গল্পগুলো ফিরে আসার

শচীন টেন্ডুলকার

‘পিছিয়ে পড়েও দমে না গিয়ে অধ্যবসায়ের মাধ্যমে ফেরত আসা’—এমন কঠিন বাক্যব্যঞ্জনের চেয়ে জীবনের উত্থান-পতনকে বরং কবীর সুমনের গানের সঙ্গে তুলনা করাই বেশি সহজ। সুমনের সেই বিখ্যাত গানের পঙ্‌ক্তি, ‘কখনো সময় আসে, জীবন মুচকি হাসে/ ঠিক যেন পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা/ অনেক দিনের পর, মিলে গেছে অবসর/ আশা রাখি পেয়ে যাব বাকি দু’আনা।’

ক্রিকেটে এমন ফিরে তাকানোর গল্প নেহাত কম নয়। শেন ওয়ার্ন থেকে শচীন টেন্ডুলকার, ইয়ান বোথাম থেকে হালের দিনেশ কার্তিক—প্রায় সব ক্রিকেটারের জীবনেই এই লড়াইয়ের গল্প আছে একটা বিশাল অংশজুড়ে। এই তালিকায় কিংবদন্তি ক্রিকেটারের সংখ্যা দেখলে মনে হয়, জীবন ও ভাগ্যের সঙ্গে এমন কঠিন লড়াই ছাড়া বোধ হয় গ্রেটনেস এসে ধরা দেয় না।

পরিশ্রম ও সংযম—এ দুটির দিক থেকে দেখলে এ তালিকায় সবচেয়ে মহৎ গল্পটি শচীন টেন্ডুলকারের। একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে টেন্ডুলকারের ক্যারিয়ারের েশষটা অনেকবারই লেখার চেষ্টা করেছেন সমালোচকেরা। প্রায় প্রতিবার আগের চেয়েও প্রবল প্রতিপত্তি নিয়ে ফেরত এসেছেন ক্রিকেটের লিটল মাস্টার। তবে সবগুলোর মধ্যে যেবার টেন্ডুলকারের ফেরাটা প্রায় দৈবচীয় কোনো কিছুর সঙ্গে তুলনা করা যায়, সেটা ২০০৪ সালে।

এই ঘটনার প্রায় দেড় বছর আগে, ২০০২ সালের নভেম্বরে ইডেন গার্ডেন্সে ১৭১ রানের এক দুর্দান্ত ইনিংস খেলেছিলেন টেন্ডুলকার, যা তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ারের ৩১তম সেঞ্চুরিও। এরপর যা শুরু হলো, সেটাকে বোধ হয় টেন্ডুলকারের জীবনের সবচেয়ে পীড়াদায়ক রানখরা বলা যায়। চেষ্টা করেও ধারাবাহিক রান পাচ্ছিলেন না তিনি, সেঞ্চুরি তো বেশ দূরের কথা। সে সময়কে আরও কঠিন করতে সমালোচকদের ‘নিজের থেকে কেন এখনো বিদায় নিচ্ছেন না’—এমন প্রশ্নবাণ তো আছেই।

২০০৪ সালের জানুয়ারিতে সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পঞ্চম টেস্টে নামার আগে টেন্ডুলকার আগের ইনিংসগুলোয় করেছিলেন যথাক্রমে ০, ১, ৩৭, ০ ও ৪৪ রান। সমালোচকেরা তখন উঠেপড়ে লেগেছেন তাঁর পিছে। তারপরই সবাইকে চুপ করে দিয়ে টেন্ডুলকারের সেই ২৪১ রানের ইনিংস, যেটিতে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন নিজের সবচেয়ে প্রিয় শট কভার ড্রাইভকে। সহজাত খেলার প্রবৃত্তিকে আটকে রেখে এত বিশাল ইনিংস খেলা কেন প্রায় মহাকাব্যের পর্যায়ে পড়ে, তা যেকোনো ক্রিকেটবোদ্ধাকে জিজ্ঞেস করলেই বোঝা যায়। এরপর আরও সাত বছর টেন্ডুলকারকে পেয়েছে টেস্ট ক্রিকেট, বিশ্ব দেখেছে আরও ২০টি টেস্ট সেঞ্চুরি।

শেন ওয়ার্ন

ইয়ান বোথামের গল্পটা হয়তো এত কঠোর সাধনার নয়। তবে ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠে সাফল্য পাওয়ার হিসাব করলে ১৯৮১ সালের অ্যাশেজে ইয়ান বোথামের পারফরম্যান্স একদম শুরুর দিকেই থাকবে। সেই অ্যাশেজের প্রথম টেস্টে অধিনায়ক বোথামের ইংল্যান্ড বেশ বাজেভাবে নাস্তানাবুদ হয় অস্ট্রেলিয়ার কাছে। দ্বিতীয় টেস্টে তাঁর দল ড্র করলেও বোথাম দুই ইনিংসেই একেবারে ডাব্বা মেরে সাজঘরে ফেরেন। ফলাফল, তৃতীয় টেস্টেই অধিনায়কের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি। এটিই বোধ হয় তাতিয়ে দেয় বোথামকে। এর পরের তিন টেস্টে যা করলেন, তাতে সিরিজের নামই হয়ে গেল বোথাম’স অ্যাশেজ। পরপর দুটি ঝোড়ো সেঞ্চুরি, সেই বিখ্যাত ১ রানে ৫ উইকেট নেওয়ার স্পেল—সবকিছু মিলিয়ে পরের টেস্টগুলো প্রায় একক নৈপুণ্যে জিতিয়ে দেন দলকে।

ইংল্যান্ডের কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান গ্রাহাম গুচের ফেরাটাও প্রায় একই রকম চমকপ্রদ। ১৯৮৯ সালের অ্যাশেজ সিরিজে অস্ট্রেলিয়ান বোলারদের হাতে নাস্তানাবুদ হয়েছিলেন প্রায় সব ইংলিশ ব্যাটসম্যান। পাঁচ টেস্টে গুচ ২০ গড়ে করেছিলেন মাত্র ১৮৩ রান। সবাই খারাপ করলেও আলোচনা সবচেয়ে বেশি হয়েছিল গুচকে নিয়েই।

এর কারণ খুঁজে পাওয়া যায় গুচের দৃষ্টিকটু আউটগুলোর মধ্যে। সিরিজে প্রায় প্রতি ইনিংসেই এলবিডব্লিউ, যাতে লেগ সাইডে খেলায় দুর্বলতা খুবই স্পষ্ট। এতটাই বাজে অবস্থা ছিল যে ইংলিশ ব্যাটিং লাইনআপের অন্যতম ভরসা হওয়ার পরও তাঁকে পঞ্চম টেস্টে দল থেকে বাদ পড়তে হয়েছিল।

১২ মাস পর আইসিসির র৵াঙ্কিংয়ে সেই গুচই বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পরের অ্যাশেজেই তিন টেস্টে করলেন ৭৫২ রান। গড় ১২৫। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি গুচকে।

সঙ্গীদের কাঁধে ভর করে এমন অনেকবার মাঠ ছেড়েছেন মাশরাফি

এমন গল্প আছে শেন ওয়ার্নের জীবনেও। ২০০৩ বিশ্বকাপের মাঝে ডোপ টেস্টে ফেল করে ১২ মাসের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে দেশে ফিরতে হয়েছিল তাঁকে। ৩৪ বছর বয়সী ওয়ার্নের এরপর আর ফেরার সম্ভাবনা নেই—এমনটাই মনে হওয়া তখন স্বাভাবিক। তার ওপর দলে তাঁর বিকল্প স্টুয়ার্ট ম্যাকগিলও ভালোই খেলছেন। কিন্তু স্বাভাবিক চিন্তাভাবনাকে অস্বাভাবিক করে তোলাই বোধ হয় সাধারণ থেকে অসাধারণ হওয়ার প্রধান শর্ত। ২০০৪ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে দলে ফিরতেই তিন টেস্টে ওয়ার্ন তুলে নিলেন ২৬টি উইকেট। এর পরের বছরে ৯৬টি উইকেট তুলে নিলেন, যা এক বছরে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারের বিশ্ব রেকর্ডও।

তবে লড়াইয়ের গল্পগুলোর মধ্যে যেটি নির্দ্বিধায় এ দেশের মানুষের সবচেয়ে প্রিয়, সেটি মাশরাফি বিন মুর্তজার জীবন। মাশরাফিকে চেনেন না, এমন কারও সামনে গিয়ে ইনজুরির সঙ্গে তাঁর লড়াইয়ের গল্পগুলো শোনালে আষাঢ়ে গল্প বলার অভিযোগে মার খেতেও হতে পারে। দুই হাঁটুতে সাতবার অস্ত্রোপচারের পরও ক্রিকেট খেলে যাচ্ছেন কোনো পেস বোলার, এই গল্প যেকোনো যুক্তিবাদী মানুষের কাছে অবাস্তব উপমা পেতে বাধ্য।

