৮ দিয়ে যায় চেনা

জার্সি নম্বর আধুনিক খেলাধুলার অবিচ্ছেদ্য এক অংশ। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে খেলোয়াড়দের সহজে চেনার উদ্দেশ্যে জার্সির পেছনে নম্বর বসানোর প্রচলন হয়। প্রথম দিকে ফুটবলে, এরপর আস্তে আস্তে প্রায় সব খেলাতেই প্রচলন ঘটে এর। প্রিয় খেলোয়াড়ের সঙ্গে তাঁর জার্সি নম্বরও তাই গেঁথে যায় ভক্তদের মনে। যাঁদের জন্য ভক্তদের কাছে ‘৮’ নম্বর জার্সি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে, আজকের লেখায় থাকছে তাঁদের কথা।

ফুটবলে ১০ নম্বর জার্সির মাহাত্ম্য কে না জানে! পেলে, ম্যারাডোনার জার্সির উত্তরসূরি কেউ হতে চাইলে অবশ্যই দলের সেরা খেলোয়াড় হতে হবে তাঁকে। ডেভিড বেকহাম কিংবা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর জন্য ৭ নম্বর জার্সি নিয়েও এখন চলে মাতামাতি। স্ট্রাইকারের ৯ নম্বর জার্সি তো চিরপরিচিত।

জন্টি রোডস

সে তুলনায় ৮ নম্বর জার্সি পরা খেলোয়াড়েরা সচরাচর আলোচনায় আসেন না। নিভৃত সৈনিকের মতো দলের জন্য অবদান রাখেন তাঁরা। তবে কেউ কেউ ঠিকই কেড়ে নেন ভক্তদের মন, কিংবদন্তি হয়ে চিরস্থায়ী জায়গা করে নেন ইতিহাসেও।

শুরুটা করা যাক স্টিভেন জেরার্ডকে নিয়ে। জেরার্ড মানেই লিভারপুল। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে তো বটেই, সর্বকালের সেরা মিডফিল্ডারদের তালিকাতেও আছে তাঁর নাম। খেলোয়াড়ি জীবনের প্রায় পুরোটাই কাটিয়েছেন লিভারপুলে। ক্লাবের একাডেমি থেকে উঠে এসে হয়েছেন দলের অপরিহার্য সদস্য। বড় বড় ক্লাবের ট্রান্সফার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে থেকে গেছেন লিভারপুলে, অধিনায়ক হিসেবে জয় করেছেন উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ। মাঝমাঠ থেকে বল পায়ে এগিয়ে এসে ডি-বক্সের বাইরে থেকে নেওয়া লং শটে গোল করায় জেরার্ডের সমতুল্য খুব কম খেলোয়াড়ই ছিলেন। ৮ নম্বর জার্সিকে ফুটবলে যাঁরা অনন্য করেছেন, জেরার্ড তাঁদের মধ্যে ওপরের দিকে। লিভারপুলের হয়ে ৫০৪ ম্যাচে ১২০টি গোল রয়েছে তাঁর। এখনো জেরার্ডের নাম শুনলে খানিকটা নস্টালজিক হয়ে পড়েন ফুটবলভক্তরা।

ডেল স্টেইন

জেরার্ডের মতোই ৮ নম্বর জার্সির আরেক কিংবদন্তি ইংলিশ খেলোয়াড় ফ্র্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ড। দুজনের খেলার ধরন প্রায় একই রকম ছিল। তবে জেরার্ডের তুলনায় কিছুটা আক্রমণাত্মক খেলতেন ল্যাম্পার্ড। ৬৪৭ ম্যাচে ১৯৩ গোল রয়েছে তাঁর। মিডফিল্ডের যেকোনো পজিশনেই খেলতে পারতেন তিনি। ডিফেন্সিভ দায়িত্ব থেকে শুরু করে প্লেমেকিং, এমনকি দলের প্রয়োজনে গোল করা—সবখানেই তাঁর সমান কর্তৃত্ব। ওয়েস্ট হামে খেলোয়াড়ি জীবন শুরু করলেও ক্যারিয়ারের স্বর্ণালি সময় পার করেছেন লন্ডনের ক্লাব চেলসিতে। জিতেছেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, চ্যাম্পিয়নস লিগসহ মর্যাদাপূর্ণ সব ট্রফি।

