ক্যাম্প ডায়েরি

বিএনসিসির ক্যাডেট হিসেবে প্রথমবারের মতো ক্যাম্প করতে যাচ্ছি। খুলনার সরকারি এম এম সিটি কলেজ থেকে সুন্দরবন রেজিমেন্টের হেডকোয়ার্টারের উদ্দেশ্যে সাত সহপাঠীসহ রওনা দিলাম আমি। এই হেডকোয়ার্টারটা শিরোমণিতে অবস্থিত। বিএনসিসির ভাষায় আমরা ছিলাম ৫ জন পুরুষ ও ৩ জন নারী। ক্যাম্পে প্রথমবারের মতো যেতে পারার উচ্ছ্বাস আমাদের সবার মুখেই ফুটে উঠছিল। ক্যাম্পে পৌঁছালাম সকাল ১০ টায়। রেজিমেন্টের মাঠে অস্থায়ীভাবে আমাদের জন্য তাঁবু তৈরি। প্রবেশমুখের সব আনুষ্ঠানিকতা সেরে সেখানে অবস্থান নিলাম আমরা। মেয়েরা উঠল রেজিমেন্টের পাকা ভবনে।

প্রথম দিন আমাদের বাকি ছয় দিন কিভাবে কী করতে হবে, তার দিকনির্দেশনা এবং ক্যাম্পের বিভিন্ন দায়িত্ব বণ্টনের মধ্য থেকেই অতিবাহিত হলো। পরদিন ভোর ৫টা ৩০ মিনিটে ঘুম থেকে উঠলাম। ঘুম ঘুম চোখে ড্রিলের জন্য ক্যাডেট ড্রেস পরলাম। ৬টা ৩০ মিনিটের মধ্যে শেষ করলাম সকালের নাশতা। খাবার বণ্টনের দায়িত্ব ছিল আমার কাঁধে। সবাই যখন ঘুম থেকে উঠত, আমার তখন খাবার বণ্টনের নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান নিতে হতো।

ক্যাম্পে মজার বিষয় ছিল, আমরা সব ক্যাডেট যখন একত্র হতাম, তখন কমান্ডার স্যারের বক্তব্যের মাঝে মাঝে আমাদের চিৎকার করে ‘ইয়েস স্যার’ বলা।

তারপর ৭টা ১৫ মিনিটের মধ্যে অস্ত্রসহ ড্রিলের জন্য লাইনআপ করে ৯টা পর্যন্ত ড্রিল করা। ৯টা ১৫ মিনিট থেকে ১৫ মিনিটের বিরতি। এরপর ৯টা ৩০–এ সেনাবাহিনীর বিভিন্ন বিষয়ে দীক্ষা গ্রহণের ক্লাসে উপস্থিত হওয়া আর ঘুম ঘুম চোখে সামরিক প্রশিক্ষকদের লেকচার শোনা। মাঝেমধ্যে ঘুমিয়ে পড়লে অন্য ক্যাডেটদের কলমের খোঁচা তো আছেই। এভাবেই ১২টা পর্যন্ত কাটিয়ে দেওয়া। মাঝখানে অবশ্য হালকা নাশতার ব্যবস্থা থাকত। বেলা ২টার মধ্যে গোসল, খাওয়াদাওয়া শেষে সামান্য বিশ্রাম জুটত কি জুটত না, ৩টার মধ্যে আবার লাইনআপ। এবং ৫টা পর্যন্ত খেলাধুলা করা। ৫টার সময় তাঁবুতে ফিরে রাতের খাবার সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটের মধ্যে শেষ করা। এবং সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়া। রাত ১০টা পর্যন্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ এবং উপভোগ করে তাঁবুতে ফিরে ১১টার মধ্যে ঘুম। আর সারা দিনের ক্লান্তিতে বিছানায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুম। বিছানা কিন্তু বাসার মতো নরম ছিল না, মাটির ওপর খড় আর তার ওপর মোটা কম্বল আর বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া চাদরের আস্তরণ। ঘুমটা ভালোই হতো। ক্যাম্পের নিত্যদিনের রুটিনের বাইরে এক দিন আমাদের সবাইকে, অর্থাৎ ক্যাম্প করতে আসা ১২০ জন সিনিয়র ক্যাডেটকে নিয়ে যাওয়া হয় শহর থেকে অনেক দূরে সেনাবাহিনীর ফায়ারিং গ্রাউন্ডে আমাদের অস্ত্র চালনা শেখানোর জন্য এবং প্রত্যেককে পাঁচ রাউন্ড ফায়ার করার সুযোগ দেওয়া হয় প্রায় ১৫০ মিটার দূর থেকে একটি নির্দিষ্ট বোর্ড লক্ষ্য করে। একটা গুলিও বোর্ডে লাগাতে পারছিলাম না। তারপরও প্রথমবারের মতো অস্ত্র চালনার অভিজ্ঞতা আর কম ছিল না। সারা দিন প্রখর রোদের তাপ, গরম বালুতে ক্রল করা কম কষ্টের ছিল না।

