হারিয়ে যাওয়া ফুটবলাররা

কয়েকবছর আগের কথা, ফ্রেঞ্চ লিগে এমবাপ্পে, নেইমারদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গোল করছিলেন এমিলিয়ানো সালা। গোল্ডেন বুটের দৌড়ে পাল্লা দিয়েছিলেন লিওনেল মেসির সঙ্গেও। তা দেখেই দলে ভেড়াতে চেয়েছিল কার্ডিফ সিটি। গোলের লড়াইয়ে প্রতিপক্ষ করতে চেয়েছিলেন হ্যারি কেইন-সার্জিও আগুয়েরোকে। কিন্তু ফ্রান্স থেকে ছেড়ে আসা বিমান ইংল্যান্ড পৌঁছায়নি। ইংলিশ চ্যানেলে হারিয়ে গেছেন সালা, সঙ্গে লড়াইয়ের স্বপ্নগুলো। ইংলিশ চ্যানেলের ওপরে দুর্ঘটনা, উদ্ধার অভিযান থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল চার দিন পরেই। তাঁকে খুঁজে পেতে আকুল আবেদন ছিল খেলোয়াড় পরিবার—সবার। শেষ পর্যন্ত সবার অর্থায়নে আবারও শুরু হয়েছিল উদ্ধার অভিযান। দুই সপ্তাহের অপেক্ষার ফলটা মধুর হয়নি। ফুটবল পায়ে বিশ্ব কাঁপানোর কথা ছিল, সে হয়তো এখন স্বর্গলোকে।

ফুটবল খেলতে দেশ-মহাদেশ পাড়ি দেওয়া লাগে ফুটবলারদের। সেখানে দুর্ঘটনার সম্ভাবনাও প্রচুর। ফুটবল ইতিহাসের তেমনই কিছু মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে আজকের লেখা।

সুপারগা দুর্ঘটনা (১৯৪৯)

পর্তুগিজ ক্লাব বেনফিকার বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচ খেলে ফিরছিল ইতালির তুরিনো ফুটবল ক্লাব। বিমানবন্দরের পাশে সুপারগা পাহাড়ের কাছে এসে বাজে আবহাওয়ার মুখোমুখি হয় বিমান। দ্রুত অবতরণ করতে গিয়ে ধাক্কা খায় পাহাড়ের পাদদেশে ব্যাসিলিকা চার্চের দেয়ালে। নষ্ট রেডিওর জন্য যোগাযোগও করা যায়নি। ১৮ জন ফুটবলারসহ বিমানে থাকা ৩১ জনই মৃত্যুবরণ করেন দুর্ঘটনায়। ইতালিয়ান লিগে তখন ছিল তুরিনোর জয়জয়কার। টানা চারবারের লিগ চ্যাম্পিয়ন দল, এমনকি ১৮ জন ফুটবলারের মধ্যে ১০ জন ছিলেন ইতালির জাতীয় দলের নিয়মিত সদস্য! পরের বছরের বিশ্বকাপে প্রথম পর্বেই বিদায় নিতে হয় ইতালিকে।

বাসবি বেইবস (১৯৫৮)