স্টুয়ার্ট ব্রড

এসি মিলানের জেনারো গাত্তুসোকে চেনেন না, এমন ফুটবলভক্ত খুঁজে পাওয়া কঠিন। খেলোয়াড়ি জীবনে তাঁর মতো চড়া মেজাজ, লড়াইপ্রবণ খেলোয়াড় খুব কমই ছিলেন। শক্তপোক্ত গড়নের এই মিডফিল্ডারের সামনে বল নিয়ে এলেই মারাত্মক কোনো ট্যাকলের মুখে পড়তে হতো প্রতিপক্ষকে। অবশ্য দলের প্রয়োজনে তাঁর এই ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করলে চলবে না। ২০০৭ সালে এসি মিলানের সর্বজয়ী একাদশ গড়তে অপরিহার্য ছিলেন তিনি। শুধু ক্লাবেই নয়, ইতালি জাতীয় দলেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। মিলানের হয়ে ইতালিয়ান লিগ, চ্যাম্পিয়নস লিগ, ক্লাব বিশ্বকাপ জেতার পর ইতালির হয়ে ২০০৬ বিশ্বকাপও জিতেছেন গাত্তুসো। আর দুর্দান্ত এসব অর্জনে তাঁর সঙ্গী ছিল ৮ নম্বর জার্সি।

নাগালের বাইরের বলকে ইগলের মতো উড়ে গিয়ে ধরা ডালভাত ছিল তাঁর জন্য। ফিল্ডিং যদি আর্ট হয়, রোডস ছিলেন তাঁর দা ভিঞ্চি। ব্যাটিংয়েও দলের হয়ে খেলেছেন গুরুত্বপূর্ণ সব ইনিংস।

গাত্তুসোর মতোই খেলোয়াড়ি জীবন অর্জনে পূর্ণ আরেক মিডফিল্ডার আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার। বার্সেলোনার হয়ে ক্যারিয়ারে ক্লাব পর্যায়ের প্রায় সবকিছুই জিতেছেন। স্প্যানিশ লিগ, কাপ, চ্যাম্পিয়নস লিগ, ক্লাব বিশ্বকাপ—সব মেডেলই আছে তাঁর পকেটে। স্পেনের স্বর্ণালি জাতীয় দলের হয়েও তাঁর সব জেতা। ইউরো, বিশ্বকাপ—দুটিতেই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে দলকে জেতাতে সাহায্য করেছেন। খেলে চলেছেন এখনো। ৮ নম্বর জার্সি পরে বার্সেলোনার পর জাপানের ভিসেল কোবের হয়ে এখনো মন্ত্রমুগ্ধ করছেন দর্শকদের। ছোট ছোট পায়ে প্রতিপক্ষের রক্ষণে ঢুকে ম্যাজিশিয়ানদের মতো ড্রিবলিং করে প্রতিপক্ষকে তাক লাগিয়ে দিতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। বিশ্বের সেরা মিডফিল্ডারদের তালিকা করতে বসলে ইনিয়েস্তা তাই ওপরের সারিতেই থাকবেন।

(বামে) স্টিভেন জেরার্ড ও (ডানে) ফ্র্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ড

