একটা পেনড্রাইভ আর ফাহাদ

বছর তিনেক আগের কথা। স্কুলে একদিন শখের পেনড্রাইভটা হারিয়ে ফেললাম। তাই হন্যে হয়ে খুঁজছিলাম সারা স্কুল। আমার মুখে চিন্তা দেখে, ফাহাদ সাহায্যের জন্য এগিয়ে এল। তাই ওকে পাঠালাম ক্যানটিনের আশপাশে খুঁজতে। আমি খুঁজছিলাম দোতলায়, ক্লাসে। কিছুক্ষণ পর নজরে এল সাখাওয়াত আর আলামিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমার এই গরুখোঁজা বেশ উপভোগ করছে। কাছে যেতেই সাখাওয়াত আমার মাথায় আলতো চড় দিয়ে পেনড্রাইভটা তুলে ধরে জানাল, সিঁড়িতে নাকি পড়ে ছিল। চোখভর্তি আনন্দ আর মুখ ভরাট হাসি নিয়ে কৃতজ্ঞতা জানালাম ওদের।

একটু পর দোতলা থেকে দেখলাম, ফাহাদ হতাশ চেহারায় ওপরের দিকে আসছে। এরই মধ্যে সাখাওয়াত আর আলামিনকে নিয়ে এক দুষ্টুবুদ্ধি পাকালাম। আসলে ফাহাদ স্কুলের সবচেয়ে নিরীহ প্রাণী। অসম্ভব ধৈর্যশক্তি ওর। ওর অভিধানে ‘রাগ-অভিমানবাচক’ শব্দ নেই। শুধু ‘উচ্ছ্বাস আর হাসিসূচক’ শব্দে ভরপুর। তাই প্ল্যান করলাম ওর রাগ দেখেই ছাড়ব। বের করে আনব ওর চোখের পানি।

ফাহাদ আসামাত্রই আমার অভিনয় শুরু। ‘চোরের মন পুলিশ পুলিশ। আমার পেনড্রাইভ চুরি করে এখন সাহায্যের অভিনয় করা হচ্ছে’। কোনো ভূমিকা ছাড়াই বর্শার মতো কথাটা ছুড়ে দিলাম ওর দিকে। তারপর তিরের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে নিক্ষেপ করে গেলাম ‘চোর’, ‘ছোটলোক’-সমজাতীয় শব্দগুলো। পাশাপাশি আমার সমর্থনে সাখাওয়াত আর আলামিনও যোগ করে গেল আরও কিছু শব্দ, বাক্য। ত্রিপক্ষীয় হামলায় কাঁদো কাঁদো স্বরে ফাহাদ প্রতিবাদের চেষ্টা করে। ও নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে শত ব্যাখ্যা দেয়। আর আমরা ওকে দোষী সাব্যস্ত করতে শোনাই হাজার যুক্তি।

অবস্থা যখন জমজমাট, আমরা সিরিয়াস মুড ভেঙে যেই হেসে উঠব, এমন সময় স্যার চলে এলেন। আমরা সবাই চলে গেলাম ক্লাসে। ফাহাদ গেল ওয়াশরুমের দিকে। হয়তো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদবে। বন্ধুদের মিথ্যে চুরির অপবাদ। সহ্য করার ক্ষমতা কার?

সেদিনের পর থেকে ফাহাদ একটু দূরত্ব রেখে চলত। বলব বলব করে বলা হয়নি। সুযোগও বেশি দিন পাইনি। পরীক্ষা শেষে দুজনই স্কুল বদলাই। ফাহাদ এখন কোথায় জানা নেই। তবে বুঝি ও হয়তো আমার মতো অব্যক্ত এক যন্ত্রণায় ভুগবে আজীবন। ও হয়তো চিৎকার করে বলতে চায়, বিশ্বাস কর, আমি তোর পেনড্রাইভ নিইনি।

এই অতি সত্যটা আমার থেকে ভালো কে জানে? তবে ফাহাদ তুই হয়তো জানিস না। সেদিনের পর আমি একজন বন্ধু হারিয়েছিলাম, ভালো বন্ধু। খুব ভালো বন্ধু।