এখন যে মাশরাফিকে দেখা যায়, তাঁর সঙ্গে ২০০১ সালের নব্য অভিষিক্ত পেসার মাশরাফির মিল খুঁজে পাওয়া কঠিন। একালের কিশোরেরা যাঁকে মিডিয়াম পেসার হিসেবে দেখেই অভ্যস্ত, সেই মাশরাফির গতির ঝড়ে একসময় ব্যাটসম্যানদের নাক দিয়ে রক্ত গড়িয়েছে, এ কথা কে বিশ্বাস করবে? এই যে ক্ষয়ে ক্ষয়ে মাশরাফির আজকের এই রূপ, তার প্রধান কারণই এতবার ইনজুরি।

ইয়ান বোথাম

২০০২ সালে পিঠের চোট থেকে পুনর্বাসনের সময় স্কিপিং করতে গিয়ে প্রথমবারের মতো হাঁটুতে ইনজুরি। সেই যে চোট মাশরাফিকে জড়িয়ে ধরল, আজও প্রতিটি বলের প্রতিটি রানআপে সেটি তাঁর সঙ্গী। চোট তাঁর সবচেয়ে বড় শত্রু এবং সবচেয়ে দীর্ঘ সঙ্গী। যখনই উড়াল দিতে চেয়েছেন মাশরাফি, ইনজুরির কারণেই আটকা পড়েছেন। ক্যারিয়ার শুরুর তিন বছরের মধ্যে এই হাঁটুতেই বড় বড় দুটি ইনজুরি সম্ভবত তাঁর ক্যারিয়ারের শ্রেষ্ঠ সময়কেই তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল।

চোটের কাছে পরাজয়ের কারণেই ২০১১ সালে দেশের মাটিতে বিশ্বকাপের দল থেকে বাদ পড়া, এই চোটের কারণেই টেস্ট ক্রিকেট মাশরাফির জীবনের সবচেয়ে বড় দীর্ঘশ্বাসগুলোর একটি। ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো টেস্টে অধিনায়কত্ব করতে নামার পর প্রথম স্পেলেই এই চোটই দল থেকে ছিটকে দিয়েছে তাঁকে। সেই যে সতীর্থদের কাঁধে ভর দিয়ে সেন্ট ভিনসেন্টের মাঠ থেকে বের হলেন, আর সাদা পোশাকে কখনোই ফিরতে পারেননি তিনি।

গ্রাহাম গুচ

মাশরাফি শেষ পর্যন্ত কিন্তু চোটকে জয় করেছেনই। অনেক কিছু হারাতে হয়েছে, কিন্তু চোট তাঁর ক্যারিয়ারে ঘাতক হতে পারেনি। চোট তাঁকে টেস্ট খেলতে দেয়নি, তাই রঙিন পোশাকেই খেলে যাচ্ছেন দিনের পর দিন। চোট তাঁকে গতির ঝড় তুলতে দেয়নি, তাই মিডিয়াম পেসেই তুলে নিয়েছেন একের পর এক উইকেট। ২০১২ সালে জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কাগুলো কাটিয়ে ফেরার পর থেকে আর আগের মতো বড় পরিসরে কোনো চোটে পড়েননি। আবার ফেরত পেয়েছেন অধিনায়কত্ব, ২০১৫ সালে দেশের সবচেয়ে সফল বিশ্বকাপ মিশনও এসেছে তাঁর হাত ধরেই। চোটজর্জর জীবন কাটিয়ে ফিরে মাশরাফি কখনো এ দেশের সবচেয়ে সফল অধিনায়কে পরিণত হবেন, এ দেশের ক্রিকেটারদের সবচেয়ে বড় মানসিক শক্তির নাম হবেন—এ কথা ১০ বছর আগে সেন্ট ভিনসেন্টে সেই চোটের পর কেউ কি ভাবতে পেরেছিল?

কিংবদন্তিদের কৃতিত্ব সম্ভবত এই যে অস্বাভাবিককে স্বাভাবিক এবং অবাস্তবকে বাস্তব, কোনোটি করতেই তাঁদের নৈপুণ্যের কোনো অভাব দেখা যায় না।