কালুরঘাট ব্রিজের চেকপোস্টে

অলংকরণ: সাঈফ মাহ্‌মুদ

২৭ মার্চ ১৯৭১, সকাল।

থেমে গেল তানিয়াদের গাড়ি। চেকপোস্ট। এগিয়ে এল এক পাকিস্তানি সৈনিক। গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘ডান্ডি কার্ড কাঁহা হ্যায়, মুঝে দেখাও।’

আশপাশে তাকালেন তানিয়ার বাবা। বাবা বসে আছেন চালকের আসনে। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে পাকিস্তানি সৈনিক। ঘাড়ে রাইফেল। একটু দূরে রাইফেল তাক করে তাকে কাভার করে আছে কয়েকজন সৈনিক।

অপারেশন সার্চলাইটের নামে পুরো পূর্ব বাংলায় খুনোখুনি শুরু করেছে পাকিস্তানিরা। এই খুনিদের আবার ডান্ডি কার্ড দেখাতে হবে!

কিছুই করার নেই।

চট্টগ্রামেও পাকিস্তানিদের গুলিতে নিহত হয়েছেন অনেক বাঙালি। মার্চের প্রথম থেকেই শুরু হয়েছে ওই পরিকল্পিত খুনোখুনি। পাকিস্তানি সেনাদের ছত্রচ্ছায়ায় বিহারিরাও বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। খুনোখুনির সঙ্গে লুটপাটও চালাচ্ছে নির্বিচার। দেশজুড়ে তাণ্ডব।

তানিয়ারা ছিল চট্টগ্রাম শহরে। আজ সকালে তানিয়ার বাবা বললেন, ‘এভাবে তো থাকা যাবে না। এখানে আমরা নিরাপদ নই। যেকোনো সময় বিহারি আর পাকিস্তানি সৈনিকেরা আসতে পারে। কোথায় যাব বুঝতে পারছি না।’

দাদু বললেন, ‘আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে।’

বুদ্ধির কথা শুনে সবাই তাকাল দাদুর মুখের দিকে। বুক পর্যন্ত সাদা দাড়ি দাদুর। মাথায় ধবধবে সাদা টুপি। দুদিন ধরে দাদুকে খুব চিন্তিত দেখছে সবাই।

বাবা জানতে চাইলেন, ‘কী বুদ্ধি?’

দাদু বললেন, ‘হাফেজ মামুর আস্তানা নিরাপদ হতে পারে।’

হাফেজ মামুকে কে না চেনে। শাহ সাহেব নামেও পরিচিত। তবে তার আসল নাম মাওলানা হাফেজ আহমদ। সাতকানিয়ার চুনতিতে থাকেন।

যুক্তি দেখালেন দাদু, ‘হাফেজ মামুর আস্তানায় নিশ্চয়ই পাকিস্তানি সৈন্যরা আক্রমণ করার সাহস পাবে না।’

এতক্ষণে মুখ খুললেন মা, ‘ওদের বিশ্বাস নেই। যারা নিরীহ মানুষ খুন করতে পারে, তারা যেকোনো কিছু করতে পারে। তাদের কাছে পীরই কী আর কৃষকই কী! সব বাঙালিই সমান।’

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন দাদু। তানিয়ার মায়ের কথাও ঠিক। ঢাকার খবর জেনেছেন তারা। নির্বিচার খুনোখুনি করেছে। মানুষ এতটা নিষ্ঠুর হয় কী করে!

বাবা বললেন, ‘আপাতত হাফেজ মামুর আস্তানায় কিছুদিন লুকিয়ে তো থাকা যাবে। তারপর পরিস্থিতি দেখে–বুঝে পরে যা করার করা যাবে।’

মাথা নেড়ে সায় জানালেন দাদু, ‘ঠিকই বলেছ খোকা। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন। আমাদের বেঁচে থাকার মতো শক্তি দিন। আমিন।’

বাবা বললেন, ‘তাহলে সময় নষ্ট করা যাবে না। সবাই চটপট তৈরি হয়ে নাও। শুনেছি আশপাশে কিছু বিহারি ঘাপটি মেরে আছে। সুযোগের অপেক্ষায় আছে। যেকোনো সময় আমাদের দিকে আসতে পারে। চুনতি গিয়ে আগে প্রাণ বাঁচাই।’

চটপট তৈরি হয়ে গাড়িতে গিয়ে বসল সবাই। বাবা বসলেন চালকের আসনে। পাশে দাদু। পেছনে মা, তানিয়া আর তানিয়ার ছোট ভাই জামাল।

আগেও এ রকম গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ত তানিয়ারা। তখন ছিল বেড়ানোর আনন্দ। আজ আতঙ্ক। কখন কী হয়, কিছুই বলা যায় না। পঁচিশে মার্চের পর থেকে গোলাগুলির শব্দ লেগেই আছে। কোথায় যে কী হচ্ছে, কিছুই জানে না ওরা। জানার উপায়ও নেই। জানতে গেলেই বিপদ।

গাড়িতে ওঠার আগে আয়াতুল কুরসি পড়ে সবার গায়ে ফুঁ দিয়েছেন দাদু। তবু কারও মন থেকেই ভয় দূর হয়নি। সবার আশঙ্কা, রাস্তায় যদি পাকিস্তানি সৈন্যরা আটকায়, তাহলে কী হবে? কিংবা যদি বিহারিরা গাড়িতে ইটপাটকেল ছোড়ে? যদি লুটপাট করে?

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক ধরে চুনতির পথে চলতে লাগল গাড়ি। ওই তো সামনে কালুরঘাট ব্রিজ দেখা যাচ্ছে। ব্রিজটা পেরোতে হবে। হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে দিলেন বাবা।

একি! সামনে যে গাড়ির বিশাল লাইন। এত লাইন কেন?

মা জানতে চাইলেন, ‘এত লাইন কিসের?’

বাবা বললেন, ‘সামনে চেকপোস্ট।’

‘এখানে আবার চেকপোস্ট বসাল কেন?’

মায়ের এ কথার জবাব পাওয়া গেল গুলির শব্দে। পরপর দুটি গুলির শব্দ হলো। তারপর শব্দ ভেসে এল কান্নার।

দাদুর মুখ নড়তে লাগল। বিড়বিড় করে সুরা পড়তে লাগলেন তিনি। গাড়ির সবাই চুপ। এতক্ষণ গরম লাগছিল। এখন সেটাও লাগছে না। আতঙ্কে সবার মেরুদণ্ড ঠান্ডা হয়ে গেছে। জামালের দিকে তাকাল তানিয়া। ওর চোখ দুটো বড় হয়ে গেছে। অন্য সময় হলে প্রশ্ন করে করে হয়রান করে ফেলত এতক্ষণে। ও পর্যন্ত তালা মেরে আছে মুখে।

উল্টো পাশ থেকে আসা একটা গাড়ি হুশ করে চলে গেল। ওই গাড়ি থেকেও কান্নার শব্দ পেল ওরা।

অস্থিরভাবে সামনে তাকিয়ে আছেন বাবা। কী করবেন বুঝতে পারছেন না। দাদুর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, ‘নেমে দেখে আসব?’

দাদু বললেন, ‘না। স্থির হয়ে বসে থাকো। এ সময় নিজেকে স্থির রাখা দরকার।’

চুপ করে রইলেন বাবা। বাবার মুখটা সরাসরি দেখতে পাচ্ছে না তানিয়া। ইন্টেরিয়র মিরর দিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন। মনে হলো নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করছেন বাবা।

ততক্ষণে সামনের গাড়িটা অনেকখানি এগিয়েছে। গাড়ি ঘোরানোর মতো যথেষ্ট জায়গা পাওয়া গেছে। সুযোগটা কাজে লাগাতে চাইলেন বাবা। দাদুর দিকে ফিরে আবার জানতে চাইলেন, ‘গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে যাই?’

