আমিই পারি শিশুবিবাহ প্রতিরোধ করতে

দিন কয়েক আগে এক বিকেলবেলা বান্ধবীর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল নিতু (ছদ্মনাম)। বৈকালিক আড্ডা আর একটু বাইরে ঘুরেফিরে চটপটি ফুচকা খাওয়াই ছিল উদ্দেশ্য। কিন্তু বান্ধবীর বাসায় পা দিয়েই তার চক্ষু চড়কগাছ! এ কি! বান্ধবী কান্তা (ছদ্মনাম) সারা মুখে হলুদ লাগিয়ে বসে আছে। আজ নাকি কান্তার গায়ে হলুদ। আগামীকাল বিয়ে! অথচ কান্তার এখনো বিয়ের বয়সই হয়নি। স্কুলের গণ্ডিই পেরোয়নি সে। এটা তো বাল্যবিবাহ। রীতিমতো অপরাধ। এ বিয়ে কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না। নিতু ও তার বন্ধুরা মিলে ৯৯৯–এ ফোন করে ঠেকিয়ে দেয় বিয়েটা।

টনি মাইকেল গোমেজ, পরিচালক, যোগাযোগ ও অ্যাডভোকেসি, ওয়ার্ল্ড ভিশন

কিশোরী কান্তার বাল্যবিয়ে বিয়ে ঠেকানো গেলেও বাংলাদেশে হাজারও কিশেরীর বাল্যবিয়ে বা শিশুবিবাহ ঠেকানো যাচ্ছে না। করোনাকালে এ সংখ্যা আরো বাড়ছে।

গত ২৪ জুন শিশুবিবাহ নিয়ে এ ধরনের বেশ কিছু তথ্য উঠে এসেছে ‘আমিই পারি শিশুবিবাহ প্রতিরোধ করতে’ শীর্ষক ভার্চুয়াল আলোচনায়। ওয়ার্ল্ড ভিশনের আয়োজনে অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হয় এবিসি রেডিওতে, যার সম্প্রচার সহযোগী ছিল প্রথম আলো ও কিশোর আলো। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন এবিসি রেডিওর নাদিয়া ইসলাম।

আলোচনায় ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের যোগাযোগ ও অ্যাডভোকেসি পরিচালক টনি মাইকেল বলেন, ‘আমাদের দেশে শিশুবিবাহ নিরোধ আইন নামে এক শ বছরের পুরনো একটি আইন ছিল। ২০১৭ সালে আইনটি সংশোধন করে যুগপোযোগী করা হয়। তারপরও শিশু বিবাহ রোধে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসছে না। বরং করোনার এই সময়ে বাল্যবিবাহ আগের তুলনায় বেড়েছে।’

হঠাৎ বাল্যবিবাহ বেড়ে যাওয়ার পেছনে তিনটি কারণকে দায়ী করেছেন টনি মাইকেল। তাঁর মতে, করেনার কারণে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকা, অভাব ও দারিদ্র বেড়ে যাওয়া ও করোনাকালে বিদেশ ফেরত প্রচুর ‘সুপাত্রের’ সন্ধান পাওয়া।

টনি মাইকেল বলেন, ‘বিদেশ ফেরত যুবকদের আমাদের দেশে সুপাত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ তাদের হাতে কিছু টাকা থাকে। আর্থিক নিরাপত্তাকে প্রাধান্য নিয়ে মা বাবা ছোট ছোট মেয়েদেরকে ওই যুবকদের সঙ্গে বিয়ে দেন।’

বর্তমান কোভিডকালে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে তিন লাখেরও বেশি প্রবাসী যুবক দেশে ফিরেছে বলে জানান তিনি। এই সময়ে বাল্যবিবাহ বেড়ে যাওয়ার পেছনে এটিও একটি কারণ বলে তিনি মনে করেন।

আবিদা সুলতানা, কিশোরী প্রতিনিধি

টনি মাইকেলের কথার প্রসঙ্গ ধরে আলোচনায় অংশ নেন কিশোরী প্রতিনিধি আবিদা সুলতানা। তিনি বলেন, ‘এখনো এই দেশে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে প্রতি বছর ২৩ হাজার মা মারা যাচ্ছেন। এই মায়েরা আসলে অপ্রাপ্তবয়ষ্ক মা। বিয়ের বয়স হওয়ার আগেই তাদের বিয়ে হয়েছে এবং গর্ভধারণের উপযুক্ত হওয়ার আগেই মা হয়েছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, ১৮ বছরের আগে মেয়েদের শরীরের পূর্ণ বিকাশ হয় না। কিন্তু কে শোনে কার কথা! দেশে আইনও আছে শিশু বিবাহ রোধে। কিন্তু তারপরও শিশু বিবাহ বাড়ছে।’

দেশে মহামারীর মতো বাল্যবিবাহ ছড়িয়ে পড়েছে উল্লেখ করে এই কিশোরী প্রতিনিধি বলেন, প্রত্যককে সচেতন হতে হবে। আইনের প্রয়োগ কঠোরভাবে করতে হবে। তা না হলে বাল্যবিবাহের ঊর্ধ্বগতি ঠেকানো যাবে না।

আল আমিন ব্যাপারী, কিশোর সংগঠক

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন কিশোর সংগঠক আল আমিন ব্যাপারী। তিনি পরিসংখ্যান উল্লেখ করে বলেন, ‘দেশে এখনো ১৮ শতাংশ নারীর বিয়ে হচ্ছে ১৫ বছর বয়স হওয়ার আগে। এটা উদ্বেগজনক। এর পেছনে একটি বড় কারণ যৌন হয়রানি। আমাদের দেশের অভিভাবকরা মনে করেন, কিশোরীদের যৌন হয়রানি থেকে রক্ষা করার জন্য অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া জরুরি।’

অনুষ্ঠানে তিন আলোচকই জোর দেন সচেতনতার ওপর। তাঁরা বলেন, যে কাজী বিয়ে পড়ান, তাঁকে বলতে হবে যে আমি কোনো বাল্যবিবাহ পড়াব না। যে বাবুর্চি বিয়ের অনুষ্ঠানে রান্না করেন, তাঁকে বলতে হবে যে আমি কোনো বাল্যবিয়ের অনুষ্ঠানে রান্না করব না। মা বাবাকে তো অবশ্যই বলতে হবে আমরা ছেলেমেয়দের বয়সের আগে বিয়ে দেব না। এভাবে প্রত্যেককে নিজে থেকে সচেতন হতে হবে। প্রত্যককে বলতে হবে আমিই পারি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করতে।

লেখক: সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো