যে বই আমার অনুপ্রেরণা

বই পড়ার শুরুটা হয়েছে কমিকস দিয়ে। একদম ছোটবেলা প্রাণের বিল্লু, পিঙ্কি, চাচা চৌধুরী পড়ে কেটেছে। নারায়ণ দেবনাথের নন্টে ফন্টে, বাটুল দ্য গ্রেট কিংবা ব্যাটম্যান, ফ্যানটম, সুপারম্যান—সবই পড়তাম নিয়মিত। তবে কমিকসের জগৎটা পাল্টে গেল একটা অদ্ভুত চরিত্রে। আমার বড় বোন একদিন বিকেলে হার্জের টিনটিন নিয়ে এল। আমার এখনো মনে আছে, আমার জীবনের টিনটিন-এর প্রথম সিরিজ ছিল ‘পান্না কোথায়’। টিনটিনের প্রতি আমার ভালোবাসার সেই শুরু। আরেকটি কমিকস বই আমার সব সময় পছন্দ। সেটা অ্যাসটেরিক্স। ইউদেরজো আর গোসিনির এই কমিকস সিরিজটিও আমাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো আটকে রাখত। একটু বড় হয়ে প্রতি মাসে উন্মাদ পড়া শুরু করলাম। পরবর্তী সময়ে তো উন্মাদ-এ কার্টুন আঁকা শুরু করি এবং আমাদের বস, লেখক ও কার্টুনিস্ট আহসান হাবীবের সঙ্গে কাজ করার সৌভাগ্য হয়।

আমার জীবনে প্রথম পড়া সায়েন্স ফিকশন মুহম্মদ জাফর ইকবালের কপোট্রনিক সুখ-দুঃখ। তাঁর আমার বন্ধু রাশেদ এখনো আমার মনে গেঁথে আছে। আমার মনে আছে, একদিন বিকেলে বাসার সবাই কোথাও বেড়াতে যাচ্ছিল। আমাকেও ডাকছিল বারবার। কিন্তু আমার হাতে একটা বই ছিল, যেটা ছেড়ে আমি উঠতে পারিনি। বইটির নাম জারুল চৌধুরীর মানিকজোড়আমি তপু—আমাকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে। মুহম্মদ জাফর ইকবালের প্রায় সব বই আমার পড়া। অসাধারণ এক শৈশব উপহার দেওয়ার জন্য তাঁর কাছে আমি আজীবন কৃতজ্ঞ।

ক্লাস সিক্স-সেভেনে পড়ার সময় জন্মদিনে এক অসাধারণ উপহার নিয়ে এলেন আমার দুলাভাই—শঙ্কু সমগ্র। তারও আগে আমি সত্যজিৎ রায় শুরু করেছি। ‘ফেলুদা’ তখন আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। কিন্তু তাঁর ‘শঙ্কু’ যেন একটা নতুন দুয়ার খুলে দিল। ফ্যান্টাসির দুয়ার। আমি সব ভুলে শঙ্কু সমগ্রে ডুব দিলাম। দিন নেই, রাত নেই। আমার হাতে শঙ্কু। অদ্ভুত সব ঘোরলাগা মুহূর্ত। শঙ্কুর একটি গল্পের কথা আমার বলতেই হবে, যার নাম ‘একশৃঙ্গ অভিযান’। আমার কৈশোরে গল্পটির বেশ ভালো প্রভাব আছে।

প্রভাব ফেলেছে আনিসুল হকের মা উপন্যাসটিও। আমার ভেতরে এক অদ্ভুত হাহাকার সৃষ্টি করেছিল বইটি। তবে আমার জীবনে এক বিশাল অনুপ্রেরণা হুমায়ূন আহমেদ। তিনি আমাকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন। ভালোবাসতে শিখিয়েছেন। জীবনকে স্বাভাবিকভাবে দেখতে শিখিয়েছেন। জীবনে যেটাই হোক না কেন, ভালো কিংবা মন্দ, তা মেনে নিতে শিখিয়েছেন তাঁর লেখার মাধ্যমে।

হুমায়ূন আহমেদ তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে যে জীবনদর্শন ফুটিয়ে তুলেছেন, তা আমার গান লেখার ক্ষেত্রেও এক বিশাল অনুপ্রেরণা। তাঁর লেখা উপন্যাস লিলুয়া বাতাস-এর নামে আমি একটি গান লিখেছিলাম।

হিমু আর মিসির আলি যে অদ্ভুত এক জগতের দরজা আমাদের খুলে দিয়েছে, সেই জগতের একজন হয়ে বেঁচে থাকার এক অন্য রকম আনন্দ আছে। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, হিমু আর মিসির আলির মধ্য দিয়ে মায়া ও মায়াহীন জীবনদর্শন এবং যুক্তির সংমিশ্রণে তিনি যে ছক এঁকেছেন, জীবন তো আসলে সেই ছকে আঁকা পথেই হাঁটছে। তাই তো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে জীবনভর আমরা কেউ হিমু হতে চেয়েছি, কেউবা মিসির আলি। একজন লেখকের সৃষ্টি কী পরিমাণ শক্তিশালী হতে পারে!

হুমায়ূন আহমেদের সব বই আমার প্রিয়। তবে একটি বইয়ের নাম আমি বলতে চাই। উপন্যাসটির নাম জোছনা ও জননীর গল্প এই উপন্যাসের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসকে এক অন্য রকম অদ্ভুত লেখনীর মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন তিনি। এ দেশের মানুষ আজীবন আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে।