কাজীদা ছিলেন, কাজীদা থাকবেন

আঁকা: তুলি

কাজীদার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল ৩০ বছরের বেশি সময় আগে, এক খরতপ্ত দুপুরে। আমি তখন নিতান্তই এক স্কুলপড়ুয়া কিশোর, খুব সাহস করে নিজের লেখা একটি কিশোর উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি জমা দিয়েছিলাম সেবা প্রকাশনীতে। সেটাই নির্বাচিত হয়েছিল বই হিসেবে প্রকাশিত হওয়ার জন্য। আমাকে খবর পাঠানো হয়েছিল, বইটি নিয়ে কাজী আনোয়ার হোসেন আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। সেবার একনিষ্ঠ পাঠক হিসেবে কাজীদাকে না চেনার কোনো কারণ নেই, আমার চোখে তিনি এক স্বপ্নপুরুষ। বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না খবরটা। শেষ পর্যন্ত আমার বাবাকে নিয়ে ছুটে গিয়েছিলাম তাঁর কাছে। দেখা হওয়ার পর মুগ্ধতা আরও বাড়ল, অভিভূত হলাম তাঁর ব্যক্তিত্বে, তাঁর আচরণে। ছোট বলে আমাকে মোটেও অবহেলা করলেন না তিনি, বরং পরিণত এক লেখকের মতোই সম্মান দেখালেন আমাকে, লেখা নিয়ে আলোচনা করলেন আমার সঙ্গে। স্নেহ দেখালেন, বলা বাহুল্য। অদ্ভুত এক বাঁধনে সেদিনই তাঁর সঙ্গে জড়িয়ে গেলাম আমি, আজ এত বছর পরও সে বাঁধন কাটাতে পারিনি।

১৯ জানুয়ারি পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছেন কাজী আনোয়ার হোসেন...আমাদের কাজীদা। তিনি শুধু আমার প্রকাশক ছিলেন না, ছিলেন অতি আপনজন, পথপ্রদর্শক, পিতার মতো। তাই প্রচণ্ড এক কষ্টে ফেটে যেতে চাইছে বুক। তিন দশকের বেশি সময় ঘনিষ্ঠভাবে কাটিয়েছি তাঁর সঙ্গে, শুধু লেখালেখির সুবাদে নয়, জীবনের নানা চড়াই-উতরাইয়ে পাশে থেকেছি তাঁর, তিনিও ছিলেন আমার সঙ্গে। সম্পর্কটা হয়ে উঠেছিল অনেক নিবিড়। এমন একজন মানুষকে হারিয়ে জীবন কতটা শূন্য হয়ে গেল, তা বলে বা লিখে বোঝানো সম্ভব নয়।

তবে আমার ক্ষতি আর কতটুকু? কাজী আনোয়ার হোসেনের মতো একজন মানুষের বিদায়ে পুরো দেশ এবং সাহিত্যজগতের যা ক্ষতি হলো, তা বলে বোঝানো যাবে না। বহুমুখী প্রতিভা ছিলেন তিনি—একাধারে লেখক, প্রকাশক, সংগীতশিল্পী, গীতিকার, গিটারবাদক, আলোকচিত্রশিল্পী, ব্যবসায়ী, আরও কত কী! তবে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো, বইবিমুখ একটি জাতির মধ্যে পাঠের অভ্যাস গড়ে দেওয়া। সেই সঙ্গে ভারতীয় বইনির্ভর বাজারকে স্বদেশি বইয়ের বাজারে রূপান্তর করেছিলেন তিনি। নিজে যেমন দুহাতে লিখেছেন, তেমনিভাবে লিখিয়েছেন অন্যদের দিয়ে। হাতে ধরে আমার মতো লেখকদের শিখিয়েছেন, কেমন করে সহজ ভাষায় আকর্ষণীয়ভাবে লিখতে হয়। তিনি ছিলেন লেখক ও পাঠক তৈরির কারিগর। এক হাতে বদলে দিয়েছিলেন দেশের প্রকাশনাজগৎকে। সুলভ মূল্যে পাঠকদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন বিদেশি সাহিত্যের সেরা সব মণিমুক্তার বাংলা অনুবাদ। সত্তর, আশি বা নব্বইয়ের দশকে যাঁরা বড় হয়েছেন, তাঁরাই জানেন, সেবা প্রকাশনী এবং কাজী আনোয়ার হোসেন তাঁদের জীবনের কত বড় একটা অংশ জুড়ে ছিল।

কাজী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে ইসমাইল আরমান

বড়দের জন্য লেখা ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের লেখক হিসেবে কাজীদাকে চেনেন সবাই, কিন্তু তিনি যে ছোটদের জন্য কত কিছু লিখে গেছেন, তা হয়তো খেয়াল করেননি কেউ। এ ক্ষেত্রে সবার আগে আসবে তাঁর লেখা ‘কুয়াশা’ সিরিজের কথা, ওটা মূলত কিশোর পাঠকদের জন্য লেখা। দুঃসাহসী এক বাঙালি বিজ্ঞানীর রুদ্ধশ্বাস সব অভিযানের কাহিনি নিয়ে লেখা হয়েছিল সিরিজটির ৭৬টি বই। ছোটদের কথা ভেবে ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের প্রথম ১০টি বইয়েরও কিশোর সংস্করণ লিখেছিলেন তিনি। এর বাইরে ইতিকথা, ঘরের শত্রু, ফুলবাগান, ছোটকুমার, ইসকুল বাড়ি ও ক্লাস এইট নামে চমৎকার কিছু কিশোর উপন্যাস লিখে গেছেন। কিশোরদের জন্য অনুবাদ করেছেন আলেকজান্দার দ্যুমার ‌দ্য কর্সিকান ব্রাদার্স’, রাফায়েল সাবাতিনির ‌‘‌‌‌‌দ্য ব্ল্যাক সোয়ান’, ‘লাভ অ্যাট আর্মস’, রূপসী বন্দিনী, স্ট্যানলি ওয়েইম্যানের আ জেন্টলম্যান অব ফ্রান্স, ই. নেসবিটের দ্য রেলওয়ে চিলড্রেন, লরা ইঙ্গলস ওয়াইল্ডারের ‘লিটল হাউস’ সিরিজের সব বইসহ ক্ল্যাসিক আরও বহু বই। শামসুদ্দীন নওয়াব ছদ্মনামে লিখেছেন বেশ কিছু তিন গোয়েন্দার বই, যার ভেতর রয়েছে লাটসাহেব, মেলায় ঝামেলা, মুখোশ পরা মানুষ ইত্যাদি। ছাত্রছাত্রীদের উন্নয়নের জন্য লিখেছেন সঠিক নিয়মে লেখাপড়া। রবিনহুডকে নিয়ে লিখেছেন কালজয়ী এক অসাধারণ উপন্যাস। সম্পাদনা করেছেন সেবা থেকে প্রকাশিত কিশোর পত্রিকা। সবই ছোটদের জন্য। প্রতিষ্ঠিত অনেক শিশু-কিশোর সাহিত্যিকের ঝুলিতেও এত অর্জন নেই।

মনের দিক থেকে চিরনবীন ও চিরকিশোর এক মানুষ ছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ছোটবেলায় পড়া বিভিন্ন রহস্য ও অ্যাডভেঞ্চারের বই তাঁকে এতই প্রভাবিত করেছিল যে সে মোহের জাল কেটে বেরোতে পারেননি কোনো দিন, মনটা আটকা পড়ে গিয়েছিল কৈশোরে। খুব কাছ থেকে তাঁকে দেখেছি বলে জানি, কথাটা কতটা সত্যি। সুন্দর, সতেজ, উদার একটি মন ছিল তাঁর, এগিয়ে থাকতেন সময়ের চেয়ে অনেকখানি আগে। তারই ফলে আজ বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়ে আছে অসাধারণ সব অনুবাদে, রহস্য-রোমাঞ্চ কাহিনিতে।

আমাদের দুর্ভাগ্য, জীবদ্দশায় তাঁর এত সব অবদানের সঠিক মূল্যায়ন হয়নি রাষ্ট্রীয়ভাবে বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। কিন্তু পাঠকদের তরফ থেকে ঠিকই মূল্যায়িত হয়েছেন তিনি। সিক্ত হয়েছেন তাঁদের ভালোবাসায়, তাঁদের অনুরাগে। আর সে কারণেই কাজীদা অতীতে যেমন ছিলেন, ঠিক তেমনি দূর ভবিষ্যতেও থাকবেন—আমাদের হৃদয়ের ভেতর।