমাত্র ছেলে তাহসিন দেশে-বিদেশে এখন সমানে খেলে বেড়াচ্ছে। কখনো প্রতিপক্ষ হিসেবে পেয়ে যাচ্ছে বাবাকেও।
রোহান গাভাস্কার পারেননি বাবা সুনীল গাভাস্কারকে ছাড়িয়ে যেতে। শচীন টেন্ডুলকারের ছেলে অর্জুন পারবে কি না সেটা সময়ই বলে দেবে। এগুলো তো ক্রিকেটের গল্প। দাবাপরম্পরার উজ্জ্বল গল্প লিখতে এখনই যেন তাহসিন হয়ে আছে উন্মুখ।

বাবার সঙ্গে দাবার লড়াইয়ে তাহসিন
বাবার সঙ্গে দাবার লড়াইয়ে তাহসিন

খেলার সুবাদেই বাবার সঙ্গে দেশ–বিদেেশ ঘোরে সেই ছোটবেলা থেকে। এরই মধ্যে স্পেন, ইংল্যান্ড, মালয়েশিয়া, জিব্রাল্টার, ভারতের বিভিন্ন টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছে। মজার ব্যাপার হলো তাহসিনের দাবায় অভিষেক হয়েছে বিদেশে! মালয়েশিয়ার একটি দাবা একাডেমিতে তখন কোচ হিসেবে ছিলেন জিয়া। ওই একাডেমির ছাত্রদের সঙ্গে খেলতে খেলতেই দাবার প্রতি আগ্রহ জন্মে তাহসিনের। উচ্চতা এত কম ছিল যে দাবার বোর্ডের ওপর বসেই চাল দিতে হতো তাকে। ওই বয়সেই অনুশীলনে হারিয়ে দিত বড়দের! ছেলের প্রতিভা বাবার নজর এড়ায়নি। ছেলেকে পরখ করতেই নামিয়ে দেন মালয়েশিয়ান ওপেনের জুনিয়র ক্যাটাগরিতে। এবং ২০১০ সালে মালয়েশিয়া ওপেনে অনূর্ধ্ব-১২ ক্যাটাগরিতে র‌্যাপিড দাবায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে তাক লাগিয়ে দেয় সবাইকে। এরপর একে একে জিতেছে মোহামেডান স্কুল দাবায়, শেখ রাসেল স্মৃতি দাবা টুর্নামেন্ট, স্পেনের ভেনাস ওপেন, ভুবনেশ্বরে কিডস ইন্টারন্যাশনাল ওপেন, মুম্বাই ওপেনে। মুম্বাই ওপেন জিতে বিশ্বনাথন আনন্দের হাত থেকে সার্টিফিকেটের পাশাপাশি নিয়েছে ৫০ হাজার ভারতীয় রুপির প্রাইজমানি।
তাহসিনদের পরিবার দাবাময়। বাবা জিয়াউর রহমান তো রয়েছেনই, দাদা পয়গাম উদ্দিন আহমেদও আশির দশকে জাতীয় দাবায় খেলতেন। মা তাসমিন সুলতানাও দাবাড়ু। মায়ের রয়েছে দাবার একটি ক্লাব—গোল্ডেন স্পোর্টিং নামে। আসলে তাহসিনের রক্তেই লেগে রয়েছে দাবা খেলার নেশা। ছোটবেলায় দাদা একটা হাতির দাতের দাবার বোর্ড উপহার দিয়েছিলেন নাতিকে। সেই বোর্ড নিয়েই দাদা-নাতির দিনমান কাটত। কখনো দাদার সঙ্গে জিততে পারত না তাহসিন। এটা দেখে দাদি বলতেন, ‘তুমি কেন ওর সঙ্গে ইচ্ছা করে হলেও একবার হারো না?’ উত্তরে দাদা বলতেন, ‘ও হারতে হারতেই একদিন খেলাটা শিখবে।’

