স্বপ্ন হলো সত্যি

‘পুরো সিরিজে একটা জয় হলেও সিরিজটি বাংলাদেশের জন্য সফল হবে।’

কথাটা সাকিব আল হাসানের। দক্ষিণ আফ্রিকার বিমান ধরার আগে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের এই অলরাউন্ডার এ কথাটা বলে গিয়েছিলেন। সাকিবের কথাটা এই লেখার শুরুতে নেতিবাচক শোনাতে পারে। কারণ, প্রোটিয়াদের তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে ২-১ ব্যবধানে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের সিরিজ জয়ের খবর এখন পুরোনো।

কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশ দলের ওয়ানডে সিরিজ-পূর্ব আবহ ছিল ভিন্ন। প্রোটিয়াদের আঙিনায় বাংলাদেশের অতীতের বিবর্ণ রেকর্ডগুলোই ছিল আলোচনায়। এর তিনবার দক্ষিণ আফ্রিকা সফর করে তিন সংস্করণে ১৯ ম্যাচ খেলে প্রতিটিতেই হেরেছে বাংলাদেশ। এবার একটি জয় নিয়ে ফিরতে পারলে খারাপ কী!

সেই কাঙ্ক্ষিত জয়ের দেখা প্রথম ম্যাচেই পেয়ে যায় বাংলাদেশ। সেটিও সাকিবের হাত ধরে, যাকে নিয়ে সিরিজ শুরুর আগে একের পর এক নাটক মঞ্চায়িত হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় খেলতে যাবেন কি যাবেন না, এ নিয়ে কত আলোচনা! শেষ পর্যন্ত সাকিব গেলেন। প্রথম দিন থেকেই দলের সঙ্গে অনুশীলন করলেন। এরপর নাম লেখালেন ইতিহাসে।

সেঞ্চুরিয়নে প্রথম ওয়ানডেতে বাংলাদেশ দল আগে ব্যাট করে ৩১৪ রান করে ৭ উইকেট হারিয়ে। সাকিব না থাকলে এই রানটা হয়তো ২৬০-২৭০–এর ঘরে এসে থামত। ম্যাচের ফলও হতে পারত ভিন্ন। কিন্তু তামিম ইকবাল ও লিটন দাসের গড়ে দেওয়া ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে সাকিব মাঝের ওভারে ব্যাটিং করলেন অবিশ্বাস্য দ্রুততায়। ওয়ানডে ক্রিকেটে যে সময়টা ব্যাটসম্যানরা দেখেশুনে খেলে থিতু হওয়ার চেষ্টা করে, সেই সময়টা সাকিব বেছে নেন আক্রমণের জন্য।

মাত্র ৬৪ বল খেলে ৭৭ রান করে সাকিব যখন আউট হন, তখন দক্ষিণ আফ্রিকার পরিকল্পনা যায় ভেস্তে। ৪৪ বল খেলে ৫০ রান করে ইয়াসির আলী ছিলেন সাকিব-ধ্বংসযজ্ঞের যোগ্য সঙ্গী। দুজনের পর বাকি কাজটা মাহমুদউল্লাহ, আফিফ হোসেন ও মেহেদী হাসান মিরাজের। বাংলাদেশও ৩১৪ রানের বিরাট পুঁজি পেয়ে হয়ে ওঠে আত্মবিশ্বাসী।

তাসকিন আহমেদ ও শরীফুল ইসলাম সেই আত্মবিশ্বাসের সলতেতে আগুন জ্বালান গতি দিয়ে। দুজন মিলে ৫ উইকেট নিয়ে ভেঙে দেন দক্ষিণ আফ্রিকার টপ অর্ডার। মিরাজ এসে বাকি কাজটা করেন ৪ উইকেট নিয়ে। বহু নায়কের অবদানে বাংলাদেশ পেয়ে যায় ৩৮ রানের অবিশ্বাস্য এক জয়, দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে প্রথম।

