আষাঢ়ে গল্পের গল্প

আষাঢ়ে গল্প কাকে বলে, কী তার রূপ-রং-চেহারা, ধরনটাই-বা কেমন, সে কথা বলার আগে গল্পের সঙ্গে আষাঢ় মাসের যোগটা কোথায় এবং কেন, সে নিয়ে একটুখানি না বললেই যে নয়!

এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে সত্যি বলছি, বাংলা ভাষার প্রায় তাবৎ অভিধান আমি ঘেঁটে দেখতে কসুর করিনি। বেশির ভাগ অভিধানেই ‘আষাঢ়’ শব্দের পরই ‘আষাঢ়্যাইয়া’, ‘আষাঢ়ে’ এবং তারপরই ‘আষাঢ়ে গল্প’ শব্দ যুগল পেয়ে যাচ্ছি। কিন্তু আমার প্রশ্ন, আষাঢ় মাসের সঙ্গে গল্পের কী সম্পর্ক? বেশির ভাগ অভিধানেই এর জবাব দেওয়া হয়েছে বেশ সহজ ভাষায়।

বর্ষার মৌসুমে আষাঢ় মাসেই ঝুমবৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। আর তাই বেশির ভাগ সময় বন্ধ থাকে সব ধরনের কাজকর্ম। বড়দের তো বটেই, ছোটদেরও আটকা পড়ে থাকতে হয় ঘরে। রবীন্দ্রনাথ তো আর এমনি এমনি ‘আষাঢ়’ কবিতাটি লেখেননি। সেই কবিতায় তিনি ছোটদের লক্ষ করে বলেছেন, ‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহিরে/ ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে’। দিন-রাতের প্রায় সর্বক্ষণ অবিরাম বৃষ্টিপাতের অবসরে তাই বসে গল্পের আসর। ছোটদের গল্প শোনায় দাদা-দাদিরা, নানা-নানিরা। কখনো বাবা-মায়েরাও। আর তাদের বলা সেই সব গল্প যে-সে গল্প নয়, রূপকথার গল্প, বেশির ভাগই অলীক, অদ্ভুতুড়ে গল্প। না হলে যে ছোটদের মনে বিস্ময় জাগানো যায় না। বিস্ময়ে তাদের চোখ বড় বড় হয় না। ফলে আষাঢ় মাসজুড়ে এ-জাতীয় গল্প বলা হয় বলে তার নাম ‘আষাঢ়ে গল্প’। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ নামের বিখ্যাত অভিধানে ‘আষাঢ়ে গল্প’-এর অর্থ বলতে গিয়ে বলা হয়েছে ‘কাল্পনিক অদ্ভুত গল্প’, ইংরেজিতে যার অর্থ ‘Careless chat’। এবং আষাঢ় মাসজুড়ে এই যে গল্প বলার রীতি, তা চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। তারই নানা নমুনা ধরা আছে আমাদের বাংলা সাহিত্যের ছড়া, কবিতা, লোককাহিনি, এমনকি আধুনিক কালের গল্প-উপন্যাস ও ছড়া-কবিতাতেও।

আষাঢ়ে গল্পকে ইংরেজিতে Nonsense story-ও বলা হয়। এবং তাদের এই রীতি বা ধারার যে গল্প, ছড়া, কবিতা বা উপন্যাস, তার সঙ্গে বাংলার আষাঢ় মাসের মতো তাদের কোনো মাসের সম্পর্ক নেই। না থাকলে না থাকুক। কিস্সু আসে যায় না তাতে। কেননা, আমরা আষাঢ়ে গল্প বা আষাঢ়ে সাহিত্যের নানা শাখার বর্তমান যে রূপটি বাংলা সাহিত্যে দেখছি, তার ধরন বা প্রকৃতিটি কিন্তু ধার করেছি প্রধানত ইংরেজি সাহিত্যের কাছ থেকেই। নানাভাবে প্রভাবিতও হয়েছি। কিন্তু তাতে ছোট হওয়ার কিছু নেই। বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্প বা উপন্যাস ছিল না। সাহিত্যের এই দুটি ধারা পাশ্চাত্য সাহিত্যের কাছ থেকে আমাদের ধার করা। কিন্তু ধার করার পরও কথাসাহিত্যে, বিশেষত ছোটগল্পে বাংলা সাহিত্যে এত সমৃদ্ধ কাজ হয়েছে যে এই একটি ক্ষেত্রে অন্তত ১০ জন ছোটগল্পকারকে নোবেল পুরস্কারে অনায়াসে ভূষিত করা যেতে পারে। কথা সেটা নয়, ধার করেও আমরা নতুন কী যোগ করলাম, সেটাই বিবেচনার বিষয়।