রেডস্টার বেলগ্রেডের বিপক্ষে ইউরোপিয়ান কাপ (বর্তমান চ্যাম্পিয়নস লিগ) ম্যাচ খেলে দেশে ফিরছিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড দল। জ্বালানি নেওয়ার জন্য মিউনিখে যাত্রাবিরতি নেয় বিমান। বরফে ঢাকা মিউনিখ থেকে কোনোভাবেই টেক-অফ করতে পারছিলেন না পাইলট। দুবার চেষ্টার পরও যখন পাইলট টেক অফ করতে পারলেন না, তখন সিদ্ধান্ত হলো বিমান বাদে অন্য কিছুতে করে ইংল্যান্ড ফেরার। কিন্তু পরের দিন ম্যাচ থাকায় দেরি করতে চাননি খেলোয়াড়েরা। তাই পাইলটের কাছে অনুরোধ করলেন আরও একবার টেক অফের চেষ্টা করতে। জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল সিদ্ধান্তটা নিলেন ক্যাপ্টেন। তৃতীয়বার চেষ্টা করতেই রানওয়ে থেকে ছিটকে পাশে থাকা একটি বাড়িতে বিধ্বস্ত হয় বিমানটি। বাড়ির লোকজনের ভাগ্য ভালো হলেও ভালো ছিল না ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের খেলোয়াড়দের। আটজন ফুটবলারসহ ২০ জনের মৃত্যু হলো সঙ্গে সঙ্গে। সেই দুর্ঘটনা থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন কোচ ম্যাট বাসবি ও ববি চার্লটন, যাঁদের হাত ধরেই পরবর্তী সময়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। খেলোয়াড়দের স্মরণে এখনো ওল্ড ট্রাফোর্ডে একটি ঘড়ি থেমে আছে বেলা ৩টা ৪ মিনিটে। যার নিচে লেখা Feb 6th 1958 The Flowers of Manchester। গানে গানে ব্যাখ্যা করেছে তারা সেই ঘটনাকে,

A Broken Plane

A Broken Dream

A Broken Team

No Word Said, a Silent Bow

We Loved You Then, we Love You Now.

ড্যানিশ ফুটবল দুর্ঘটনা (১৯৬০)

রোম অলিম্পিকে ডেনমার্ক দলের ট্রায়াল দেওয়ার জন্য কোপেনহেগেন থেকে হার্নিস যাচ্ছিলেন আট ড্যানিশ ফুটবলার। খারাপ আবহাওয়ার কারণে চার্টার্ড বিমানের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সুইডেন-ডেনমার্কে বিধ্বস্ত হয় বিমানটি। আট ফুটবলারের সলিলসমাধি ঘটে সেখানে। এক পা হারিয়ে বেঁচে ছিলেন পাইলট! সে বিমানেই যাওয়ার কথা ছিল এরিক ডয়েরবর্গের। কাপড়ের বাক্স রাখার জায়গা করে দিতে সে বিমানে জায়গা হয়নি তাঁর। শেষ পর্যন্ত তাঁকে নিয়ে রোম অলিম্পিক ফুটবলে রুপা জিতেছিল ডেনমার্ক।

লা পাজ দুর্ঘটনা (১৯৬৯)

বলিভিয়ার সান্তা ক্রুজ ফুটবল দলের আমন্ত্রণে প্রীতি ম্যাচ খেলতে গিয়েছিল লা পাজের বিখ্যাত ক্লাব দ্য স্ট্রংগেস্ট। যেদিন ফেরার কথা, ঠিক সেদিনই সামরিক শাসন জারি হয় বলিভিয়ায়। দ্রুত দেশ ছাড়তে গিয়ে কম তেল নিয়েই যাত্রা করে দলটি। কিন্তু বলিভিয়ার মাউন্ট চতেঙ্গায় বিধ্বস্ত হয় পুরো দলসহ। সামরিক শাসন শুরু হওয়ায় খবরও পাওয়া যায়নি। তিন দিন পর যখন খোঁজ পাওয়া গেল, তখন পুরো স্ট্রংগেস্ট দলসহ ৭৮ জন যাত্রী আর ৯ জন ক্রুকে পাওয়া গেল মৃত।

পাখতার তাসকেন্ত ট্র্যাজেডি (১৯৭৯)

সোভিয়েত ইউনিয়নের ডায়নামো মিনস্কের বিপক্ষে খেলতে যাচ্ছিল উজবেক দল পাখতার তাসকেন্ত। আকাশে থাকা অবস্থাতেই মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় একই রুটে আসা আরেকটি বিমানের সঙ্গে। রেডিও সিগন্যালের গোলযোগে এয়ার ট্রাফিকের নির্দেশ বুঝতে ভুল করেছিলেন দুই পাইলট। ফলে দুই বিমান মিলিয়ে ১৭৮ জনের মৃত্যু হয় মধ্য আকাশেই।

আলিয়ানজা লিমা দুর্ঘটনা (১৯৮৯)