দাদুর কঠিন মুখটা দেখতে পেল তানিয়া। দাদু বললেন, ‘না। এখন ঘুরে গেলে ওরা আরও বেশি সন্দেহ করবে। বিপদ বাড়বে। তা ছাড়া কোথায় যাবে? যেখানেই যাবে, সেখানেই তো হিংস্র শকুনের থাবা। বরং যেখানে যাওয়ার নিয়ত করে বেরিয়েছি, সেখানেই চলো। আল্লাহ যদি হায়াত রাখেন তো বাঁচব। ভয় পেলে চলবে না।’

বলেই আগের চেয়ে শব্দ করে দোয়া পড়তে লাগলেন দাদু।

একটু একটু করে ব্রিজের অনেকখানি সামনে এগিয়ে গেল ওদের গাড়ি। চেকপোস্টের সামনে আসা প্রতিটি গাড়ি থামিয়ে জেরা করছে পাকিস্তানি সৈন্যরা। যাকেই সামান্য সন্দেহ হয়, তাকেই নিয়ে যাচ্ছে আড়ালে।

দাদু আর মায়ের মুখ নড়ছে খুব দ্রুত। দোয়া-দরুদ পড়ছেন তাঁরা। ওদিকে অসহায় ভঙ্গিতে তখনো পকেট হাতড়ে যাচ্ছেন বাবা। এদিক–ওদিক মাথা ঘুরিয়ে সবাইকে দেখছে তানিয়া। কিন্তু কোনো কথা বলছে না।

আরও কয়েকজনকে আড়ালে নিয়ে যেতে দেখল ওরা। নিয়ে যাওয়ার পরই আড়াল থেকে গুলির শব্দ শুনতে পেল। আর শুনতে পেল আর্তনাদের শব্দ। সঙ্গী-স্বজনদের কান্নার শব্দ। সব মিলে অদ্ভুত এক ভয়ংকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে কালুরঘাট ব্রিজের গোড়ায়। সুস্থ মানুষকেও অসুস্থ করে তুলছে। শিশুদের কান্নার শব্দও শোনা যাচ্ছে। ভাগ্যিস, জামাল কান্না করছে না।

ঘাবড়ে গেলেন মা। ফিসফিস করে জানতে চাইলেন, ‘কী হচ্ছে ওখানে?’

বাবা বললেন, ‘যাদেরই সন্দেহ হচ্ছে, তাদেরই আড়ালে নিয়ে যাচ্ছে।’

‘আড়ালে কেন?’

‘গুলির শব্দ শুনতে পাচ্ছ না?’

‘আড়ালে নিয়ে গুলি করে খুন করছে?’

মায়ের এ কথার জবাব দেওয়ার সময় পেলেন না বাবা। সামনের গাড়িটা ব্রিজের ওপর উঠে যাচ্ছে। এবার তানিয়াদের জেরা করার পালা।

গাড়িটা ধীরে ধীরে একটু এগিয়ে নিলেন বাবা। তারপর থামার ইশারা পেয়েই গাড়ি থামিয়ে দিলেন। এগিয়ে এল এক সৈনিক। চালকের আসনে বসা বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ঝুঁকে উঁকি দিল গাড়ির ভেতর। সৈনিকটির চোখের দিকে তাকাল তানিয়া। রাগে লাল চোখ দুটো। উদ্ধত। বাঙালিদের প্রতি তীব্র ঘৃণা যেন উপচে পড়ছে দুচোখে। পেছনে আসনে বসা সবাইকে দেখে নিল গভীর মনোযোগ দিয়ে। তারপর তাকাল সামনের আসনে বসা দাদুর দিকে। দাদুকে দেখার পর মনে হলো দুচোখের উদ্ধত ভাব কিছুটা কমেছে।

কর্কশ কণ্ঠে জানতে চাইল, কোথায় যাচ্ছেন?’

বাবা জবাব দিলেন, ‘সাতকানিয়া।’

‘কেন?’

‘অফিসের কাজে।’

‘কী অফিস?’

নিজের পরিচয় দিলেন বাবা। বাবা ভেবেছিলেন, সরকারি অফিসার শুনলে আর আটকাবে না। কিন্তু চলে যাওয়ার ইশারা দিল না। কিছু না বলে রাস্তার ওপারে দাঁড়ানো আরেক সৈনিকের কাছে চলে গেল। কিছুক্ষণ সলাপরামর্শ করল দুই সৈনিক। পরামর্শ শেষে আবার এসে দাঁড়াল বাবার পাশে। এবার আর ঝুঁকল না। দাঁড়িয়ে থেকেই গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘ডান্ডি কার্ড কাঁহা হ্যায়, মুঝে দেখাও।’

পকেট হাতড়াতে শুরু করলেন বাবা। সরকারি নির্দেশনা আছে, ঝামেলা এড়াতে সরকারি কর্মীরা সব সময় যেন আইডেন্টিটি কার্ড সঙ্গে রাখে।

এ–পকেট ও–পকেটে হাত ঢুকিয়ে খুঁজতে লাগলেন বাবা। তানিয়া জানে, বাবা কেবল একটা মিথ্যা কথা বলেছেন। তিনি অফিসের কাজে যাচ্ছেন না। যাচ্ছেন প্রাণ বাঁচাতে। কিন্তু সেটা তো বলা সম্ভব নয়। সেটা বললে কী হবে, তা ওরা নিজেদের চোখেই দেখেছে। পাকিস্তানি সৈন্যরা আড়ালে নিয়ে যাবে বাবাকে। তারপর? সেটাও ওরা শুনেছে। গুলির শব্দ। আর্তনাদ। কান্না। চিৎকার। হাহাকার।

কিন্তু কোথায় পরিচয়পত্র? নেই। কোনো পকেটেই পরিচয়পত্র খুঁজে পেলেন না বাবা। বিড়বিড় করে বললেন, ‘ভুলে ফেলে এসেছি।’

তানিয়া বুঝল, তাড়াহুড়া করে আসতে গিয়ে পরিচয়পত্রটা ভুলে বাসায় রেখে এসেছেন বাবা।

ওদিকে বড্ড অস্থির হয়ে উঠেছে সৈনিকটা। পরিচয়পত্র পাওয়ার আশায় বাবার দিকে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। চটপট না পেয়ে লাল হতে শুরু করেছে তার চেহারা। ভাগ্যিস, এখনো রেগে যায়নি। কখন রেগে যায়, তারও ঠিক নেই।

কিন্তু বাবার কাছে তো পরিচয়পত্র নেই। এখন উপায়?

দাদু আর মায়ের মুখ নড়ছে খুব দ্রুত। দোয়া-দরুদ পড়ছেন তাঁরা। ওদিকে অসহায় ভঙ্গিতে তখনো পকেট হাতড়ে যাচ্ছেন বাবা। এদিক–ওদিক মাথা ঘুরিয়ে সবাইকে দেখছে তানিয়া। কিন্তু কোনো কথা বলছে না। এমনিতেই খুব চুপচাপ ধরনের মেয়ে ও। দুমাস আগে ওর দশম জন্মদিনটা একটু ঘটা করেই হয়েছিল। আসলে তানিয়ার জন্মদিনটা ছিল একটা উপলক্ষমাত্র। বাবা খুশি ছিলেন অন্য কারণে। নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় যাচ্ছে বাঙালিরা। এই তো আর অল্প কয়েকটা দিন। পাকিস্তানিদের হুকুম নির্দেশের দিন শেষ হবে। সুদিনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে নির্যাতিত বাঙালি। কিন্তু হঠাৎ করে সুদিনের বদলে এ রকম ভয়াবহ দুর্দিন নেমে আসবে—স্বপ্নেও ভাবেনি কেউ। বাঙালির সুখস্বপ্ন রাতারাতি দুঃস্বপ্ন হয়ে গেল।

তাই তো! উল্টো করে ধরেই একের পর এক পাতা উল্টে যাচ্ছে ওই সৈনিক। পাতা ওলটানোর সময় কী গভীর মনোযোগ তার! শুধু তা–ই নয়, একটা করে পাতা ওলটায় আর ঘাড় নাড়ায়। যেন সবকিছু বুঝতে পারছে।

কিছুদিন ধরে বড়দের কথা শুনছে তানিয়া। না শুনেই–বা উপায় কী! বড়দের এখন আলোচনার বিষয় তো ওই একটাই। তানিয়াও বুঝতে পারছে, দেশের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। পাকিস্তানিরা বড্ড ঝামেলা পাকাচ্ছে। তাতেও কিছু করতে না পেরে এখন বাঙালিদের খুন করতে এসেছে।

হঠাৎ মুখ খুলল তানিয়া। ফিসফিস করে বাতলে দিল উপায়, ‘বাবা, তোমার ডায়েরিটা দেখিয়ে দাও।’

তানিয়ার কথায় যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল বাবার মাথায়। ঝিলিক দিয়ে উঠল বুদ্ধি। আরে! তাঁর পকেটে তো সব সময় একটা ডায়েরি থাকে। তবে ওটা ঠিক ডায়েরি নয়। নোটবুক। না। নোটবুকও নয়। ফোনবুক। ওটায় তিনি জরুরি ফোন নম্বর ও ঠিকানা লিখে রাখেন। তানিয়া জানে, তার ভুলোমনা বাবা জুতা পরতে ভুলে গেলেও, কখনো ফোনবুক নিতে ভোলেন না।

শার্টের বুকপকেটে হাত দিতেই ফোনবুকটা চলে এল বাবার হাতে। তারপর সেটা বাড়িয়ে দিলেন ওই সৈনিকের দিকে।

ফোনবুকে যা কিছু লেখা, সবই ইংরেজিতে।

ফোনবুক হাতে নিয়ে গম্ভীরভাবে পাতা ওলটাতে লাগল সৈনিকটি। ওটা দেখে ফিক করে প্রায় হেসেই ফেলেছিল তানিয়া। চট করে নিজেই নিজের ডান হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। তারপর ফিসফিস করে বাবাকে বলল, ‘ও ব্যাটা ইংরেজি পড়তে জানে না। দ্যাখো ফোনবুকটা উল্টো করে ধরেছে!’

তাই তো! উল্টো করে ধরেই একের পর এক পাতা উল্টে যাচ্ছে ওই সৈনিক। পাতা ওলটানোর সময় কী গভীর মনোযোগ তার! শুধু তা–ই নয়, একটা করে পাতা ওলটায় আর ঘাড় নাড়ায়। যেন সবকিছু বুঝতে পারছে।

এটা দেখে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এল সবার। মনে হচ্ছে বিপদ কেটে গেছে।

কিন্তু বিপদ কখনো কখনো ছোটগল্পের মতো, শেষ হয়েও শেষ হয় না।

ফোনবুকটা নেড়েচেড়ে বাবার দিকে ঝুঁকল সৈনিকটা। জানতে চাইল, ‘লেকিন, তাসবির কিধার হ্যায়?’

এটা কোনো প্রশ্ন হলো?

তবে একটু আগেও এই প্রশ্নে ঘাবড়ে যেতেন বাবা। ঘাম ছুটত শরীরে। কিন্তু বুদ্ধিমত্তার যে গলিপথ তানিয়া দেখিয়েছে, সে পথ ধরে এগিয়ে বাবা এখন বুদ্ধিমত্তার মহাসড়কে এসে পড়েছেন। ঝিলিক দেওয়া বুদ্ধিগুলো এখন কেবল তাকে পথ দেখিয়েই যাচ্ছে। চটপট গম্ভীর মুখে জবাব দিলেন বাবা, ‘এ আইডি কার্ড নতুন দেওয়া হয়েছে। সে কারণে এখনো ছবি লাগাতে পারিনি।’

বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ল পাকিস্তানি মূর্খটি। সৈনিকসুলভ নির্দেশ দিল, ‘শিগগিরই ছবি লাগিয়ে নেবেন।’

তারপর এগিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিল।

কালুরঘাট ব্রিজ দিয়ে কর্ণফুলী পেরিয়ে ওরা চলতে লাগল সাতকানিয়ার দিকে। কিছু সময়ের জন্য হলেও সবার বুক থেকে পাথর সরে গেছে।

সতর্ক দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন বাবা। বাকিরা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। আর মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করছে জননী জন্মভূমির অপরূপ সৌন্দর্য।