আফসোস

অলংকরণ: সব্যসাচী চাকমা

রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল মরিয়ম। তার বাসা থেকে স্কুলে যেতে সময় লাগে ১৫ থেকে ২০ মিনিট। ক্লাস শুরু হয় সকাল ১০টায়। আজ কী মনে করে বেশ তাড়াতাড়ি বের হয়েছে সে। রোদের তেজের কারণে বিরক্ত লাগছে তার। নভেম্বর মাস। কোথায় এই সময় মিষ্টি রোদ উঠবে, তা না। মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে মরিয়মের। আরেকটা কারণেও বিরক্ত লাগছে তার। দোকানের লোকজন তাদের জিনিসপত্র সব ফুটপাতের ওপর রেখেছে, হাঁটার জায়গা পর্যন্ত নেই। এদের ভাব দেখে মনে হয়, ফুটপাতগুলো জিনিসপত্র রাখার জন্যই বানানো হয়েছে। হঠাৎ মরিয়মের পাশ দিয়ে কতগুলো ছেলে দৌড়ে গেল। ছেলেগুলোর মধ্যে দুজনের হাতে একটা রশি। রশিটি একটা গাড়ির সঙ্গে বাঁধা। গাড়ি বলতে একটা তক্তার নিচে দুই জোড়া চাকা লাগানো। তক্তার ওপর একটা ছেলে বসে আছে। ওই দুজন ছেলে গাড়িটিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আর বাকি তিনজন ছেলে হইহই করে চিৎকার করছে। যেন খুব মজার কিছু। তক্তার ওপর বসা ছেলেটি আনন্দে খিলখিল করে হাসছে। মরিয়মের মনে পড়ল গ্রামের একটা খেলার কথা। সুপারিগাছের পাতা দিয়ে এভাবে খেলা যায়। একজন যে অংশে পাতা বেশি, ওই অংশে বসে থাকবে। বাকিরা অন্য অংশ ধরে টানবে।এই ছেলেগুলো শহরে সুপারিপাতা পায়নি, তাই হয়তো গাড়ি দিয়ে কাজ চালাচ্ছে।

মরিয়ম আবার পথচলা শুরু করল। তার মাঝেমধ্যে খারাপ লাগে। কীভাবে গ্রামীণ খেলাগুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। শহরের ছেলেমেয়েরা গ্রামীণ খেলা খেলে না। জানেও না কীভাবে খেলতে হয়। কিন্তু গ্রামের ছেলেমেয়েরাও এসব খেলে না আজকাল। সবাই শুধু পড়ে থাকে মুঠোফোন নিয়ে। মরিয়মের গতকাল রাতের কথা মনে পড়ে গেল। আপু তার ছোটবেলার গল্প বলছিল। তারা কী কী খেলত, কে কে খেলত—এসব। এসব শুনলে অনেক হিংসা হয় মরিয়মের। আপুরা তাদের ছোটবেলায় কত মজাই না করেছে। কাজিনরা মিলে কত কিছু খেলত। কিন্তু মরিয়ম এসবের ধারেকাছেও যেতে পারেনি। সমবয়সী কোনো কাজিন নেই তারা। শৈশবের বেশির ভাগ সময় সে কাটিয়েছে বাসার চার দেয়ালের ভেতর। যদিও জন্মের পর কয়েক বছর গ্রামে ছিল। তবে তখন অনেক ছোট ছিল। সময়টাকে খুব একটা উপভোগ করতে পারেনি। জীবনটা কত দ্রুতই না পাল্টে যায়। যেসব কাজিন একসময় একে অন্যকে অনেক দিন পর দেখলে কত খুশি হতো। সবার ঝুলিতে এত এত গল্প থাকত। কে কোনটা আগে বলে শেষ করবে, বুঝে উঠতে পারত না। ওই কাজিনরাই এখন একে অন্যকে অনেক দিন পর দেখলে ‘হাই’, ‘হ্যালো’ বলে মুঠোফোন নিয়ে বসে পড়ে। কথা বলার থেকেও বেশি জরুরি মুঠোফোন টেপা। কেন এ রকম হচ্ছে? এমনকি ছোট ছেলেমেয়েরাও খেলায় মেতে না থেকে মুঠোফোনে ঢুকে থাকে। আগেকার দিনের ছেলেমেয়েরা তাদের শৈশবকে যেভাবে উপভোগ করত, আজকালকার ছেলেমেয়েরা ওসবের ধারেকাছেও যায়নি।

এসব ভাবতে ভাবতে মরিয়ম তার স্কুলে পৌঁছে গেল। নিজের কল্পনার ইতি টানল। কী আর হবে আফসোস করে। সে তো আর মানুষের মন থেকে মুঠোফোনের আসক্তি দূর করে সবাইকে পুরোনো দিনের খেলায় মাতিয়ে তুলতে পারবে না।

লেখক: ষষ্ঠ শ্রেণি, গরিবে নেওয়াজ উচ্চবিদ্যালয়, চট্টগ্রাম