আমার বোকা শৈশব

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আমি যখন তোমাদের বয়সী ছিলাম, তখন কোনো পুরস্কারের সৌভাগ্য আমার হয়নি। যেটা করতে গেছি সেটাতেই ব্যর্থ। একবার নাম দিয়েছিলাম ইংরেজি কবিতা আবৃত্তিতে। আশা ছিল কিছু একটা পাব। খুব মন দিয়ে প্র্যাকটিস করেছি। আবৃত্তিও করছি চমৎকার। বিচারকদের চেহারাও সপ্রশংস। প্রাইজ জুটেই যায় আর কী। এমন সময় ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা। হঠাৎ উইংসের পাশ থেকে কে যেন চিৎকার করে উঠল, ‘তাড়াতাড়ি!’ কে কেন কাকে ‘তাড়াতাড়ি’ বলল কে জানে। হয়তো কেউ আস্তে আস্তে হাঁটছিল, তাই কেউ চিৎকার করে উঠেছে, ‘তাড়াতাড়ি’! কিংবা কাউকে বলা হয়েছে দৌড়ে এক গ্লাস পানি আনতে, সে আসছে আস্তে আস্তে, তাতে কেউ চেঁচিয়ে উঠেছে, ‘তাড়াতাড়ি’। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হলো কথাটা আমাকেই বলেছে। হয়তো আমি কবিতাটা বেশি আস্তে আস্তে পড়ছি দেখে চেঁচিয়ে বলেছে, ‘তাড়াতাড়ি’। মানে, ‘এত আস্তে কেন রে গাধা? ওতে কি প্রাইজ হবে? জলদি পড়, ‘তাড়াতাড়ি। দৌড় দে।’ আর যায় কোথায়। ছুটিয়ে দিলাম পাগলা ঘোড়া। পড়ছিলাম আস্তে আস্তে, হঠাৎ ১০০ মাইল গতিতে তুবড়ি ছুটিয়ে পড়া শুরু করলাম। বিচারকেরা হতভম্ব। ‘কী হলো রে ছেলেটার? ভালোই তো পড়ছিল। হঠাৎ ইঁদুরের মতো দৌড় দিল কেন?’

পুরস্কারের আশা মাঠে মারা গেল। কিন্তু ও না হলেই যে নয়। কী করে পুরস্কার পাই? অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম স্পোর্টসেই নাম দেব। কিন্তু তাতেই পুরস্কার কি অত সোজা! মাসের পর মাস প্র্যাকটিস করলে তবেই না পুরস্কার। কিন্তু আমি তো কিছুই প্র্যাকটিস করিনি। কী করে পারব? লংজাম্প-হাইজাম্প হবে না। আমি ছিলাম এমনই মোটা যে আমার পক্ষে নিচের দিকে পড়া যতটা সহজ, ওপরের দিকে ওঠা ততটাই কঠিন। কাজেই ওতেও আশা নেই। পোল-ভল্টও হবে না—ওজনের চোটে বাঁশ ভেঙে যাবে। ভেবে দেখলাম কোনো কিছুতেই আশা নেই। কিন্তু প্রাইজ যে না পেলেই নয়। অন্তত একটা প্রাইজ।

হঠাৎ মাথায় একটা চিন্তা এসে গেল। না, আছে। আছে একটা আইটেম। এ যুগে সেটা আর হয় না, কিন্তু সে যুগে ছিল। প্র্যাকটিস ছাড়াও ওতে অনেক সময় প্রাইজ জুটে যেত। এ হলো পেছন দিকে দৌড়। কেউ ওটা প্র্যাকটিস করে না। এমন সুযোগ আর হবে না। নেমে গেলাম কোমর বেঁধে। স্বপ্ন ব্যর্থ হলো না। প্রথম, দ্বিতীয় পুরস্কার না পেলেও জুটে গেল ‘থার্ড’ প্রাইজ। পুরস্কার হিসেবে যা পাওয়া গেল তা খুব সম্মানজনক নয়। একটা চায়ের চামচ। তাও আবার প্লাস্টিকের। কিন্তু সম্মানজনক না হলে হবে কী? ওই চামচ দিয়ে আমি চারপাশের সবাইকে একেবারে অস্থির করে তুললাম। আব্বার বন্ধুরা যখন ড্রয়িংরুমে বসে সরগরম আড্ডা দিতেন, তখন আমি ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে ওই চামচটা মুখের সামনে তুলে ধরে এদিক-ওদিক নাড়াতে থাকতাম। আশা, কেউ যদি তবু জিজ্ঞেস করে, ‘খোকা, তুমি চামচ নাড়ো কেন?’ তখন আমাকে পায় কে? গর্বের হাসি হেসে বলা যাবে, ‘হুঁঃ, হুঁঃ, এ যেমন-তেমন জিনিস নয় গো। এ হলো গিয়ে ‘থার্ড প্রাইজ।’ ‘থার্ড প্রাইজ’ কথাটা প্রায় গর্জন করে।

