গল্পবলিয়ে তারিণী খুড়ো

‘তোরা তো আমাকে গল্পবলিয়ে বলেই জানিস,’ বললেন তারিণী খুড়ো, ‘কিন্তু এই গল্প বলে যে আমি এককালে রোজগার করেছি, সেটা কি জানিস?’

‘না বললে জানব কী করে?’ বলল ন্যাপলা।

‘সে আজ থেকে বাইশ বছর আগের কথা,’ বললেন তারিণী খুড়ো। ‘বম্বেতে আছি, ফ্রি প্রেস জার্নাল কাগজে এডিটরের কাজ করছি, এমন সময় একটা বিজ্ঞাপন দেখলাম—আমেদাবাদের এক ধনী ব্যবসায়ী একজন গল্পবলিয়ের সন্ধান করছে। ভারি মজার বিজ্ঞাপন। হেডলাইন হচ্ছে ‘ওয়ানটেড আ স্টোরি টেলার।’ তারপর লেখা আছে যে আমেদাবাদের একজন কাপড়ের ব্যবসায়ী বলবন্ত পারেখ একজন ব্যক্তির সন্ধান করছেন, যে তাঁকে প্রয়োজনমতো একটি করে মৌলিক গল্প শোনাবে। সে লোক বাঙালি হলে ভালো হয়, কারণ বাঙালিরা খুব ভালো গল্প লেখে। বুঝে দেখ—‘মৌলিক’ গল্প। অন্যের লেখা ছাপা গল্প হলে চলবে না। সে রকম গল্প তো পৃথিবীতে হাজার হাজার আছে। কিন্তু এ লোক চাইছে এমন গল্প, যা আগে কোথাও প্রকাশিত হয়নি। এখন ব্যাপারটা হচ্ছে কি, আমার পক্ষে গল্প তৈরি করা খুব কঠিন নয়। আমার জীবনের এত রকম অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাতেই একটু-আধটু রং চড়িয়ে রদবদল করে বলে নিলেই সেটা গল্প হয়ে যায়। তাই কপাল ঠুকে অ্যাপ্লাই করে দিলুম। এটাও জানিয়ে দিলুম যে আমি গুজরাটি জানি না, তাই গল্প বললে হয় ইংরেজিতে, নাহয় হিন্দিতে বলতে হবে। হিন্দিটা আমার বেশ ভালো রকমই রপ্ত ছিল আর ইংরেজি তো কলেজে আমার সাবজেক্টই ছিল। সাত দিনে উত্তর এসে গেল। পারেখ সাহেব জানালেন, ওঁর ইনসমনিয়া আছে, রাত সাড়ে তিনটে–চারটের আগে ঘুমোন না, সেই সময়টা গল্প শুনতে চান। রোজ নয়, যেদিন মন চাইবে। মাইনে মাসে হাজার টাকা।’

‘আমি আমার বম্বের খবরের কাগজের চাকরি ছেড়ে দিলুম। দেড় বছর করেছি এক কাজ, আর এমনিতেও ভালো লাগছিল না।’

বুড়ো থেমে দুধ–চিনি ছাড়া চায়ে একটা চুমুক দিয়ে আবার শুরু করলেন।

আমেদাবাদ গিয়ে জানলুম, পারেখ সাহেবের কাপড়ের মিল আছে, বিরাট ধনী লোক। বাড়িটাও পেল্লায়, অন্তত বারো-চোদ্দখানা ঘর। তার একটাতেই আমাকে থাকতে দিলেন। বললেন, ‘তোমার ডিউটির তো কোনো ধরাবাঁধা সময় নেই। মাঝরাত্তিরে তোমায় ডাকব—অন্য জায়গায় থাকলে চলবে কী করে। তুমি আমার বাড়িতেই থাকো।’ ভদ্রলোকের বয়স পঁয়তাল্লিশের বেশি না। অর্থাৎ আমারই বয়সী। দুই ভাইপো আছে, হীরালাল আর চুনীলাল—তারা কাকার ব্যবসায় লেগে গেছে। এর মধ্যে হীরালালের বিয়ে হয়ে গেছে, সে বউ আর দুটি ছেলেমেয়ে নিয়ে ওই একই বাড়িতে থাকে।