পেরুভিয়ান লিগের ম্যাচ খেলে নিজেদের এলাকায় ফিরছিলেন আলিয়ানজা লিমা ক্লাবের খেলোয়াড়েরা। বিমানবন্দরের কাছাকাছি এসে পাইলট টের পান যান্ত্রিক গোলযোগের। কন্ট্রোল টাওয়ারের কাছ থেকে পাওয়া ভুল নির্দেশনায় বিমান রানওয়েতে নামার বদলে ভূপাতিত হলো প্রশান্ত মহাসাগরে। খেলোয়াড়-কর্মকর্তাসহ ৪৩ জনের সলিলসমাধিও হয় সেখানেই।

কালারফুল ইলেভেন ট্র্যাজেডি (১৯৮৯)

দক্ষিণ আমেরিকার ছোট্ট দেশ সুরিনাম। সে দেশের কয়েকজন খেলোয়াড় মিলে গড়ে তুলেছিলেন ‘কালারফুল ইলেভেন’ দল। সেই দলের হয়ে প্রীতি ম্যাচ খেলতে আমস্টারডাম থেকে সুরিনামের প্যারামারিবোর পথ ধরেন সুরিনাম বংশোদ্ভূত ১৪ ডাচ ফুটবলার। বয়স্ক পাইলট ও খুবই নিচ দিয়ে বিমান চালনার কারণেই ঘটেছিল এ দুর্ঘটনা। যাতে শেষ হয়ে গিয়েছিল সুরিনামের জাতীয় দলের স্বপ্ন।

জাম্বিয়া দুর্ঘটনা (১৯৯৩)

বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব খেলতে জাম্বিয়া থেকে সেনেগাল যাচ্ছিল জাম্বিয়া ফুটবল দল। জাম্বিয়ান বিমানবাহিনী তাদের পাঁচ মাস অচল থাকা বিমান উপহার দেয় জাম্বিয়া দলকে। সেই বিমান গ্যাবনের রাজধানী লিব্রেভিলেতে যাত্রাবিরতি শেষে উড়াল দিতেই বিমানের ইঞ্জিনে আগুন ধরে যায়। তাড়াহুড়োতে ভুল করে পাইলট সচল ডান ইঞ্জিনটিও বন্ধ করে দেন। ফলে ৩০ আরোহী নিয়ে উপকূলের মাত্র ৫০০ মিটার দূরে আটলান্টিক মহাসাগরে বিধ্বস্ত হয় বিমানটি। মুহূর্তেই হারিয়ে গেল জাম্বিয়ার সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ফুটবল দল। সেদিন নেদারল্যান্ডস থেকে সরাসরি সেনেগাল যেতে চাওয়ায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন অধিনায়ক কালুশা বোয়ালিয়া।

শাপেকোয়েনস ট্র্যাজেডি (২০১৬)

কোপা সুদামেরিকানার ফাইনালে খেলতে যাচ্ছিল ব্রাজিলিয়ান দল শাপেকোয়েনস। কলম্বিয়ান ক্লাব অ্যাটলেটিকো ন্যাসিওনালের মাঠে খেলতে কলম্বিয়ার বিমান ধরেছিল তারা। কিন্তু সেই বিমান মাঠে পৌঁছায়নি। পথে যান্ত্রিক গোলযোগ ও তেল ফুরিয়ে যাওয়ায় ৮১ জন যাত্রীর মধ্যে ৭৫ জনই প্রাণ হারান সেখানে। তিন খেলোয়াড়কে ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করা হয়।

মৃত্যু অমোঘ সত্য, কিন্তু কিছু মৃত্যু ছুঁয়ে যায় সবাইকে। ফুটবল খেলতে গিয়ে যাত্রাপথে এমন মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার মতো না। তবু স্বপ্ন নিয়ে বিমানে চড়েন খেলোয়াড়েরা, যাতে থাকে জেতার স্বপ্ন। সেসব স্বপ্ন নিয়ে আর কেউ অকালে হারিয়ে না যাক, সেটাই সবার চাওয়া।