তরুণ বয়সে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

২.

ছেলেবেলায় আমি ছিলাম খুবই দুরন্ত। দুরন্ত কিন্তু সরল সোজা। ধ্বংসাত্মক বা ক্ষতিকর প্রবণতা আমার মধ্যে প্রায় ছিলই না। আজও নেই।

আমার ছোট ভাই মামুনও ছিল অসম্ভব দুরন্ত। কিন্তু ওর দুরন্তপনার মধ্যে প্রায়ই একটা ধ্বংসাত্মক অভিসন্ধি কাজ করত। ও প্রায়ই ওর অশুভ তৎপরতাগুলোর সঙ্গে সুকৌশলে আমাকে জড়িয়ে নিত, কিন্তু বিপদ দেখলেই আমাকে সামনে এগিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে পেছন থেকে সরে পড়ত। ফলে গল্পের বাজিকরের সেই বোকা ছাগলের মতো যাবতীয় শাস্তি আমাকে পিঠ পেতে নিতে হতো। মারধর খেতে হতো প্রায়ই। ব্যাপারটা কেমন তা একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝাই। একদিন মামুন আমাকে খবর দিল, রান্নাঘরে মিটসেফের ওপরের তাকে এক হাঁড়ি দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন করে রাখা হয়েছে। তাতে বেজায় পুরু সর।

আমি বোকা-সরল মানুষ। বললাম, ‘সর পড়েছে তো কী হয়েছে?’

মামুন বলল, ‘চলেন হাঁড়িটা নামিয়ে আমরা খেয়ে ফেলি।’

দুধটা সবার জন্যে জ্বাল দিয়ে রাখা হয়েছে, তাই শুধু দুজনে কেন আমরা খব ভাবনা প্রথমে আমার মাথাতেই আসেনি।

ওর কথা শুনে ব্যাপারটা মাথায় এল, ‘তাই তো, হাঁড়ি নামিয়ে তো সবটা দুজনেই খেয়ে নেওয়া যায়।’

বললাম, ‘চল’।

মা ঘুমিয়ে ছিলেন পাশের ঘরে। আমরা পা টিপে টিপে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকলাম।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

মিটসেফ বেশ বড়। ওপরের তাকটা আমার মাথায় চেয়েও ফুট খানেক উঁচুতে। সেই তাকে হাঁড়ি। কাজেই মিটসেফ বেয়ে ওপরে উঠতে না পারলে হাঁড়ি নামানো সম্ভব নয়। আমি মিটসেফের তাক বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলাম। মামুন পেছন থেকে দুহাতে ঠেলে আমাকে উঠতে সাহায্য করে চলল। কিন্তু আগেই বলেছি আমি ছিলাম বেজায় মোটাসোটা। আমার ভার মিটসেফ সহ্য করতে পারল না। বিকট শব্দে আমার ওপরে পড়ে গেল। মিটসেফের ভার ঘাড়ে নিয়ে হাঁড়ির দুধের মধ্যে আমি গড়াগড়ি খেতে লাগলাম। বিকট শব্দে মিটসেফ পড়া আর সেই সঙ্গে আমার তীব্র চিৎকার—এই দুয়ে মার ঘুম ভেঙে গেল। তার ধারণা হলো আমার বিপজ্জনক কিছু হয়েছে। উনি হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এলেন রান্নাঘরের দিকে। মামুন প্রথমে চেষ্টা করছিল আমাকে মিটসেফের নিচ থেকে বের করতে। কিন্তু মা রান্নাঘরে ঢুকছেন টের পেতেই ও আস্তে করে দরজার আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। আর মা ঘরে ঢুকে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পেছন দিয়ে নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

মা ভেবেছিলেন মিটসেফের নিচে পড়ে আমি হয়তো থেঁতলে গেছি। কিন্তু মিটসেফ সরিয়ে যখন দেখলেন যে আমি পুরোপুরি সুস্থ এবং হূষ্টপুষ্ট, তখন দুর্ঘটনায় আমার যতটুকু আহত হওয়ার কথা ছিল তা তিনি নিজের হাতে সম্পূর্ণ করে দিলেন।

৩.

