১১ মাঠে ২৪ দলের লড়াই

ইউরোর এই ট্রফির লড়াইয়ে মাঠে নামছে ২৪ দল

বিশ্বকাপের পর ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসর উয়েফা ইউরোপিয়ান ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ, যা ‘ইউরো’ নামে পরিচিত। মহাদেশীয় টুর্নামেন্ট হলেও কোপা আমেরিকা, আফ্রিকান নেশনস কাপ কিংবা এশিয়ান কাপের চেয়ে ঢের বড় পরিসরে আয়োজন এটি। স্পেন, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, ইংল্যান্ডের মতো বিশ্বকাপ জেতা দলগুলো শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে নামে একে অপরের বিরুদ্ধে। তাই ইউরোকে নিয়ে প্রত্যাশার পারদ বেশ চড়া। ১২ জুন বাংলাদেশ সময় রাত ১টায় ইতালি বনাম তুরস্কের ম্যাচ দিয়ে শুরু হবে ইউরো-২০২০। নাম দেখে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এবারের টুর্নামেন্টটি ২০২০ সালে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোভিড-১৯–এর মহামারিতে জীবনযাত্রা যেভাবে থমকে গিয়েছিল, তাতে বাধ্য হয়ে সূচি বদলে আনা হয় ২০২১ সালে। তবে নামের বদল ঘটেনি।

এবারের ইউরো আগেরগুলোর চেয়ে বেশ ব্যতিক্রমী। সাধারণত এসব বড় টুর্নামেন্ট একটি কিংবা বড়জোড় দুই-তিনটি দেশ মিলে আয়োজন করে থাকে। কিন্তু এবারের আসর বসছে এগারোটি দেশ মিলিয়ে। ইউরোপের এগারোটি দেশের প্রথিতযশা এগারোটি শহরে অনুষ্ঠিত হবে ম্যাচগুলো। ১৯৬০ সালে শুরু হওয়া এই টুর্নামেন্টটির ষাট বছর পূর্তি ছিল ২০২০ সালে। ষাট বছর পূর্তির এই আনন্দ আয়োজনকে ইউরোপের দেশগুলোতে ছড়িয়ে দিতেই একযোগে এগারোটি দেশে টুর্নামেন্টটি আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে উয়েফা। এ ছাড়া ইউরোপের দেশগুলোয় মহামারি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসায় অনেক দিন পর দর্শকেরাও ফিরছেন মাঠে। বিভিন্ন দেশের কোভিড পরিস্থিতি অনুযায়ী ধারণক্ষমতার ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত দর্শক থাকতে পারবেন স্টেডিয়ামে।

১৯৬০ সালে ইউরোপের মর্যাদাপূর্ণ এই টুর্নামেন্টটি শুরু করতে অবশ্য বেশ কাঠখড়ই পোড়াতে হয়েছিল তৎকালীন উয়েফা কমিটিকে। ১৯২৭ সালে প্রথম এই টুর্নামেন্টের আইডিয়া পেশ করেন তৎকালীন ফ্রেঞ্চ ফুটবলের সভাপতি হেনরি ডিলাউনি। কিন্তু ইউরোপের দেশগুলোতে তখন আজকের মতো সদ্ভাব ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তো পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। কেউ ত্যাগ করে জার্মানি–ইতালিকে, কেউ আবার নিজেদের মধ্যে জড়িয়ে পড়ে সংঘর্ষে। এত কিছুর পরে কষ্টেসৃষ্টে যে প্রথম আসরের আয়োজন হলো, সেখানে ইংল্যান্ড, ইতালি আর পশ্চিম জার্মানি অংশ নিতে আপত্তি জানায়। ওদিকে স্পেন কোয়ার্টার ফাইনাল খেলতে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে যেতে আপত্তি জানায়, ফলে ফ্রি-পাস পেয়ে সেমিফাইনালে উঠে যায় কিংবদন্তি গোলকিপার লেভ ইয়াসিনের দলটি। সেখানে চেকোস্লোভাকিয়াকে হারিয়ে ফাইনালের টানটান লড়াইয়ে ইয়াসিনের নৈপুণ্যে যুগোস্লোভিয়াকে ২-১ গোলে পরাজিত করে প্রথমবারের মতো ইউরোপ সেরার মুকুট মাথায় নেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন।

১৯৬০–এর প্রথম ইউরোতে সোভিয়েত ইউনিয়নের হয়ে লেভ ইয়াসিনের একটি মুহূর্ত

শুরুর দিকের আসরগুলোতে নানা রকম প্রতিবন্ধকতা তৈরি হলেও আস্তে আস্তে সেগুলো কাটিয়ে উঠতে পেরেছে উয়েফা। ইউরোপের লিগগুলো জনপ্রিয় ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ থাকায় ইউরোর জনপ্রিয়তাও বেড়ে যায় হু হু করে। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন অনেক ফুটবলভক্ত তো এ আসরকে বিশ্বকাপের চেয়েও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ মনে করেন। কেননা খেলার মানে অন্যান্য মহাদেশীয় দলগুলোর চেয়ে এগিয়ে থাকলেও বিশ্বকাপে নির্দিষ্টি কিছুসংখ্যক ইউরোপের দল সুযোগ পেয়ে থাকে। বৈশ্বিক ভারসাম্য রক্ষায় বিশাল শক্তির ইউরোপ আর লাতিন আমেরিকার দলগুলোর সঙ্গে অন্যান্য মহাদেশীয় দলের লড়াই একপেশেও হয় খানিকটা। কিন্তু ইউরোতে দলগুলো নিজেরাই নিজেদের মধ্যে খেলতে পারায় শক্তির পাল্লা তাই বেশ ভারসাম্যপূর্ণ থাকে। দর্শকের চোখে লড়াইও তাই যেন হয় সেয়ানে সেয়ানে।

