অপুর অ্যাডভেঞ্চার

অলংকরণ: রোমেল বড়ুয়া

— মা আমি অ্যাডভেঞ্চার করতে চাই।

সাইদা বেগম অবাক হয়ে তাঁর ক্লাস থ্রিতে পড়া ছেলের দিকে তাকালেন। একটাই ছেলে তাঁর। রোড অ্যাকসিডেন্টে স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে এই ছেলেকে নিয়েই তাঁর বেঁচে থাকা।

— কী বললে?

— বলছি যে আমি একটা অ্যাডভেঞ্চার করতে চাই।

— হঠাৎ অ্যাডভেঞ্চার করার শখ হলো কেন তোর?

উল বুনতে বুনতে মা জানতে চান।

— কারণ আমার সব বন্ধু অ্যাডভেঞ্চার করেছে।

— কী রকম অ্যাডভেঞ্চার করেছে?

— রন্টু তো একবার হারিয়ে গেল। ওকে খুঁজে পাওয়া গেল তিন দিন পর। এই তিন দিন ওর যে কত অ্যাডভেঞ্চার হয়েছে! তারপর ধরো মিঠুও একবার বাসা থেকে রাগ করে পালিয়ে গেল। সাত দিন পর ওকে খুঁজে পাওয়া গেছে। ওই সাত দিনও ওর কত্ত অ্যাডভেঞ্চার হয়েছে।

— আচ্ছা।

মা এবার উল বোনা বন্ধ করে ছেলে অপুর দিকে তাকালেন।

— তা তুই কী ধরনের অ্যাডভেঞ্চার করতে চাচ্ছিস?’

— তারপর ধরো সালেক, ও তো একবার একটা ডাকাতের পিছু নিয়েছিল একা একা...

— আমি জানতে চাচ্ছি তুই ঠিক কী অ্যাডভেঞ্চার করতে চাচ্ছিস?

— আমার সব বন্ধুর জীবনে অ্যাডভেঞ্চার আছে, আমার নেই।

— উফ! আমি বলছি তুই ঠিক কী অ্যাডভেঞ্চার করতে চাচ্ছিস?

— আমি বাসা থেকে পালিয়ে যাব।

— পালিয়ে কোথায় যাবি?

— দূরে কোনো পাহাড়ে কিংবা জঙ্গলেও হতে পারে। ওখানে ধরো ভয়ংকর কোনো ডাকাত দলের সন্ধান পেলাম।

— তারপর?

— তারপর ওদের ধরিয়ে দিলাম পুলিশের কাছে।

— তুই একাই?

— এ্যাঁ...হ্যাঁ...।

মা গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এ ছেলে মনে হচ্ছে ভোগাবে।

— তাহলে তোকে একটা অ্যাডভেঞ্চার করতেই হবে, নইলে তোর প্রেস্টিজ থাকছে না?

— হ্যাঁ।

অপু মাথা নাড়ে।

— বেশ, কর অ্যাডভেঞ্চার।

— আমি পালিয়ে যাব বাসা থেকে। তোমার কি মন খারাপ হবে?

— একটু তো হবেই, তোর জন্য চিন্তা হবে না? এক কাজ করলে কেমন হয়?

— কী?

— তুই পালিয়ে তোর নানুর বাড়ি চলে যা।

— সে তো অনেক দূর।

এবার মা হেসে ফেললেন।

— আরে গাধা, তুই না জঙ্গলে–পাহাড়ে যেতে চাইলি? আর নানুর বাড়ি যেতে ভয় পাচ্ছিস?

— না...আ, আচ্ছা যাব।

— নানুর বাড়ির পেছনে একটা জঙ্গলও আছে।

— আচ্ছা যাব।

— কবে যাবি?

— কাল।

— ঠিক আছে, তাহলে আয় আমরা একটা ম্যাপ বানাই।

— ম্যাপ কেন?

— বাহ! ম্যাপ দেখে দেখে যাবি না? বাসে–স্কুটারে ওঠা যাবে না, হেঁটে হেঁটে যাবি, সময় লাগবে, কষ্ট হবে, সেটাই তো অ্যাডভেঞ্চার।

— হুঁ।

সাইদা বেগমের মনে হলো তাঁর ছেলে একটু যেন নাভার্স।

— কী হলো, যাবি না?

— যাব, যাব।

— আয় তাহলে ম্যাপ বানাই।

শোন, কখন পালাবি? কাল সকাল সকাল পালাস। কারণ নানুর বাড়ি পৌঁছাতে সময় লাগবে, হেঁটে যাবি না?

