আমি একজন বিএমসিয়ান

২০০৭ সালের ২ জানুয়ারি। সাদা শার্ট, কমলা স্কার্ট আর লাল সোয়েটার পরে প্রথম আসি এই স্কুল প্রাঙ্গণে। এখন ২০১৮ সাল। এই স্কুলে আমার ১২তম বছর। শেষ বছর। গত বছরও ভাবতাম, কখন বের হব এই স্কুল থেকে? কলেজে উঠে নিজেকে বড় প্রমাণের ইচ্ছা ছিল প্রবল। এখন মনে হয়, সারাটা জীবন যদি এই স্কুলে কাটিয়ে দিতে পারতাম? ভালো হতো খুব। বিশ্বাস হয় না, ছোটবেলায় এখানে আসতে একদম মন চাইত না। শুধু কাঁদতাম। ক্লাসে বসতে চাইতাম না। নার্সারিতে আমার প্রথম বন্ধু ছিল রাইসা, রুপ্তি। আমি কাঁদতাম আর রাইসা থামানোর চেষ্টা করত। রুপ্তির সঙ্গে বসে দেখে দেখে লিখতাম। তাই সেলিনা টিচার সিট বদল করে দিতেন, রুপ্তি আমার জন্য কাঁদত আর রুমাল দিয়ে চোখ মুছত। রুপ্তি এখন আমাদের স্কুলে নেই। ও কোথায় হারিয়ে গেছে, তা-ও জানি না। থ্রিতে পাই আমার এখন পর্যন্ত থাকা বেস্ট ফ্রেন্ড ইউশাকে। কিন্তু সিক্সে ইউশা চলে যায় ইস্পাহানী স্কুলে। বন্ধুত্ব এখনো আছে, তবে ওর সঙ্গে ক্লাসে বসা মিস করি। সেভেনে পেয়েছি তৌহিদা, লাবিবা, আরিয়া আর দুর্দানাকে। আমার শান্তশিষ্ট স্বভাব পাল্টাতে তাদের ভূমিকা অপরিসীম। টিচার পেছনে ফিরলে কাল্পনিক ব্যাটিং-বোলিং। টিফিন পিরিয়ডে আড্ডা মেরে ফিফথ পিরিয়ডে বেঞ্চের নিচে লুকিয়ে টিফিন খাওয়া, এক শিঙাড়ায় পাঁচজন ভাগ বসানো, তৌহিদার বার্থডেতে কেক মাখামাখি, পরীক্ষা শেষে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরা, ফুচকা খাওয়া, একজনের ফুচকার টক শেষ হয়ে গেলে আরেকজনেরটা খেয়ে ফেলা, পাশের মাঠে মেলা হলে সেখানে কর্পদকশূন্য অবস্থায় ঘোরাফেরা করা, শিঙাড়া কিনতে পিয়ন আর আয়াদের পেছনে দৌড়াতে গিয়ে পড়ে জামা ছিঁড়ে ফেলা, ইউনিফর্মে কালি লাগানো, বাথরুমের নামে সারা স্কুল চক্কর দেওয়া, হালিমা টিচারের ক্লাসে আরিয়ার ঘুমিয়ে পড়া, ক্লাসে লুকিয়ে গল্পের বই পড়া, চুইংগাম খেতে গিয়ে ধরা পড়া—অমূল্য সব স্মৃতি। আর মাত্র এক বছর, তারপর আমরা সবাই চলে যাব যে যার জায়গায়, পাল্টে যাবে গন্তব্যস্থল। এটা মেনে নেওয়া বড়ই কঠিন।

ভুলব না শিক্ষকদেরও। সব সময় ভালোবেসেছেন অভিভাবকের মতো। সাইফুল স্যারের ক্লাসে অর্ধেকের বেশি মেয়ে কান ধরে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা—কেউ বই আনিনি, কম্পাস আনিনি, কেউ চুলে বেণি করেনি, কারও আবার কারও নখ বড়। বই এনেও আনিনি বলে ক্লাস ফাঁকি দিতাম অনেকেই। জাফর স্যার বই গোল করে ভাঁজ করে মাথায় আর গুঁতো দেবেন না। দেলোয়ার স্যার বলবেন না ‘অথর্বের দল’। শিবলী স্যারের ‘তোমার নাম যেন কী?’, রিয়াজু মিসের হাতে ধুমধাম পিঠে থাপ্পড় খাওয়া, তাহমিনা টিচারের র‌্যাকেটের বাড়ি, নাসির স্যারের ‘সবাই বলো, আমিন’; তাসনুভা টিচারের Why are you talking? বা ক্লাসে প্রায়ই দেরি করে আসা প্রিয়ন্তী, রামিসাদের সাইফুল স্যারের ক্লাসে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা আর দেখা হবে না। তানিয়া টিচারের মুখে আর শুনব না, ‘ক্লাসে এলে মনে হয় মাছের বাজার’। মনে পড়বে মাহবুবা টিচারের ‘ক্লাসরুমকে বাসার ড্রয়িংরুম মনে হচ্ছে তোমাদের?’ এই কথাও। সাইফুল স্যার আমাদের আর বলবেন না, ‘যার যার পড়তে ইচ্ছা করছে না, সে বেরিয়ে যাও। দরকার হলে শুধু একজন নিয়ে ক্লাস করব।’ এই সব আজ অনেক মধুর মনে হয়।

বাংলাদেশ মহিলা সমিতি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় আমাকে শিখিয়েছে জীবনের সব ক্ষেত্রে বিজয় ছিনিয়ে আনা। শাণিত করেছে আমার জ্ঞান, বাড়িয়েছে আমার অর্জন। প্রিয় স্কুল, খুব ভালোবাসি তোমার। তাই তো গর্ব ভরে আমরা বলি I am a BMSian. আমাদের কাছে আমাদের শ্রেষ্ঠ পরিচয় একজন BMSian হওয়া।

(কিশোর আলোর জানুয়ারি ২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত)