সেই ছেলেটির ঘরে ফেরা

ছেলেটা একেবারেই লিকলিকে, অনায়াসেই তালপাতার সেপাই বলা যায়। বয়স ১৭ হয়ে গেছে কিন্তু সেই তুলনায় শরীরে মাংস লাগেনি তেমন। তবে বল পায়ে সে দুর্দান্ত, সবুজ মাঠে তাই তার দিকে আলাদা করে চোখ পড়বেই। মাদেইরার রাজপথে বল নিয়ে কারিকুরি করতে করতে তার বেড়ে ওঠা। তবে ফুটবলের টানে সে চলে এল পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে। মফস্বল থেকে লাজুক কিশোর বড় শহরে এলে যা হয়, ওই ছেলেরও লিসবনে মানিয়ে নিতে সময় লেগেছিল। কিন্তু স্পোর্টিং লিসবনে ধাতস্থ হওয়ার পর সে দেখাতে শুরু করল জাদু। তখনো তাকে ইউরোপের বড় মঞ্চ চেনে না সেভাবে। কিন্তু এর মধ্যেই এমন একটা ঘটনা ঘটল, যেটা তার জগৎটাই দিল বদলে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড হলো তার নতুন ঠিকানা, যেখানে তাকে চিনেছে বিশ্ব। যেখান থেকে তার পায়ে লুটিয়েছে সব অর্জন। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর ওল্ড ট্রাফোর্ডে আসার সেই গল্প আসলেই অদ্ভুত।

২০০৩ সালের কথা। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড একটা প্রীতি ম্যাচ খেলতে এল লিসবনে। সেই ম্যাচে ইউনাইটেড ৩-১ গোলে জিতলেও গ্যারি নেভিলদের প্রায় কাঁদিয়ে ফেলেছিলেন রোনালদো, ড্রিবলিং আর গতি দিয়ে মোটামুটি এক প্রান্তে একদম জেরবার করে ফেলছিলেন প্রতিপক্ষকে। ম্যান ইউনাইটেড কোচ স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন চুইংগাম চিবুতে চিবুতে দেখছিলেন ম্যাচটা। খেলা শেষে ইউনাইটেডের খেলোয়াড়েরা কোচকে গিয়ে বললেন, এই ছেলেকে দলে নেওয়া উচিত। ফার্গুসন অবশ্য তার আগেই মনস্থির করে ফেলেছিলেন, এই ছেলেকে তাঁর চাই। সে জন্য যত টাকা লাগে, খরচ করবেন। স্পোর্টিংও সুযোগ বুঝে বড় দাঁও মেরে দিল। ১৭ বছর বয়সে ১২ দশমিক ২৪ মিলিয়ন পাউন্ড দিয়ে ইউনাইটেড কিনে নিল তাঁকে, কোনো টিনএজার ফুটবলারের জন্য যা ছিল ব্রিটিশ ফুটবলে রেকর্ড। রোনালদো চেয়েছিলেন ২৮ নম্বর জার্সি, কিন্তু তাঁকে দেওয়া হলো বেস্ট, বেকহামদের আইকনিক ৭ নম্বর জার্সি। সেই থেকে শুরু ‘সিআরসেভেন’ যুগের, আর শুরু স্যার অ্যালেক্সের সঙ্গে ফুটবলের বাইরে অন্য এক শ্রদ্ধা-সম্মানের সম্পর্কের। যে সম্পর্কের জন্য বহু বছর পর আবার ফিরে এসেছেন ওল্ড ট্রাফোর্ডে।

প্রথম যখন রোনালদো ওল্ড ট্রাফোর্ডের ড্রেসিংরুমে ঢুকলেন, এর আগে সেই কক্ষে পর্তুগালের কোনো খেলোয়াড় কখনো ঢোকেননি। রোনালদো অবশ্য এক–আধটু ইংরেজি পারতেন। সেই ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কয়েক দিন পরেই বললেন, ‘আমি এখানে সবার সেরা হতে এসেছি। সে জন্য যেটা দরকার হবে, সেটা আমি করব।’ সতীর্থের কথা শুনে হেসেই দিলেন কুইন্টন ফরচুন। রায়ান গিগস মুচকি হেসে বলেছিলেন, এখানে বেশি কথা বললে ওস্তাদের বকুনি খেতে হবে। রোনালদোর ছেলেমানুষি আসলে তখনো কাটেনি।

রোনালদো চেয়েছিলেন ২৮ নম্বর জার্সি, কিন্তু তাঁকে দেওয়া হলো বেস্ট, বেকহামদের আইকনিক ৭ নম্বর জার্সি

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে আরেক ধরনের ‘কালচারাল শকও’ পেতে হলো তাঁকে। রংচঙে কাপড় পরার অভ্যাস ছিল রোনালদোর, পর্তুগালে সেটাই ছিল চল। ইংল্যান্ডেও সেটা করলেন, তা দেখে দারুণ মজা পেলেন বেকহামরা। রোনালদো যে নিজেকে আয়নায় দেখতে পছন্দ করেন, সেটাও জানতেন সবাই। ফরচুন মজা করে সতীর্থের লকার রুমে একটা আয়না রেখে দিয়েছিলেন। এর মধ্যে ‘চোর চোর খেলায়’ (ফুটবল অনুশীলনে যেটাকে বলা হয় রন্ডো) নাম পাকিয়ে ফেলেছেন রোনালদো। তখনো অবশ্য ইউনাইটেডে তাঁকে প্রতিভাবান কিন্তু অধারাবাহিক একজন উইঙ্গার হিসেবেই দেখা হতো। গোল করা শুরু থেকেই শিখতে পারেননি, গোল করিয়েছেনই বেশি। প্রথম দুই মৌসুম কাটল এভাবেই। আস্তে আস্তে খেলা শিখলেন কিন্তু মাঝেমধ্যে ভুলে যেতেন খেলাটা যে দলের। এ রকম একটা ম্যাচে ৪-০ গোলে এগিয়ে থাকার পর কারিকুরি করতে গিয়ে পঞ্চম গোলটা মিস করলেন রোনালদো। খেলার সময়ই নেভিল বলেছিলেন, ‘খেলা শেষে বুঝবে মজা, দেখো, ওস্তাদ কী করেন।’ ম্যাচ শেষে ফার্গুসনের কুখ্যাত বকুনি খেতে হয়েছিল রোনালদোকে, যে অভিজ্ঞতা হয়েছে ইউনাইটেডের কমবেশি সব ফুটবলারের।

স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের সঙ্গে দারুণ সখ্যতা রোনালদোর

ইউনাইটেডে রোনালদোর সময়টা শুরুতে ভালো কাটেনি। ২০০৬ বিশ্বকাপের সময় বড় একটা বিতর্কের মুখোমুখি হতে হয় তাঁকে। জার্মানির সেই বিশ্বকাপে পর্তুগাল কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি ইংল্যান্ডের, দুই ম্যানচেস্টার সতীর্থ রুনি আর রোনালদো প্রতিপক্ষ। রিকার্দো কারভালহোকে করা চ্যালেঞ্জের জন্য লাল কার্ড দেখতে হলো রুনিকে। রোনালদো রেফারির কাছে তুমুল আবেদন করেছিলেন লাল কার্ডের জন্য। এটুকুতেও সমস্যা ছিল না, রোনালদোকে এরপর টিভি ক্যামেরা খুঁজে নিল চোখ টিপ দিয়ে ইশারা দিচ্ছেন পর্তুগিজ বেঞ্চের দিকে। ব্যস, ব্রিটিশ মিডিয়ায় শুরু হয়ে গেল তোলপাড়—রোনালদো লাল কার্ডের জন্য রেফারিকে ইচ্ছা করে উসকে দিয়েছেন। ইংল্যান্ড বাদ হলো, আর পুরো ইংল্যান্ড যেন একসঙ্গে পারলে শূলে চড়ায় রোনালদোকে। প্রকাশ্যে সেই প্রথম বলেছিলেন, ম্যানচেস্টার ছাড়তে চান। তবে ফার্গুসন বুঝিয়েসুঝিয়ে রেখে দিয়েছিলেন ছাত্রকে। সেই মৌসুমেই প্রথমবারের মতো ক্লাবের হয়ে ২০টির বেশি গোল করলেন রোনালদো।