ছেলেবেলায় আমি কেমন ছিলাম তা বোঝাতে ছেলেবেলার একটা কবিতা থেকে দুটো লাইন তুলে ধরছি:

ঘোষেদের রবি

সে বড় লোভী।

ছেলেবেলায় আমি ছিলাম এই রবির মতো। কেবল ছেলেবেলায় নয়, বড় হওয়ার পরেও। এই সেদিন পর্যন্ত খাওয়ার সময় লোভের ঘোরে চারপাশের মানুষদের চিনতে পারতাম না। আমার এক বয়সী বন্ধু প্রায়ই বলেন, ‘তুমি খাও লোভী বালকদের মতো।’ কথাটা ভুল নয়। আজ এই বয়সেও সামান্য ‘ভাত’ শব্দটা জিবে পানি ছাড়া আমি উচ্চারণ করতে পারি না।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

করটিয়ায় থাকতে একবার সেখানকার ডাক্তার মণিবাবুর বাসায় গিয়েছিলাম এক বিয়ের অনুষ্ঠানে। তিন দফায় সবার খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। আমি বসেছিলাম প্রথম দলের সঙ্গে, কিন্তু তৃতীয় দফায় লোকেরা উঠে যাওয়ার পরে আমার খাওয়া চলছে। মা বার কয়েক এসে তাগাদা দিয়ে গেছেন ওঠার জন্যে। কিন্তু আমার ভাবান্তর নেই। একসময় পিঠের ওপর মার হাতের ভারী কিলগুলো তালের মতো পড়তে শুরু করল। কিন্তু আমি নির্বিকার। এমন সুস্বাদু খাবার যদি খাওয়াই যায় তো এমন এক-আধটু কিল খেতে অসুবিধা কোথায়! আমার পুরো মনোযোগ তখন খাওয়ার দিকে। পিঠের ওপর মার কি ধুপধাপ পড়ছে, আর তা খেতে-খেতেই আমি ক্ষুব্ধস্বরে বলে চলেছি, ‘আহা, খাইয়া লই।’

আমি যে কতখানি লোভী ছিলাম, ছাত্র বয়সের একটা গল্প বলে তো বোঝাই। আমি তখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। মুন্সিগঞ্জে বেড়াতে যাচ্ছি আমাদের বাসায়। যাওয়ার পথে পকেটের সাকল্য সঞ্চয় নিয়ে মুন্সিগঞ্জ বাজার থেকে গোটা-পঞ্চাশেক লিচু কিনে নিয়েছি ছোট ভাইবোনদের জন্যে। কিন্তু কিছুটা হাঁটার পরই হঠাৎ টের পেলাম হাঁটা শুরু করার পর থেকেই আমি লিচুগুলো নিঃশব্দে খেয়ে চলেছি। কিছুদূর গিয়ে টের পেলাম যে হারে আমি খাচ্ছি তাতে বাসা পর্যন্ত পৌঁছানোর পর কোনো লিচুই আর অবশিষ্ট থাকবে না। কিন্তু খাওয়াও তো বন্ধ করা সম্ভব নয়। তাহলে কী করে অন্তত অল্প কিছু লিচু বাসা পর্যন্ত নিই। দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। অনেক ভেবে দেখলাম লিচু বাঁচানোর উপায় একটাই। দৌড় দেওয়া। প্রাণপণে দৌড়ে তাড়াতাড়ি বাসায় পৌঁছাতে পারলে, খাওয়ার সময় না পাওয়ায়, গোটাকয় লিচু বাঁচতে পারে। দিলাম দৌড়। কিন্তু কিছু লিচু বাসায় পৌঁছাল।

(আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের আমার বোকা শৈশব এবং বক্তৃতা সংগ্রহ-২ থেকে সংগৃহীত)