(বাঁ থেকে) রুডলফ এরিখ রাসপে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, এডওয়ার্ড লিয়র

আষাঢ়ে গল্প, ছড়া, কবিতা ও উপন্যাসের কথা উঠলেই ইউরোপের যে তিনজন সাহিত্যিক ও কবি-কারুকারের নাম সবার আগে নিতে হবে, তাঁরা হলেন জার্মানির রুডলফ এরিখ রাসপে (১৭৩৬-১৭৯৪)। ১৭৭৩ কি ১৭৭৫ সালে তাঁর লেখা ব্যারন মুনশাউজেনের রোমাঞ্চকর অভিযান বইটি প্রকাশিত হলে ইউরোপজুড়ে প্রবল সাড়া পড়ে গিয়েছিল। এরপর পালাক্রমে নাম নিতে হবে দুজন ইংরেজ শিশুসাহিত্যিকের। তাঁদের একজন এডওয়ার্ড লিয়র (১৮১২-১৮৮৮), অন্যজন লুইস ক্যারল (১৮৩২-১৮৯৮)। এডওয়ার্ড লিয়র বিখ্যাত হন তাঁর পাঁচ পঙিক্তর ছড়া ‘লিমেরিক’ লিখে। আবোল-তাবোল ও উদ্ভট ভাবনার স্পর্শে রচিত তাঁর কবিতা, লিমেরিক এবং গল্পও পাঠককে অন্য এক জগতে নিয়ে যায়। সেই সঙ্গে তাঁর নিজের আঁকা ছবি প্রতিটি কবিতা, লিমেরিক ও গল্পগুলোকে এনে দিয়েছে নতুন মাত্রা। বাংলা সাহিত্যে বেশ কিছু সাহিত্যিক-অনুবাদক তাঁর ‘লিমেরিক’ অনুবাদ করেছেন। তাঁদের মধ্যে সত্যজিৎ রায়ের নাম সবার আগে নিতে হবে। তাঁর অনূদিত তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম-এ জায়গা করে নিয়েছে এডওয়ার্ড লিয়রের ছড়া ও গদ্য। এ বইয়ের শেষে আছে লুইস ক্যারলেরও কয়েকটি ছড়ার অনুবাদ।

তবে তাঁর ছড়া-কবিতার জন্য ততটা নন, লুইস ক্যারল বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় তাঁর অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড তথা আজব দেশে অ্যালিস এবং থ্রু দ্য লুকিং গ্লাস অর্থাৎ আয়নার ভেতর দিয়ে বই দুটোর ননসেন্স তথা উদ্ভট খেয়ালি ভাব-ভাবনা ও গল্পের জন্য। বাংলাদেশ তো বটেই, বিশ্বের এমন কোনো দেশ নেই, যে দেশের ভাষায় এ দুটি বই, বিশেষত আজব দেশে অ্যালিস অনূদিত হয়নি।

সামগ্রিকভাবে বাংলা সাহিত্যে এডওয়ার্ড লিয়র ও লুইস ক্যারলের প্রভাব আমরা ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকেই পড়তে দেখি। ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের (১৮৪৭-১৯১৯) উপন্যাস ও গল্পগুলো তার উজ্জ্বল উদাহরণ। তাঁর ভূত ও মানুষ, ফোকলা দিগম্বর, মজার গল্পডমরু-চরিত নামের উদ্ভট ও অলীক গল্প-উপন্যাস, তথা আষাঢ়ে গল্প রচনার রীতিটি পাশ্চাত্য থেকে ধার করা হলেও ত্রৈলোক্যনাথ নিজস্ব শক্তিতে বলীয়ান।

