কবর

অলংকরণ: রাকিব রাজ্জাক

আজকাল খুব বাজে একটা অভ্যাস হয়েছে আমার। প্রতি রাতে আমাকে গোরস্থানে যেতে হয়। ‘যেতে হয়’ এ জন্য বললাম যে একধরনের আশ্চর্য শক্তি আমাকে টেনে নিয়ে যায়।

ঘটনাটা খুলে বলি। আমার এক পাড়াতুতো বয়স্ক খালাম্মা মারা যান দুই সপ্তাহ আগে। তাঁর দাফন হয়ে গেলে রাতের বেলা কবর পাহারা দেওয়ার জন্য আমি আর রফিক নামের এক বড় ভাই দায়িত্ব নিয়েছিলাম। আমাদের গ্রামের গোরস্থানটা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা নয়। শিয়াল, বনবিড়াল এগুলো থেকে কবর রক্ষার জন্য এই ব্যবস্থা।

সে রাতে প্রথম প্রথম ভয় লাগেনি। রাত একটু গাঢ় হতেই হঠাৎ দেখি অন্ধকারে কয়েকটা চোখ জ্বলজ্বল করছে। আমার আত্মা ভয়ে শুকিয়ে গেল। দেখলাম রফিক ভাইও আমার মতো ভয় পেয়েছেন। হাত নাড়ানো যাচ্ছে না। কষ্ট করে লাইটটা তুলে সেদিকে আলো ফেললাম। দেখলাম কয়েকটা শিয়াল এগিয়ে আসছে। মনের ভয় ভুস করে কেটে গেল। একটা লাঠি তুলে নিয়ে তাড়া দিলাম ওদের। একটাকে কাছে পেয়ে তো লাঠিই বসিয়ে দিলাম। শিয়ালগুলো ভয়ে পালিয়ে গেল। তারপর আর কিছু ঘটেনি। তবে একটা খটকা লাগল, লাইটের সাদা আলোয় শিয়ালগুলোকে কেমন নীল মনে হচ্ছিল। এ রকম শিয়াল আগে কখনো দেখিনি।

এ ঘটনার কয়েক দিন পরই আমার সেই অভ্যাসটা শুরু হয়। রাতের বেলায় ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যেতেই দেখি আমি ইটপোড়া একটা রাস্তা ধরে হাঁটছি। অথচ ঘুমের ঘোরে হাঁটার কোনো অভ্যাসই আমার নেই। এ রকম সময় আমার ভয় পাওয়ার কথা, কিন্তু আজব ব্যাপার, কিছুই হলো না। আমি শুধু আমার পা দুটোকে আটকানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু মনে হলো, পা একবারে অবশ হয়ে আছে।

কবরের সামনে ওরা আমাকে মাটির গন্ধ নিতে বলল। এমনকি শিয়ালগুলো আমার পাশে বসে মাটির গন্ধ নিতে শুরু করল। আমিও নিতে বাধ্য হলাম।

একসময় হাঁটতে হাঁটতে আমার পা দুটো গোরস্থানে ঢুকল। এত অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখলাম সেই শিয়ালগুলো আমার জন্য বসে আছে। একটা শিয়াল আমার দিকে এগিয়ে এল। পরে জেনেছি ও হলো শিয়ালদের নেতা। আমাকে নিয়ে সে একটা কবরের সামনে গেল। কবরের পাশে বসতে বলল। কী আশ্চর্য! আমি ওদের ভাষাও বুঝতে পারছি। পরে ওরা আমাকে বলেছিল, আমাকে নাকি ওদের খুব পছন্দ হয়েছে। তাই ওরা আমার সঙ্গে খেলতে চায়। ওরা সত্যি বলছে, নাকি আমার ওপর প্রতিশোধ নিতে চায়—তা বুঝতে পারলাম না।

কবরের সামনে ওরা আমাকে মাটির গন্ধ নিতে বলল। এমনকি শিয়ালগুলো আমার পাশে বসে মাটির গন্ধ নিতে শুরু করল। আমিও নিতে বাধ্য হলাম। এটাই নাকি ওদের খেলা। মানুষ যেমন ন্যাপথলিনের গন্ধ নিতে পছন্দ করে এই খেলায়ও একই রকম মজা। সারা রাত ধরে চলে এই খেলা। সেদিন থেকে শুরু হয়ে প্রতিরাতে যেতে হয় আমাকে। চলে সেই বিদ্‌ঘুটে খেলা। আজও যেতে হবে আমায়।

মনে হতে পারে, রাতের বেলায় বন্ধ দরজা দিয়ে আমি বের হই কীভাবে? হাত দুটো তো আর অবশ হয়ে থাকে না। আর তা ছাড়া আমি অন্যদের আমার অভ্যাসের কথা বলি না কেন? আসলে আমার ঘরের সঙ্গে বাইরে যাওয়ার একটা দরজা আছে। অভ্যাসটা শুরু হওয়ার পর সেটায় একটা বড় তালা লাগিয়েছিলাম। কিন্তু রাত গাঢ় হতেই কী এক অজানা কারণে তালা, দরজা, লকগুলো খুলে যায়। আমিও আর একমুহূর্ত ঘরে থাকতে পারি না।

আর বাড়ির অন্যদের যখনই আমার সমস্যার কথা বলতে গিয়েছি, তখনই হঠাৎ কী বলতে হবে তা ভুলে যাই। তখনই মনে হয়েছে, কাউকে বলতে না পারি, লিখে তো যেতে পারব। আজকাল লক্ষ করছি আমার গায়ের লোমগুলো নীল হয়ে যাচ্ছে, কানগুলো ওপরের দিকে সরু হয়ে আসছে। ভয় হচ্ছে, আমিও হয়তো ওই শিয়ালগুলোর মতো হয়ে যাব। হয়তো ওরাও একসময় মানুষ ছিল। শিয়াল তাড়াতে গিয়ে ওরাও জন্তু হয়ে গেছে!

আর মনে হয় লিখতে পারব না। পা দুটো অবশ হয়ে আসছে, আজ মাথাটাও খুব ব্যথা করছে। নিজের ঘরটাকে দেখে মায়া হচ্ছে—আর যদি ফিরতে না পারি! ফিরতে না পারলেও কেউ এই লেখাটা পড়বে ভেবেই স্বস্তি পাচ্ছি।