৬৪ খোপের জাদুকর!

নরওয়ের অসলো। স্থানীয় একটা দাবা ক্লাবে তখন সুনসান নীরবতা। ১০ জন দাবাড়ু একটা লম্বা টেবিলের একপাশে বসে। তাঁদের সামনে ১০টা দাবার বোর্ড। একেকজন বোর্ডে একটা চাল দিয়ে মুখে মুখে চাল বলছেন। আর টেবিলের ওই পাশে পেছন ফিরে বসা একটা বাচ্চা ছেলে মুখে মুখে চালের জবাব দিয়ে যাচ্ছে! ছেলেটা বোর্ডের দিকে তাকাতে পারবে না, এটাই হচ্ছে চ্যালেঞ্জ। এবং ওইভাবে না দেখে কেবল মুখে মুখে খেলেই ১০ জনকে পটাপট হারিয়েও দিল ছেলেটা! কাল্পনিক কোনো ঘটনা নয়, একেবারেই সত্যি কাহিনি! সেই বাচ্চা ছেলেটাই এখনকার দাবার চ্যাম্পিয়ন কার্লসেন ম্যাগনাস!

কার্লসেনের আগে ৪০ বছরের বেশির ভাগ সময় বিশ্ব কাঁপছিল তিন অমিত প্রতিভাধর দাবাড়ুর পদভারে। রাশিয়ার কারপভ, দ্য গ্রেট ক্যাসপারভ, ভারতের আনন্দ। কারপভ খেলেন পজিশনাল, আনন্দের শক্তি অতি দ্রুত নিখুঁত চালে। কিন্তু ক্যাসপারভ? বলা হয়ে থাকে দাবার ইতিহাসে ববি ফিশারের পর এমন অসাধারণ মানের খেলোয়াড় আসেননি! নির্মম আক্রমণকে কীভাবে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়, ক্যাসপারভের খেলা তার প্রমাণ। ক্যাসলিং করা রাজার সামনের বোড়ে ঠেলে যেভাবে তিনি তেড়েফুঁড়ে প্রতিপক্ষের দুর্গে ঢুকে পড়েন, চোখে না দেখলে বিশ্বাস হতে চায় না!

ভারতের বিশ্বনাথ আনন্দের সঙ্গে খেলায় মগ্ন কার্লসেন ম্যাগনাস (ডানে)

অনেকটা যেন যুদ্ধের মাঠে সবাই ব্যস্ত দেখে রাজামশাই তাঁর বডিগার্ডকে ডেকে বললেন, তোর আর কাজ কী...যা, ওদের রাজাটার লাশ ফেলে দিয়ে আয়। আমাকে নিয়ে চিন্তা করিস না, কেউ আমার কিছু করতে পারবে না!

এহেন ক্যাসপারভের সঙ্গে খেলতে বসলেন কার্লসেন ম্যাগনাস। পিচ্চির তখন ১৩ বছর বয়স! উপস্থিত দর্শকেরা কিছুক্ষণ পরই অবাক হয়ে দেখলেন, ক্যাসপারভের কপালে চিন্তার ভাঁজ। খুব ভেবেচিন্তে চাল দিচ্ছেন। একসময় ফলাফল এল, ড্র! কারপভের সঙ্গে খেলার ফলাফল আরও অভাবনীয়—হেরে বসে আছেন কারপভ!

ওই টুর্নামেন্টেই গ্র্যান্ডমাস্টার উপাধি পেলেন কার্লসেন। ১৩ বছর বয়সে! না না...ওটা সবচেয়ে কম বয়সে গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার রেকর্ড নয়। দুই বছর আগেই ওটা করে বসে আছেন ইউক্রেনের কারিয়াকিন। বর্তমানে কার্লসেনের চ্যালেঞ্জার!

দাবায় কার্লসেনের আগমন অনেকটাই ঝড়ের বেগে। মাত্র ১৩ বছর ১৪৮ দিনে হয়েছেন গ্র্যান্ডমাস্টার! ১৯ বছর ৩২ দিনে পৌঁছেছেন র্যাংকিংয়ের শীর্ষে! এত কম বয়সে তালগাছের মাথায় পৌঁছে যাওয়ার কাহিনি দাবার ইতিহাসেই নেই। দেখতেও সুদর্শন কার্লসেন। মডেলিংয়ে কেটে যায় বেশ কিছুটা সময়। হলিউড পরিচালক জেজে অ্যাব্রামসের স্টার ট্রেক ইনটু ডার্কনেস সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাবও পেয়েছিলেন। রাজিও হয়েছিলেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সরকার অনুমতি না দেওয়ায় কার্লসেনের আর অভিনয় করা হয়নি।

কিছুদিন আগ পর্যন্ত অসলোয় খেলতেন একটা ফুটবল ক্লাবের লেফটব্যাক হিসেবে। এর বাইরে যুক্ত ছিলেন একটা ব্যান্ড দলের সঙ্গেও। এত কিছুর সঙ্গে একজন চ্যাম্পিয়ন দাবাড়ুর যুক্ত থাকার কথা জীবনেও শোনেনি মানুষজন! চ্যাম্পিয়নও হয়েছেন বয়স ২৪ বছর ছোঁয়ার আগে। উদ্যাপনটাও ছিল অদ্ভুত। চ্যাম্পিয়ন হতেই সোজা সুইমিংপুলে ঝাঁপ!

২০১৩ সালের কথা সেটা। আনন্দ তখন টানা পঞ্চমবারের মতো দাবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। চ্যালেঞ্জার হিসেবে এলেন ম্যাগনাস। অনেকটা যেন উড়ে গেলেন আনন্দ! মুকুট উঠল ম্যাগনাসের মাথায়। অসহায় গলায় আনন্দ বললেন, ভুলটা যে কী করলাম সেটাই তো বুঝলাম না!!

২০১৪ সালে পরের চ্যাম্পিয়নশিপ লড়াইও ম্যাগনাস-আনন্দের। লড়াই হলো বেশ, কিন্তু ম্যাগনাসকে টলানো গেল না! প্রত্যেক সুপার গ্র্যান্ডমাস্টারের কিছু পছন্দের ওপেনিং থাকে, সেভাবেই তাঁরা খেলা শুরু করেন। কিন্তু ম্যাগনাসের নির্দিষ্ট কোনো ওপেনিং নেই! কোন দিন কীভাবে খেলা শুরু করবেন, একান্তই যেন তাঁর মর্জি! তাই ম্যাগনাসের বিরুদ্ধে প্রস্তুতি নেওয়াটাও কঠিন!

ছোটবেলা থেকেই কার্লসেনের নির্দিষ্ট কোনো ওপেনিং নেই

বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ আবার শুরু হয়েছে। কার্লসেন আর কারিয়াকিন, বিশ্বের সবচেয়ে অল্প বয়সে হওয়া গ্র্যান্ডমাস্টার! কারিয়াকিন ১ খেলায় জিতে এগিয়ে গিয়েছিলেন, কার্লসেন সর্বশেষটায় জিতে সমতা এনেছেন। ১০টা খেলা হয়ে গেছে। ১২টার মধ্যে নিষ্পত্তি না হলে টাইব্রেকারে যাবে।

শেষ পর্যন্ত বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের মুকুট কার মাথায় উঠছে সেটা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু বর্তমানের দাবায় যে কার্লসেনের যুগ শুরু হয়েছে এবং সেটা যে সহসাই ভাঙছে না, এ কথা বোধ হয় সাহসী হয়ে বলেই দেওয়া যায়!

(কিশোর আলোর ডিসেম্বর ২০১৬ সংখ্যায় প্রকাশিত)