(বাঁ থেকে) শিবরাম চক্রবর্তী, লুইস ক্যারল ও নারায়ণ গঙ্গাপাধ্যায়

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথও কি সাহিত্যের ননসেন্স তথা উদ্ভটতার প্রভাবকে এড়িয়ে যেতে পেরেছেন? পারেননি। শেষ বয়সে এসে তাই তো তিনি লেখেন সে আর গল্পসল্প-এর মতো বই। ছবিও আঁকেন গল্পের থিমের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। লেখেন খাপছাড়ার মতো ছড়ার বই। আষাঢ়েমিতে ভরা। যেমন ‘ক্ষান্তবুড়ির দিদিশাশুড়ির/ পাঁচ বোন থাকে কাল্নায়—/ শাড়িগুলো তারা উনুনে বিছায়,/ হাঁড়িগুলো রাখে আলনায়।’...এ বইয়েরও প্রতিটি ছড়া ও পদ্যের সঙ্গে তিনি যে ছবি আঁকেন, রবীন্দ্রনাথকে তা অন্য এক নতুন মাত্রায় পৌঁছে দেয়।

বাংলা সাহিত্যে প্রকৃত বিচারে ননসেন্স বা আষাঢ়ে গল্প, কবিতা ও ছড়া লিখেছেন সুকুমার রায় (১৮৮৭-১৯২৩)। ননসেন্স-রীতিটি পাশ্চাত্য থেকে ধার করেও তিনি এ ক্ষেত্রে এমন অননুকরণীয় কিছু সৃষ্টি করেছেন, বিশ্বসাহিত্যেও যার তুলনা মেলা ভার। আবোল-তাবোল, খাই খাই-এর ছড়া-কবিতাগুলো, বড়গল্প হযবরলবহুরূপীর গল্পগুলো, নাটক ঝালাপালা, লক্ষণের শক্তিশেলঅবাক জলপান—তাঁর এসব সৃষ্টিকর্ম তাঁকে কালজয়ী শিশুসাহিত্যিকে পরিণত করেছে।

ননসেন্স বা আষাঢ়ে গল্প, কবিতা-ছড়া ও উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের আরও অনেক দিকপাল কথাসাহিত্যিক, কবি ও ছড়াকার লিখেছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, যোগীন্দ্রনাথ সরকার, পরশুরাম তথা রাজশেখর বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, বনফুল, শিবরাম চক্রবর্তী, কার্তিক ঘোষ, বলরাম বসাক প্রমুখ।

এ ক্ষেত্রে দুটি বইয়ের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বই দুটি হলো ইন্দ্রনীল চট্টোপাধ্যায়ের এবংপুরের টিকটিকি এবং প্রান্ত ঘোষ দস্তিদারের আষাঢ়ে গল্প

(বাঁ থেকে) প্রেমেন্দ্র মিত্র, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, সুকুমার রায়

বাংলাদেশেও যাঁরা আষাঢ়ে গল্প, কবিতা ও ছড়া লিখেছেন, তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হোসনে আরা, সাজেদুল করিম, হেলেনা খান, ফয়েজ আহেমদ, গোলাম রহমান, রফিকুল হক, নিয়ামত হোসেন, সুকুমার বড়ুয়া, মোহাম্মদ মোস্তফা, আহসান হাবীব, সফিকুন নবী, আনিসুল হক, ফারুক নওয়াজ, ফারুক হোসেন, লুৎফর রহমান রিটন, আমীরুল ইসলাম, রোমেন রায়হান, শফিক ইমতিয়াজ, আহমেদ রিয়াজ, আদনান মুকিত প্রমুখ।

তবে এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে আষাঢ়ে বা উদ্ভট বিষয়বস্তু নিয়ে ছোটদের উপযোগী ছড়া-কবিতা লেখা হয়েছে যে পরিমাণে, সে বিচারে গল্প ও উপন্যাসের একেবারেই গরিবি দশা।

আমরা প্রচুর আষাঢ়ে গল্প-উপন্যাস চাই।