ইউরো ২০২০–এর অফিশিয়াল বল হাতে মাসকট স্কিলজি

ইউরোর সবচেয়ে সফল দল স্পেন ও জার্মানি—৩ বার করে শিরোপা জিতেছে তারা। ফ্রান্স জিতেছে ২ বার। ইতালি, নেদারল্যান্ডস, গ্রিস, ডেনমার্ক, চেকোস্লোভাকিয়া, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পর্তুগাল জিতেছে একবার করে।

ইউরো ২০২০–এর মাসকট হিসেবে রয়েছে ‘স্কিলজি’। ফ্রি-স্টাইল ফুটবলার এবং স্ট্রিট ফুটবলারদের অনুপ্রেরণা থেকে তৈরি করা হয়েছে স্কিলজিকে। অ্যাডিডাসের ‘ইউনিফোরিয়া’ বলটি ব্যবহার করা হবে ম্যাচগুলোতে।

এবারের ষোড়শ ইউরোতে অংশ নিচ্ছে ২৪টি দল। ৬টি গ্রুপে ভাগ হয়ে একে অপরের সঙ্গে খেলবে গ্রুপ রাউন্ডের ম্যাচ। একনজরে গ্রুপগুলো দেখে নেওয়া যাক—

  • গ্রুপ এ: ইতালি | সুইজারল্যান্ড | তুরস্ক | ওয়েলস

  • গ্রুপ বি: বেলজিয়াম | ডেনমার্ক | ফিনল্যান্ড | রাশিয়া

  • গ্রুপ সি: নেদারল্যান্ডস | অস্ট্রিয়া | ইউক্রেন | নর্থ মেসিডোনিয়া

  • গ্রুপ ডি: ইংল্যান্ড | ক্রোয়েশিয়া | স্কটল্যান্ড | চেক রিপাবলিক

  • গ্রুপ ই: স্পেন | সুইডেন | পোল্যান্ড | স্লোভাকিয়া

  • গ্রুপ এফ: ফ্রান্স | পর্তুগাল | জার্মানি | হাঙ্গেরি

আগেই বলেছিলাম যে ইউরোপের এগারোটি দেশের এগারোটি শহরে বসছে আসরটি, যার মধ্যে নয়টি দেশ বাছাইপর্ব পেরিয়ে মূল আসরে খেলছে। তাই ইতালি, ডেনমার্ক, রাশিয়া, নেদারল্যান্ড, ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, স্পেন, জার্মানি, হাঙ্গেরি—এই ৯টি দেশ গ্রুপ রাউন্ডের ম্যাচগুলোয় পাচ্ছে স্বাগতিক হওয়ার সুবিধা। নিজেদের মাঠে নিজেদের দর্শকদের সঙ্গ নিঃসন্দেহে দলগুলোকে বাড়তি অনুপ্রেরণা দেবে। ৯টি দেশের বাইরে বাকি দুই স্বাগতিক দেশ হলো আজারবাইজান ও রোমানিয়া।

লন্ডনের বিখ্যাত এই ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হবে এবারের ইউরোর ফাইনাল

গ্রুপগুলোর মধ্যে এফ গ্রুপকে বলা হচ্ছে গ্রুপ অব ডেথ। সর্বশেষ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স, বর্তমান ইউরো চ্যাম্পিয়ন পর্তুগালের সঙ্গে রয়েছে পাওয়ার হাউস জার্মানি। হাঙ্গেরিও সর্বশেষ ইউরোতে দেখিয়েছে তাদের খেলার ধার। এই চার দলের মুখোমুখি লড়াই তাই গ্রুপ পর্বের রং বাড়িয়ে দিয়েছে অনেকখানি।

গ্রুপ পর্ব থেকে সেরা ষোলো দল উঠবে রাউন্ড অব সিক্সটিনে, নকআউট রাউন্ডের এই পর্ব থেকে আটটি দল যাবে কোয়ার্টার ফাইনালে। এরপর সেমিফাইনাল এবং ফাইনাল শেষে পাওয়া যাবে নতুন ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন। ফাইনাল অনুষ্ঠিত কবে ইংল্যান্ডের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে ১২ জুলাই, বাংলাদেশ সময় রাত ১টায়।

এই ছিল ইউরো ২০২০-এর প্রয়োজনীয় সব তথ্য। তাহলে এবার তুমিও শুরু করে দাও রোনালদো-এমবাপ্পে-লেভানডফস্কির মতো মহাতারকাদের মহারণ দেখার ক্ষণগণনা।