সেই সব বিকেল

অলংকরণ: আপন জোয়ার্দার

বিকেলে খুব ইচ্ছা করছিল একটু বাইরে যেতে। কিন্তু ইব্রি যে নেই, আমি তো একা। এটা মনে পড়তেই একটা ধাক্কা খেলাম। বিষাদে ছেয়ে গেল মনটা। তবু সারা দিন দুয়ারবদ্ধ হয়ে পড়ে থাকতে ভালো লাগে না। তাই সামান্য স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে একাই বের হলাম।

চিতই পিঠার দোকান খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছে গেছি লেকের পাড়ে। খুব সম্ভবত বনানীর এদিকটায় পিঠার দোকান নেই। তা ছাড়া ঝালমুড়ি, ভেলপুরি, ফুচকা, হাওয়াই মিঠাই—কিছুই থাকে না। থাকার কথাও নয়। কারণ, এখানকার পরিবেশটাই অন্য রকম। ইট-পাথরের বিরাট বিরাট দালানের চেহারায় কৃত্রিমতার এক অস্পষ্ট আবেশ। জনপদগুলোও খুব ব্যস্ত। তাই এখানে শৌখিন চিত্তে হেঁটে হেঁটে পিঠাবিলাস বাস্তবেই বেখাপ্পা।

স্রোতহারা নিথর একটা লেকের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। দুই পাড় ঘেঁষে চলে গেছে জন-অরণ্যের অবিরাম পদচারণ। অল্প দূরেই দৃষ্টির সীমান্ত। পশ্চিমাকাশে নুয়ে পড়েছে তেজহীন রক্তিম সূর্যটা। যেন শেষবেলার ক্লান্ত পথিক। আলো মিইয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে পাখিরাও সব ফিরে যাচ্ছে ঘরের দিকে। এই পড়ন্ত বিকেলের প্রকৃতিও যেন নিষ্প্রাণ। কোনো হাঁকডাক নেই তার। আছে শুধু পিচঢালা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা যানগুলোর বিরক্তিমাখা হইচই। তারাও ফিরতি পথে অপেক্ষমাণ।

এ রকম কত বিকেলই না জমে আছে স্মৃতিবৃক্ষের ঝরা পাতার স্তূপে। তবে সেগুলোর ছিল প্রাণোচ্ছ্বাস, এমন নির্জীব নয়। চিতই পিঠা কিংবা হাওয়াই মিঠাইয়ের সঙ্গ নিয়ে আমি আর ইব্রি পথ চলতাম পাশাপাশি। কখনো আবার একই ঠোঙায় দুজনের ঝালমুড়ি। মাঝেমধ্যে আমাদের শেষ বিকেলে জায়গা পেত দশ টাকার ফুচকা বা পাঁচ টাকার ভেলপুরি। কতই না রোমাঞ্চকর ছিল সেসব বিকেল! আর এখন....!

প্রতিদিনই হাঁটতে যেতাম আমরা। হোস্টেলে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যেত। দুরুদুরু বুকে গেট পার হতাম অনিশ্চিত আশঙ্কায়। বেশি দেরি হয়ে গেল না তো আবার! কিংবা সামনে হয়তো কোনো টিচার! ভয় একটা না একটা থাকতই। তবু বিরাম ঘটত না খানিকের এই আবেগস্রোতে।

তাহসানের একটা গানে আছে: ‘রোমন্থন করি ফেলে আসা, দৃশ্যপট স্বপ্নে আঁকা....।’ আমার কাছেও এখন ওসব শুধুই সুখভাবনা। কখনো যদি এটা হয় মানসিক যন্ত্রণা, তবু আশ্চর্যের কিছু নয়। বাস্তবতা বড়ই নিষ্ঠুর। ভালোবাসার প্রতি বিন্দুমাত্র মায়া নেই তার।