স্কুলজীবন

আমি শুনেছি, স্কুলজীবন অনেক মজার। এমন বেশ কিছু গল্পও পড়েছি, যেখানে স্কুলজীবন থাকে অনেক সুন্দর, আনন্দদায়ক। কিন্তু আমার স্কুলজীবন ছিল ঠিক তার বিপরীত। স্কুলজীবন...একটা দীর্ঘশ্বাস! স্কুলের প্রথম দিনটা ছিল খুবই সুন্দর। সব ঠিকঠাক ছিল। আমি আমার মায়ের হাত ধরে স্কুলে গিয়েছিলাম। আমার বাবা চাকরির জন্য ঢাকায় থাকতেন আর আমরা থাকতাম চট্টগ্রামে। তাই বাবার সঙ্গে তেমন সময় কাটানো কখনো হয়ে ওঠেনি। সব স্বাভাবিক ছিল। সেদিন আবার আমার জন্মদিনও ছিল। বাবা ঢাকা থেকে এসেছিলেন। তাই আমার খুশির সীমা ছিল না। বাবা এসে জানালেন, আমরা নাকি সবাই রাজশাহীতে চলে যাব। কারণ, তাঁকে বদলি করা হয়েছে। চট্টগ্রামে যে স্কুলে পড়তাম, সেখানে ছিল আমার বেস্টফ্রেন্ড সাবিহা, ফাবলিহা, আকিফা। তাই মন একটু খারাপই ছিল। পরে বাবা এসে বোঝানোর পর বুঝেছিলাম। কিছুদিন পর আমরা রাজশাহীতে চলে এলাম। রাজশাহীতে একটি স্কুলে ভর্তি হলাম। একটু ভয় লাগছিল, কেউ আমার সঙ্গে কথা বলবে কি না, কে জানে। তবু সাহস করে গেলাম স্কুলে। গিয়ে আমি আমার ক্লাসে এসে একটি বেঞ্চে বসলাম। হঠাৎ একটি মেয়ে এসে আমার ব্যাগ অনেক দূরে ছুড়ে মারল। আমার হাত টেনে ধরে নিয়ে ক্লাসরুম থেকে ধাক্কা মেরে বের করে দিল। মাটিতে পড়ে গিয়েছিলাম আমি। আমার নতুন স্কুলড্রেস ছিঁড়ে গিয়েছিল। সবকিছু এত দ্রুত হলো যে কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। আমি উঠে ক্লাসে ঢুকলাম। সবাই হাসছে। খুব খারাপ লাগল। এরপর আমি বুঝলাম, মেয়েটি কেন আমার সঙ্গে এমন করল। শুধু তার বন্ধুর জায়গায় বসেছিলাম বলে এমন করেছিল মেয়েটি। আমি ছিলাম লাজুক ও দুর্বল ধরনের। আমার কাছে নিজেকে একটুও গুরুত্বপূর্ণ মনে হতো না। আমার সঙ্গে কেউ কথাও বলত না। কোনো বন্ধু ছিল না আমার। পরের দিনগুলো ছিল আরও বাজে। যদিও মা–বাবাকে কখনো এসব ব্যাপারে কিছু বলতে পারিনি। মা অনেক অসুস্থ, মাকে এসব ব্যাপারে কিছু বললে আরও অসুস্থ হয়ে যেতে পারেন। বাবা অনেক ব্যস্ত। তা ছাড়া তাঁকে আমি খুব ভয়ও পাই। প্রতি রাত আমার কাটে কান্না করে। পড়ালেখায় অনেক পিছিয়ে পড়েছি। কিছুই পারি না। একদিন স্কুলে একটি ড্রয়িং প্রতিযোগিতা ছিল। আমি অংশগ্রহণ করেছিলাম। প্রতিযোগিতার দিন সব ঠিকঠাক করে বেরিয়ে পড়লাম ঘর থেকে। স্কুলেই ছিল প্রতিযোগিতাটি। সেখানে গিয়ে হাজার হাজার শিক্ষার্থী দেখে ঘাম ছুটতে শুরু করল। প্রতিযোগিতা শুরু হলো। আমি আমার মনের মতো করে একটি দৃশ্য আঁকলাম। প্রায় এক ঘণ্টা পর আঁকা শেষ হলো। ছবি জমা দিয়ে কোনার একটি বেঞ্চে বসলাম। কারণ, কেউ আমাকে তার পাশে বসতে দিচ্ছিল না। অপেক্ষা করছিলাম পুরস্কার বিতরণীর জন্য। যদিও জানতাম, হাজারো শিক্ষার্থীর মধ্যে আমি বিজয়ী হব না। দুই ঘণ্টা পর অনুষ্ঠান শুরু হলো। নাচ, গান, এরপর পুরস্কার বিতরণ। প্রধান শিক্ষক নাম ঘোষণা করছেন। আমি যেহেতু ধরেই নিয়েছিলাম বিজয়ী হব না, তাই বাসায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হঠাৎ শুনতে পেলাম, প্রথম স্থান অধিকার করেছে—আরিয়া ফাতিন! টের পেলাম, আমার পুরো শরীর কাঁপছে। আমি দৌড়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ কার সঙ্গে যেন ধাক্কা খেয়ে আমার পাশে থাকা তারের জঞ্জালে পেঁচিয়ে মাটিতে পড়ে গেলাম। কানে টিংটিং আওয়াজ হচ্ছে। চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। শুধু বুঝতে পারলাম, এতগুলো মানুষ শুধু আমার জন্য করতালি দিচ্ছে!