কত কিছু করার আছে

২০২০ সালের মার্চ মাসে যখন স্কুলগুলো ছুটি দিয়ে দেওয়া হলো, তখনো আমরা জানতাম না যে সেই স্কুল এত মাস ধরে বন্ধই থাকবে। যেমন এখনো আমরা জানি না যে আসলে কখন খুলবে স্কুল। স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় তোমাদের কার কার মন খারাপ? আমি চারজন বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, স্কুল ছুটি থাকলে ভালো, নাকি খুললে ভালো। দুজন বলেছে, বন্ধই ভালো। দুজন বলেছে, খুললেই ভালো। যারা বলেছে, বন্ধই ভালো, তাদের মনটা আমি বুঝি। আমারও ছোটবেলায় মনে হতো, স্কুল বন্ধ থাকাই ভালো। আর যারা বলেছে, স্কুল খোলা ভালো, তাদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন স্কুল খোলা ভালো? তারা বলেছে, স্কুলে বন্ধুবান্ধব আছে। তাদের সঙ্গে যে দেখা হচ্ছে না। আমি মনে করি, ওরা একদম ঠিক কথাই বলেছে। স্কুল ছুটি থাকার প্রধান ক্ষতি হলো, আমরা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মিশতে পারছি না। স্কুলের মাঠে খেলতে পারছি না।

আসলে স্কুলে যাওয়া, ক্লাস করা, বন্ধুদের সঙ্গে মেশা, শিক্ষকদের সঙ্গে মোলাকাত করা, হোমওয়ার্ক, পরীক্ষা—জীবনে এগুলোর দরকার আছে। স্কুলে যাওয়ার জন্য, যাওয়ার পথে, স্কুলে, স্কুল থেকে ফেরার পথে, স্কুল থেকে ফেরার পর যা যা করতে হয়, সবই আসলে ট্রেনিং। ধরা যাক, আগের রাত থেকেই স্কুলের ব্যাগটা গোছাতে হয়, জামাকাপড় রেডি করে রাখতে হয়, ঠিক সময়ে ঘুম থেকে উঠতে হয়, এগুলোরও দরকার আছে। তারপর স্কুলের কতগুলো নিয়মকানুন আছে, কী করা যাবে, কী করা যাবে না। সেসব মানাও ট্রেনিং। তোমরা যখন বড় হবে, সমাজে চলবে, তখন তো কতজনের সঙ্গে মিশতে হবে, চলতে হবে, স্কুলে যাওয়া-আসার মধ্য দিয়ে সেসবও আমরা শিখি।

তো স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় আমরা এই ট্রেনিংগুলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। আর আছে লেখাপড়া। আর আছে পরীক্ষা। পরীক্ষা না থাকলে কেই–বা পড়তে চায়। শিখতে চায়!

এখন স্কুল বন্ধ থাকায় আমাদের কিছু কিছু ক্ষতি নিশ্চয়ই হচ্ছে। কী করে আমরা সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারব। যেকোনো দুর্যোগকে সুযোগে পরিণত করে নেওয়া যায়। এসো, আমরা তা–ই করি।

বাস্তব দুনিয়া বইয়ের পড়া দিয়ে চলে না। কাজেই বইয়ের পড়ার বাইরের জগৎটাকে চিনে নেওয়ার জন্য এই সময়টাকে বেছে নাও। আবার স্কুল-কলেজের পড়া তোমাদের ভবিষ্যৎ উচ্চশিক্ষার ফাউন্ডেশন বা ভিত্তি গড়ে দেবে। কাজেই সিলেবাসের পড়াও শিখে নিতে হবে। না হলে উঁচু ক্লাসে অসুবিধায় পড়বে।

রুটিন করে রোজ স্কুল-কলেজের পড়াও পড়ো। ছবি আঁকো, ডু ইট ইয়োরসেলফ–জাতীয় কাজ করো। ছোট্ট ভিডিও বানাও, হাতের কাজ করো, দেয়ালপত্রিকা করো, ইংরেজি শেখো, বাংলা শেখো, প্রোগ্রামিং শেখো, ইংরেজি–বাংলার বাইরে অন্য কোনো ভাষা শেখো। কিছুই করতে ইচ্ছা না করলে বারান্দায় গিয়ে আকাশ দেখো। বলো, কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা, মনে মনে।

১. প্রচুর বই পড়ে ফেলো

স্কুল খোলা থাকলে রুটিন পড়াশোনার চাপে বহু বাইরের বই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পড়া যায় না। করোনার দিনগুলোতে প্রচুর বই পড়ে ফেলতে পারি আমরা।

২. যে বিষয় ভালো লাগে, সে বিষয়ে নতুন কিছু করা

ধরো, তোমার ভালো লাগে বিজ্ঞান, কিন্তু স্কুল খোলা থাকলে তো শুধু বিজ্ঞান নিয়ে মেতে থাকতে পারতে না। করোনার অবকাশ আমাদের সেই শখ পূরণের সুযোগ এনে দিচ্ছে। বিজ্ঞানের বই পড়া, প্রজেক্ট করা—এসব নিজে নিজেই করে ফেলো।

৩. ভালো ছবি দেখা

চলচ্চিত্র খুব শক্তিশালী একটা মাধ্যম। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ছবিগুলো দেখে ফেলো।

৪. তোমরা ক্লাব বানাও। বইপড়ুয়া ক্লাব, বিজ্ঞান ক্লাব, ফিল্ম ক্লাব। তোমরা নিজেদের বাড়িতে থেকেই ফোনে, অনলাইনে, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে এই ক্লাব পরিচালনা করবে। সবাই মিলে ঠিক করো, আমরা এই ১০টা বই পড়ব। এই ১০টা সিনেমা দেখব। বিজ্ঞানের এই প্রজেক্ট করব। সেসব করে তোমরা তোমাদের অভিজ্ঞতা আবার লিখে ফেলবে। বইয়ের আলোচনা বা বুক রিভিউ। তেমনিভাবে সিনেমার আলোচনা। বিজ্ঞানের প্রজেক্ট করার অভিজ্ঞতা। প্রচুর লেখো।

৫. মা–বাবার সঙ্গে গল্প করা। এটার জন্য একটা রুটিন করে নাও। রোজ বাবার সঙ্গে আধঘণ্টা গল্প করব। মায়ের সঙ্গে আধঘণ্টা। এটা কিন্তু সিরিয়াসলি করতে হবে। মানতে হবে।

৬. সংসারের কাজ করা। ঘরের কাজে মা–বাবাকে সাহায্য করো। নিজের কাজ নিজে করা শুরু করে দাও। গাছে পানি দাও। টেবিল ও বইয়ের তাক গুছিয়ে ফেলো।

৭. রোজ খেলতে হবে। দৌড়াদৌড়ি করতে হবে। সময় করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঘরের বাইরে খেলতে যাও। শীতকাল। ব্যাডমিন্টন খেলার উপযুক্ত সময়।

৮. ঠিক সময়ে ঘুমাতে যেতে হবে। ঘুমানোর সময় মোবাইল ফোন আশপাশে রাখা যাবে না। মোবাইল ফোন অন্য ঘরে রেখে ঘুমাতে যেতে হবে।

৯. খাওয়াদাওয়া ঠিকভাবে করো। মা-বাবা অনুমতি দিলে রান্নাও করতে পারো। মজা হবে।

করোনা কিন্তু অনেক কিছুই শিখিয়ে গেল আমাদের। সবাই আমরা নিয়ম করে হাত ধুচ্ছি, মেনে চলছি সামাজিক দূরত্ব। স্বাস্থ্য নিয়ে সবাই সচেতন হয়েছি আগের চেয়ে। এ বিষয়গুলো অভ্যাসে পরিণত করে ফেলতে হবে আমাদের। করোনার প্রকোপ কমে আসবে ঠিকই, কিন্তু ভবিষ্যতেও এমন ভাইরাস আবার আক্রমণ করতেই পারে। সে জন্য সব সময়ই এই অভ্যাসগুলোর চর্চা করতে হবে আমাদের। সতর্ক থাকলে কোনো ভাইরাস এভাবে আর আমাদের স্থবির করে দিতে পারবে না। তোমরা সবাই ভালো থেকো। নিরাপদে থেকো।