আমরা সৌভাগ্যবানও বটে, কারণ আমাদের ব্যাচের আগের ৩ ব্যাচে ফায়ারিংয়ের দীক্ষা দেওয়া হয়নি। আমাদের সময় থেকে নতুন করে আবার চালু করা হয়। সারা দিনের বারুদের পোড়া গন্ধ আর অস্ত্রের ঝনঝনানি অন্য রকম আবহের সৃষ্টি করে। ক্যাম্পে মজার বিষয় ছিল, আমরা সব ক্যাডেট যখন একত্র হতাম, তখন কমান্ডার স্যারের বক্তব্যের মাঝে মাঝে আমাদের চিৎকার করে ‘ইয়েস স্যার’ বলা। ক্যাম্পের চতুর্থ দিন একটা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির শিকার হই। দুপুরের খাবার শেষ করে মাঠে যাওয়ার কথা থাকলেও সেদিন যাইনি, তাঁবুর ভেতর শুয়ে ছিলাম আর সেদিন তাঁবু পর্যবেক্ষণে আসেন সামরিক প্রশিক্ষক। আর এসেই আমাকে তাঁবুর ভেতর দেখে ঘুম থেকে টেনে তুলে শাস্তি দিলেন ২০ বার পুশআপ, সঙ্গে পাঁচবার গ্রাউন্ড রানআপ। পরে অবশ্য গ্রাউন্ড রানআপ মওকুফ করে দেন। রাতে হঠাৎ কোনো ভুলের জন্য ক্যাম্পসুদ্ধ সবার শাস্তি খাওয়া, রাতে ক্যাম্প পাহারা দেওয়া, দীক্ষা ক্লাসে ঘুমানো, প্রশিক্ষণে গিয়ে ছবি তোলা, আমার কাঁধে হাত রেখে কমান্ডার স্যারের সঙ্গে ছবি তোলা—এমন হাজারো স্মৃতি জমা হতে হতে ২৩ অক্টোবর দিনটি উপস্থিত হয়, অর্থাৎ ক্যাম্পের শেষ দিন৷ সেদিন ক্যাম্প গালা নাইটের (আনন্দোৎসব) আয়োজন করা হয়। ওই দিন রাতে কিছুটা আনন্দ করতে পেরেছিলাম কিন্তু ক্যাম্প ছেড়ে আবার বাসভূমে ফেরত আসার যেমন আনন্দ কাজ করছিল, তেমনি ক্যাম্পের স্মৃতিগুলোও বেদনা বাড়িয়ে দিচ্ছিল। তবে কমান্ডার স্যারের কথায়, ‘ক্যাম্পে যে দীক্ষা গ্রহণ করেছ তোমরা, সাধারণ জীবনে এমন রুটিন মাফিক চললে জীবনে সমৃদ্ধি লাভ করতে পারবা।’ কিছুটা আশ্বস্ত হতে পেরেছিলাম এবং সাধারণ জীবনে ক্যাম্পের স্মৃতিগুলো ধারণ করে যাচ্ছি।