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের নতুন জার্সিতে রোনালদো

পরের মৌসুমে পোর্টসমাউথের সঙ্গে একটা ম্যাচে লাল কার্ড দেখলেন রোনালদো, তিন ম্যাচ নিষিদ্ধ হলেন। ওই সময়েই সহকারী কোচ রেনে মিউলেনস্টেনের সঙ্গে কয়েকটা সেশন বদলে দিল তাঁকে। মিউলেনস্টেন দেখেছিলেন, এই ছেলের মধ্যে অনেক বড় খেলোয়াড় হয়ে ওঠার সবকিছুই আছে। তবে কয়েকটা জিনিস নিয়ে কাজ করতে হবে তাঁকে। তিনি বলেছিলেন, ‘দেখো ক্রিস্টিয়ানো, তোমার মধ্যে উদ্যম আছে, চেষ্টা আছে, পরিশ্রম আছে। প্রতিভাও আছে। তবে টেকনিক বলে একটা জিনিস আছে, আরও বেশি গোল করতে চাইলে তোমাকে সেই জিনিস একটু বদলাতে হবে। বলের জন্য দাঁড়িয়ে থাকলে তুমি গোল পাবে না, তোমাকে বলের কাছে যেতে হবে। আর সব সময় তুমি দুর্দান্ত গোল করবে, এমন কোনো কথা নেই। টপ কর্নার সব সময় টার্গেট করতে পারবে না। মনে রাখবে, সুন্দর হোক আর অসুন্দর হোক, গোল গোলই। সেটা কীভাবে এল, সেটা বড় কথা নয়।’ মিউলেনস্টেন রোনালদোকে নিয়ে গোল করার জন্য আলাদা আলাদা ছক কেটে বুঝিয়ে দিলেন। আর সেইমতো চলতে থাকল একেকটি সেশন। টানা কয়েক দিন চলল এ রকম। জানুয়ারির মধ্যে যখন ২৭ গোল হয়ে গেল রোনালদোর, মিউলেনস্টেন আবার বসলেন তাঁকে নিয়ে, ‘শোনো, তুমি অনেক গোল করে ফেলেছ। এখন মনে মনে তুমি খুশি হয়ে যেতে পার, তবে সেটাই হবে তোমার ভুল। তুমি ঠিক করো, তুমি এখানে থামতে চাও, নাকি ওই চূড়ায় যেতে চাও। ওই পর্যায়ে যেতে হলে তোমাকে নিজের মানসিকতাও বদলাতে হবে।’ রোনালদো মনে রেখেছিলেন গুরুর কথা। রোনালদো ৪০ গোলের গণ্ডি ছাড়িয়ে গেলেন সেবার, প্রিমিয়ার লিগের সঙ্গে জিতলেন বৃষ্টিভেজা মস্কোতে চ্যাম্পিয়নস লিগও।

এরপর রোনালদো নতুন চ্যালেঞ্জের জন্য রিয়াল মাদ্রিদে গেছেন, যেখানে মেসির সঙ্গে তার দ্বৈরথটা হয়ে গেছে ফুটবল পুরাণের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর গল্পগুলোর একটি। রিয়ালে এসে জিতেছেন আরও অনেক কিছু, এরপর পাড়ি জমিয়েছেন জুভেন্টাসে। এর মধ্যে অনেকবার শোনা গিয়েছিল ইউনাইটেডে ফেরার গুঞ্জন, কিন্তু তা সত্যি হয়নি। তবে অনেকটা আচমকাই সেটা সত্যি হয়ে গেল ২০২১–এর আগস্টের এক বিকেলে। রোনালদো আবার পাড়ি জমালেন পুরোনো ক্লাবে, যেটিকে অনেকবারই বলেছেন তাঁর দ্বিতীয় ঘর। প্রথম অধ্যায়ে অসংখ্য স্মরণীয় মুহূর্তের জন্ম দিয়েছিলেন। এবার কি নতুন কোনো রূপকথা লিখতে পারবেন রোনালদো?