৮ নম্বর জার্সি পরে এখনো খেলে চলা আরেক সর্বজয়ী মিডফিল্ডার রিয়াল মাদ্রিদের টনি ক্রুস। বায়ার্ন মিউনিখের পর রিয়াল মাদ্রিদের হয়েও সমান সফল এই জার্মান। জাতীয় দলে জিতেছেন বিশ্বকাপ। ক্লাবের হয়ে লিগ শিরোপা জেতার পাশাপাশি জিতেছেন চারটি চ্যাম্পিয়নস লিগ। গোল করার চেয়ে অবশ্য করানোতেই বেশি আগ্রহ ক্রুসের। লং বলে প্রতিপক্ষের রক্ষণকে এলোমেলো করে দিতে দক্ষ তিনি। সঙ্গে দলের প্রয়োজনে দূরপাল্লার শটে গোল করতে জানেন ভালোভাবেই।

এতক্ষণে ৮ নম্বর জার্সির ফুটবলারদের মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো মিল পেয়েছ? আসলে ফুটবলে জার্সির নম্বরের সঙ্গে পজিশনের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। নাম্বার এইটরা সাধারণত ডিফেন্স ও অ্যাটাকের মেলবন্ধন করে থাকেন। এ জন্য তাঁদের ডিফেন্সে যেমন পটু হতে হয়, প্লেমেকিং, এমনকি গোল করাতেও হতে হয় দক্ষ। মাঝমাঠের সুতা সাধারণত তাঁদের হাতে থাকে। দারুণ ট্যাকলে প্রতিপক্ষের পা থেকে বল কেড়ে নেওয়ার পর তাঁর দায়িত্ব থাকে দলের আক্রমণে নেতৃত্ব দেওয়া। তাই তাঁকে নিখুঁত পাসিং যেমন জানতে হয়, তেমনি থাকতে হয় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এবং মুহূর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার গুণ। সঙ্গে গোল করতে পারার ক্ষমতা এনে দেয় পূর্ণতা। দলের মধ্যে যাঁর ওপরে এসব দায়িত্ব থাকে, সাধারণত তাঁকেই দেওয়া হয় ৮ নম্বর জার্সি।

রবীন্দ্র জাদেজা

ফুটবলের জার্সিতে যেমন খেলোয়াড়ের খেলার ধরন বোঝা যায়, ক্রিকেটে আবার তেমনটা নয়। কিংবদন্তি ব্যাটসম্যানরা যেমন পরেছেন, তেমনি বোলাররাও পরেছেন ৮ নম্বর জার্সি। অলরাউন্ডার হিসেবে রবীন্দ্র জাদেজাও আছেন সেই তালিকায়।

ভারতের অলরাউন্ডার রবীন্দ্র জাদেজার অভিষেক হয় ২০০৯ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। দিনটিকে স্মরণে রেখেই তিনি বেছে নেন ৮ নম্বর জার্সিটি। এর পর থেকেই ভারতের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে উঠেছেন। বোলিংয়ে বাঁহাতি স্পিন, ব্যাটিংয়ে মারকুটে দর্শন আর বাজপাখির মতো ক্ষিপ্র ফিল্ডিং—সব মিলিয়ে জাদেজা এই মুহূর্তে বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৪৭৭৩ রান, ৪৫৪ উইকেট সেই সাক্ষ্যই দেয়।

ক্রিকেটের ৮ নম্বর জার্সির আরেক সেরা ফিল্ডার হচ্ছেন দক্ষিণ আফ্রিকার জন্টি রোডস। ফিল্ডিংয়ে তাঁর মতো দক্ষ ক্রিকেটার বিশ্ব খুব কমই দেখেছে। পয়েন্ট পজিশনে রোডস ছিলেন অনন্য। ব্যাটসম্যান শট খেলতে দেরি হতে পারে, কিন্তু রোডস তালুবন্দী করতে দেরি করতেন না। নাগালের বাইরের বলকে ইগলের মতো উড়ে গিয়ে ধরা ডালভাত ছিল তাঁর জন্য। ফিল্ডিং যদি আর্ট হয়, রোডস ছিলেন তাঁর দা ভিঞ্চি। ব্যাটিংয়েও দলের হয়ে খেলেছেন গুরুত্বপূর্ণ সব ইনিংস। তবে ফিল্ডিংকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্যই ক্রিকেট–বিশ্ব মনে রাখবে তাঁকে।

মুত্তিয়া মুরালিধরন

পাকিস্তানের ইনজামাম-উল-হকও খেলেছেন ৮ নম্বর জার্সি গায়ে। ব্যাটসম্যান হিসেবে দারুণ সব ইনিংস আছে তাঁর ঝুলিতে। বোলারের লাইন-লেংথ দ্রুত বুঝে উঠতে পারতেন তিনি, সঙ্গে ছিল দারুণ ফুটওয়ার্কও। ১৯৯২ সালে পাকিস্তানকে একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতাতে ইনজির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ব্যক্তিগত অর্জনেও খুব একটা পিছিয়ে নেই তিনি। ওয়ানডেতে দশ হাজারি ক্লাবের সদস্য এবং টেস্টে পাকিস্তানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ইনজামাম-উল-হক।

তবে ক্রিকেটে ৮ নম্বর জার্সির সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ড মুত্তিয়া মুরালিধরন। তর্ক সাপেক্ষে ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা স্পিনার তিনি। অনন্য সব অর্জন তাঁর ঝুলিতে। টেস্টে একমাত্র বোলার হিসেবে ৮০০ উইকেট, ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ ৫৩৪ উইকেট—এগুলো চোখ বুজেই তাঁর গ্রেটনেসের সাক্ষ্য দেয়। শ্রীলঙ্কার ক্যান্ডিতে জন্ম নেওয়া এই অফ স্পিনারকে খেলা যেকোনো ব্যাটসম্যানের জন্যই দুরূহ ছিল। বড় বাঁক নেওয়া অফ স্পিন, টপ স্পিন আর ব্যাটসম্যানকে নাকানিচুবানি খাওয়াতে মারণাস্ত্র দুসরা—মুরালির হাতে বৈচিত্র্যের অভাব ছিল না। ৮০০ টেস্ট উইকেটের যে উচ্চতায় তিনি চড়ে বসেছেন, সেই এভারেস্টে ওঠা কেউ কল্পনাতেও আনতে পারে না। সেই উচ্চতাকে মনে করিয়ে দিতে অবশ্য আইপিএলে ৮০০ নম্বর জার্সি নিয়ে খেলেছেন মুরালি, তবে কাকতালীয়ভাবে সেটিও ৮-এর গুণিতকই!

এ ছাড়া ৮ নম্বর জার্সি পরে আরও খেলেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার ডেল স্টেইন, ইংল্যান্ডের স্টুয়ার্ট ব্রডসহ অনেকেই।

কোবি ব্রায়ান্ট

ক্রিকেট-ফুটবলের বাইরে বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় খেলা বাস্কেটবল। কোবি ব্রায়ান্ট সেই বাস্কেটবলের একজন সুপারস্টার। লস অ্যাঞ্জেলেস লেকারসের হয়েই খেলেছেন পুরো ক্যারিয়ার। জিতেছেন পাঁচটি এনবিএ শিরোপা। বাস্কেটবলের সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়দের তালিকায় ওপরের দিকেই থাকবে তাঁর নাম। ৮ নম্বর জার্সির অ্যাম্বাসেডর হিসেবে তাঁর নামও আসে অ্যাথলেটদের মধ্যে। যদিও শেষ দিকে নিজের জার্সি বদলে ২৪ নম্বর নিয়ে খেলতেন ব্রায়ান্ট। ২০২০ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় এক মর্মান্তিক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তিনি। ব্রায়ান্টের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লস অ্যাঞ্জেলেস লেকারস অবসরে পাঠিয়েছে তাদের ৮ ও ২৪ নম্বর—দুটি জার্সিকেই। কিংবদন্তিদের মৃত্যু নেই, তাই ভক্তদের মনে চিরদিন ৮ ও ২৪ নম্বর জার্সি গায়েই বেঁচে থাকবেন কোবি ব্রায়ান্ট।