সত্যি সত্যি মা–ছেলে মিলে একটা কাগজে ম্যাপ তৈরি করা হলো। তাঁদের শান্তিনগরের বাসা থেকে গাবতলী, সেখান থেকে ম্যাপ ধরে ধরে আমিনবাজার...তারপর জোড়পুল, তারপর সাভার বাজার, তারপর ডান দিকের রাস্তা ধরে...সামনে এগোলে নানুর বাড়ি। ম্যাপটা সত্যি সে রকম হলো (তবে কম্পিউটারের সাহায্য একটু লাগল বটে)। সাইদা বেগমের অনার্স ছিল ভূগোলে, তাই বেশ সুবিধাও হলো ম্যাপ করতে। তারপর একটা পোঁটলার মধ্যে এক টুকরা পিৎজা, একটা বোতলে পানি। আর একটা লাঠি।

— লাঠি কেন? অপু জানতে চায়।

— কী আশ্চর্য, রাস্তাঘাটে বিপদ–আপদ হলে লাঠি দিয়ে ঠেকাবি। লাটির মাথায় পোঁটলাটা ঝুলিয়ে হাঁটবি, কেন অ্যাডভেঞ্চারের সিনেমায় ছবিতে দেখিস না বাচ্চারা যেভাবে অ্যাডভেঞ্চার করতে বেরোয়।

— আচ্ছা, আচ্ছা।

অপুকে এবার বেশ উত্তেজিত মনে হয়।

— শোন, কখন পালাবি? কাল সকাল সকাল পালাস। কারণ নানুর বাড়ি পৌঁছাতে সময় লাগবে, হেঁটে যাবি না?

পরদিন ভোরে সাইদা বেগম ঘুম থেকে উঠে দেখেন তাঁর ছেলে সত্যি সত্যি পালিয়েছে। লাঠি, পোঁটলা, ম্যাপ সব নিয়ে গেছে। তার প্যান্টের পকেটে অবশ্য এক শ টাকা খুচরো করে দেওয়া আছে। তিনি চটজলদি ফোন দিলেন ছোট ভাইকে।

— হ্যালো আনিস?

— কী ব্যাপার আপা, সাতসকালে ফোন দিলে?

— শোন, তোর ভাগনে অপু বাসা থেকে পালিয়েছে।

— মানে? কী বলছ?

লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসে আনিস।

— পালিয়ে তোদের বাসায় যাচ্ছে।

— মানে? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

— শোন...ঘাবড়াস না। ও একটা অ্যাডভেঞ্চার করতে চাচ্ছে। অনেক ভেবেচিন্তে দেখলাম, করে ফেলুক, সাহসটা একটু বাড়ুক, এমনিতে তো একটা ভিতুর ডিম হয়েছে বাবার মতো।

— তোমাকে বলে গেছে?

— হ্যাঁ, হ্যাঁ বাবা! পুরাই অ্যারেঞ্জড অ্যাডভেঞ্চার বলতে পারিস এটাকে। হেঁটে রওনা দিয়েছে, সঙ্গে ম্যাপ করে দিয়েছি। ধর, তোদের বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে, ওর হাঁটার যে স্পিড, তাতে করে হয়তো দুপুর হয়ে যাবে। পৌঁছানোমাত্র আমাকে ফোন দিবি, আমিও চলে আসব উবারে করে।

— আপা, তুমি কী সব পাগলামো করো। ক্লাস থ্রির একটা বাচ্চা এত দূর হাঁটবে? তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে?

— মাথাটা আমার খারাপই রে। অপুর বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই মনে হয় মাথাটা খারাপই হয়ে গেছে একটু। তবে ভাবিস না, ও ঠিক ঠিক পৌঁছে যাবে। ওর জীবনটা হবে কষ্টের, এখন থেকে ট্রেনিং না দিলে হবে না...

কিন্তু সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেছে, অপু তখনো সাভারে নানুর বাড়ি পৌঁছায়নি! মানে কী? গেল কোথায়? ওকি হারিয়ে গেল? সাইদা বেগমের বুকের ভেতরটা কেমন যেন করছে। কেন এই পাগলামো করতে গেল? বাচ্চাটা কোথায় আছে, কী করছে, কিছু কি খেয়েছে? পোঁটলার ভেতর এক টুকরা পিৎজা ছিল, সেটা তো খেয়েছে নাকি! পিৎজা তার প্রিয়। অপুর মামা আনিস মোটরসাইকেল নিয়ে সাভার থেকে শান্তিনগর পর্যন্ত এসেছে, ধীরে ধীরে চালিয়ে, যদি পথে দেখা হয়ে যায়। দু–এক জায়গায় থেমে জিজ্ঞেসও করেছে বাচ্চা একটা ছেলেকে কেউ এই পথে সাভারের দিকে হাঁটতে দেখেছে কি না। রাত আটটার পর সাভার থানায় জানানো হলো। শান্তিনগর থানায়ও ডায়েরি করা হলো।

রাত ১০টায় বিছানা নিলেন সাইদা বেগম। বুকের ভেতরটা ধকধক করছে! ঠিক তখন দেখা গেল অপুকে, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। লাফিয়ে উঠলেন সাইদা বেগম।

— এসেছিস? এতক্ষণ কোথায় ছিলি, বাবা?

— ছাদে।

— ছাদে?

— হ্যাঁ, আমার একা একা যেতে ভয় করছে মা। অ্যাডভেঞ্চারে যাইনি।

সাইদা বেগম হতভম্ব হয়ে অপরাধী মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেকে কিছুক্ষণ দেখলেন। তারপর জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে নিলেন। মনে মনে বললেন, ‘আমার ভিতুর ডিম বাবা, তোমার অ্যাডভেঞ্চার না হলেও আমাদের সবার অ্যাডভেঞ্চার হয়েছে আজ!’