বিশ্বনাথন আনন্দের সঙ্গে তাহসিন
বিশ্বনাথন আনন্দের সঙ্গে তাহসিন

এখন শুধু খেলাই শেখেনি, হারিয়ে দেয় বড় বড় দাবাড়ুকে। এরই মধ্যে জাতীয় দাবার বাছাইয়ে হারিয়েছে আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টার রানী হামিদকে। এ বছরের প্রিমিয়ার লিগে হারিয়েছে জাতীয় দাবাড়ু মাহফুজুর রহমান ইমনকে। বাবার মুখোমুখিও হয়েছিল এবারের প্রিমিয়ার লিগে। যদিও বাবার সঙ্গে ড্র করেই সন্তুষ্ট থাকে তাহসিন। বাবার তো শুরুতে ইচ্ছাই ছিল না ছেলের সঙ্গে খেলার! মোহাম্মদপুরে নিজের ফ্ল্যাটে বসে সেই মজার গল্পটা বলছিলেন লিগ চ্যাম্পিয়ন সাইফ স্পোর্টিং দলের সদস্য জিয়া, ‘আমি তখনো জানতাম না সেদিন আমাদের খেলা পড়বে কার সঙ্গে। রাজীবকে (গ্র্যান্ডমাস্টার এনামুল হোসেন) জিজ্ঞাসা করতেই বলল, রাকিব (গ্র্যান্ডমাস্টার আবদুল্লাহ আল রাকিব) ভাই অসুস্থ। আজ খেলতে পারবে না। বাছাইয়ের নিয়ম অনুসারে বাধ্য হয়েই ওর সঙ্গে খেলতে হলো আমাকে। ও সেদিন দুর্দান্ত খেলেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ড্র করে।’ বাবা-ছেলের রসায়নটা এখন এমন জমেছে যে বাড়িতে বসেও জমে ওঠে খেলা, ‘আসলে ইদানীং ও আমাকে বাড়িতে প্র্যাকটিস গেমেও হারিয়ে দেয়। ওর সঙ্গে খেলতে ভয়ই লাগে (হা হা হা)।
তাহসিনকে নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখেন বাবা জিয়াউর রহমান, ‘ফেডারেশনের ওই সময়ের সাংগঠনিক কার্যক্রমের কারণে ওর বয়সে আমি যদিও এগিয়ে ছিলাম। কিন্তু ওর ভাগ্য ভালো একজন গ্র্যান্ডমাস্টারের কোচিং পাচ্ছে। যেটা অন্য বাচ্চারা পাচ্ছে না। আমার দাবার জ্ঞানের পরিধিও অনেক কম ছিল। কিন্তু আমি যে ভুলগুলো করেছি, সেটা ওকে করতে দেব না। ওকে আমি সুপার গ্র্যান্ডমাস্টার হিসেবে দেখতে চাই।’
কিন্তু সেই পথ পাড়ি দিতে হলে অনেক দূর যেতে হবে তাহসিনকে। শুরুতে ফিদে মাস্টার, এরপর আন্তর্জাতিক মাস্টার (আইএম)। তারপর গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব। আপাতত বছর দুয়েকের মধ্যে তাহসিন আইএম হলেই খুশি বাবা, ‘আমি চাই, ও যেন দুই বছরে মধ্যে আইএম নর্ম পূরণ করতে পারে।’
তাহসিনের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা স্পনসর। এমনিতেই ঘরোয়া টুর্নামেন্ট খুব কম। দেশের বাইরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে খেললে রেটিং দ্রুত বাড়বে। কিন্তু নিজের খেলা নিয়েই যেখানে দুশ্চিন্তায় থাকেন জিয়া, ছেলের ব্যাপারটাও সেখানে ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন, ‘আমার কোনো চাকরি নেই। অন্য উপার্জনও নেই। শুধু দাবা খেলে সংসার চালানো কষ্ট। গত বছর মুম্বাই ওপেনে রানার্সআপ হয়ে ৪ লাখ টাকা পেয়েছিলাম। সেটা কাজে লেগেছে আমার। আসলে আমি প্রচণ্ড মনের জোরে খেলে বেড়াই। ছেলেকেও নিজের মতো করেই তৈরি করতে চাই।’

ম্যাগনাস কার্লসেনের সঙ্গে তাহসিন
ম্যাগনাস কার্লসেনের সঙ্গে তাহসিন

এই বয়সের কিশোরেরা যেখানে মুঠোফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটব, ট্যাবে গেমস আর ফেসবুক নিয়ে ব্যস্ত, সেখানে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম তাহসিন। মহাবিশ্ব এবং এর সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে এরই মধ্যে পড়ােশানা শুরু করে দিয়েছে। মা তাসমিন সুলতানা বলছিলেন, ‘কবে, কখন কোন নতুন গ্রহ আবিষ্কার হলো এসব জানার আগ্রহই থাকে ওর বেশি। এনসাইক্লোপিডিয়া কিনছে, সেগুলো নিয়ে সারাক্ষণ বসে থাকে।’ এর বাইরে তাহসিনের খেলার সঙ্গী এক্স বক্স।
গ্যারি কাসপারভের সঙ্গে একবার তাহসিনের দেখা হয়েছিল দাবা অলিম্পিয়াডে বাবার খেলার সুবাদে। কাসপারভ আদর করে কাছে ডেকে নিয়ে উপহার হিসেবে হাতে তুলে দেন, হাও লাইফ ইমিটেটস চেস বইটা।
জীবন আসলে সত্যি সত্যিই বদলে গেছে তাহসিনের। সেন্ট যোসেফ স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ঘুমাতে গেলেও এখন স্বপ্নে দাবা খেলে। এই সেন্ট যোসেফ স্কুল থেকেই উঠে এসেছিলেন দাবার তিন গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদ, রিফাত বিন সাত্তার ও জিয়াউর রহমান। কে জানে আরেকজন গ্র্যান্ডমাস্টার হয়তো এই স্কুল থেকেই জন্ম নেবে। সেই পাঠটা তো বাবার হাত থেকেই নিয়ে চলেছে তাহসিন।