২০ বছর ধরে দক্ষিণ আফ্রিকা সফর করে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ পেল সিরিজের এগিয়ে থাকার স্বাদ। মধুর এই অভিজ্ঞতায় বড় ধাক্কা লাগে দ্বিতীয় ওয়ানডে ম্যাচে। জোহানেসবার্গে দ্বিতীয় ওয়ানডে ম্যাচে দেখা মেলে অন্য এক বাংলাদেশের। যে দলটা সেঞ্চুরিয়নে ৩১৪ রান করেছে, সেই দলই ৩৪ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে ধুঁকতে থাকে। আফিফ ও মিরাজের চেষ্টায় গভীর খাদ থেকে বাংলাদেশ কোনোরকমে ৯ উইকেটে ১৯৪ রান করে, যা ৭ উইকেট হারিয়ে খুব সহজেই তাড়া করে দক্ষিণ আফ্রিকা।

দুই ম্যাচ পর ওয়ানডে সিরিজ তখন ১-১–এ সমতায়। কিন্তু দ্বিতীয় ম্যাচে বড় হারের পর একটা চাপা আত্মবিশ্বাস লালন করছিল বাংলাদেশ দল। শুরুতে একটু ভালো ব্যাটিং হলেই হয়তো প্রথম ম্যাচের পুনরাবৃত্তি ঘটবে তৃতীয় ম্যাচের ভেন্যু সেঞ্চুরিয়নে। এবার অবশ্য গল্পটা পাল্টে দেয় টস। বিদেশের মাটিতে ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম আগে ব্যাট করতে পছন্দ করেন। কিন্তু সেদিন দক্ষিণ আফ্রিকা টসে জিতে ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নেয়।

যা–ই হোক, দিনটাকে বাংলাদেশের করে নিতে সবটুকু নিংড়ে দেওয়ার চেষ্টা করে ক্রিকেটাররা। কুইন্টন ডি কক, ইয়ানেমান মালান মিলে উদ্বোধনী জুটিতে ৪৬ রান করে চোখরাঙানি দিচ্ছিলেন বড় স্কোরের। পালাবদলের শুরুটা হয় মিরাজের হাত ধরে। ভয়ংকর ডি কককে আউট করে মাঠে উপস্থিত প্রবাসী বাংলাদেশিদের জাগিয়ে তোলেন। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে প্রথম ওয়ানডে সিরিজ জয়ের উদ্‌যাপন করেই ঘুমিয়েছেন বাংলাদেশি ক্রিকেটার, কোচ, সমর্থকেরা।

একে একে উইকেট নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে মাত্র ১৫৪ রানে অলআউট করে বাংলাদেশ। প্রথম ম্যাচের মতো তৃতীয় ম্যাচেও তাসকিন ছিলেন এককথায় দুর্দান্ত। আগুনে বোলিংয়ে ৩৫ রানে ৫ উইকেট নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা দলের ভিত্তি কাঁপিয়ে দেন।

বাকি কাজটা সারেন অধিনায়ক তামিম ও লিটন। ছোট্ট রান তাড়া করতে নেমে আগ্রাসী ব্যাটিং করেন দুজন। ১২৭ রানের উদ্বোধনী জুটি গড়ে দক্ষিণ আফ্রিকার চমক দেখানো ক্ষীণ আশাটুকুও পিষে ফেলেন। লিটন ৪৮ রান করে আউট হলেও তামিম অপরাজিত থাকেন ৮৭ রানের ঝলমলে ইনিংস খেলে। সিরিজের জয়সূচক রানটি অবশ্য এসেছে সাকিবের ব্যাট থেকে। কাগিসো রাবাদাকে প্রিয় স্কয়ার কাট করে বল বাউন্ডারির দড়িতে পাঠিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় সিরিজ জয়ের ঐতিহাসিক ছবির অংশ হয়ে যান। দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশের ওয়ানডে সিরিজ জয়—ভাবা যায়!

সেই জয়ের বিশ্বাস নিয়ে বাংলাদেশ দক্ষিণ আফ্রিকায় খেলবে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ। এই লেখা যখন পড়বে, তখন বাংলাদেশ দল থাকবে টেস্ট সিরিজের আবহে। যেখানে ওয়ানডে সিরিজ জয়ের সুন্দর ছবিটা থাকবে অটুট।