খাওয়ার ব্যাপারে আমার কোনো ঝামেলা নেই। পারেখ সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কোনো স্পেশাল রান্না খাব কি না। আমি বলে দিলুম যে আমি গুজরাটি রান্নায় অভ্যস্ত।

মোটকথা মাসখানেকের মধ্যেই বেশ গ্যাঁট হয়ে বসলাম। গল্প দেখলাম মাসে দশ দিনের বেশি বলতে হচ্ছে না। বাকি সময়টা খাতায় গল্পের প্লট নোট করে রাখতাম। ইচ্ছে করলে আমি নিজেই একজন গল্পলিখিয়ে হয়ে যেতে পারতাম, কিন্তু তাতে মাসে হাজার টাকা আয় হতো না। ভূতের গল্প, শিকারের গল্প, ক্রাইমের গল্প—সাধারণত এগুলোই ভদ্রলোক বেশি ভালোবাসতেন শুনতে। তোরা তো জানিসই, ভূতের অভিজ্ঞতা আমার অনেক হয়েছে। তেমনি রাজারাজড়াদের সঙ্গে শিকারও করেছি কম না। ক্রাইমের গল্পটা মাথা থেকে বের করে বলতুম, সেটা বেশ ভালোই উতরিয়ে যেত। মোটামুটি ভদ্রলোক আমার কাজে খুশিই ছিলেন।

মাস ছয়েক হয়ে গেছে, এমন সময় একদিন সকালে এক ভদ্রলোক পারেখ সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। পারেখ সাহেব সেদিন একটু বেরিয়েছিলেন। আমি ভদ্রলোককে বৈঠকখানায় বসিয়ে জিজ্ঞাসা করলুম তাঁর কী দরকার। উনি বললেন, ওঁর নাম মহাদেব দুতিয়া, উনি একটা বিশেষ জনপ্রিয় গুজরাটি মাসিক পত্রিকা ললিতার সম্পাদক। ললিতার নাম আমি শুনেছিলাম। ওটার নাকি প্রায় এক লাখ সার্কুলেশন। আমি বললাম, ‘মি. পারেখের ফিরতে আধঘণ্টাখানেক হবে, আপনি যদি বলেন, আপনার কী দরকার ছিল, আমি সেটা ওঁকে জানিয়ে দিতে পারি।’

দুতিয়া বললেন, ‘আমি ওঁর কাছ থেকে গল্প চাইতে এসেছি। সাহিত্য পত্রিকায় উনি নিয়মিত লিখছেন কয়েক মাস থেকে। আমার গল্পগুলো খুব ভালো লেগেছে, তাই ভাবছিলাম আমাদের কাগজে যদি লেখা দেন। আমাদের পাঠকসংখ্যা সাহিত্যর প্রায় দেড়া।’

‘উনি গল্প লিখছেন?’ আমি একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করলাম।

‘আপনি জানেন না?’ ভদ্রলোকও অবাক।

‘না। একেবারেই জানি না।’

‘ভেরি গুড স্টোরিজ। আর ওঁর গল্পের খুব ডিমান্ড হয়েছে। সাহিত্য–এর গ্রাহকসংখ্যা বেড়ে গেছে। আপনি গুজরাটি পড়তে পারেন?’

‘একটু একটু। হিন্দির সঙ্গে সামান্য মিল আছে তো।’

‘এই দেখুন ওঁর একটা গল্প।’

 দুতিয়া একটা থলি থেকে একটা পত্রিকা বের করে একটা পাতা খুলে দেখাল। লেখকের নামটা পড়তে আমার কোনো অসুবিধা হলো না।

‘এ গল্প তুমি পড়েছ?’

‘সার্টেনলি। খুব ভালো গল্প।’

‘গল্পের মোটামুটি ব্যাপারটা খুব সংক্ষেপে আমাকে বলতে পারো?’

দুতিয়া বললেন, এবং আমি বুঝলাম যে সেটা আমারই বলা একটা গল্প। ভদ্রলোকের কাহিনিকার হওয়ার শখ হয়েছে, কিন্তু নিজের মাথায় প্লট আসে না, তাই অন্যের কাছ থেকে শোনা মৌলিক গল্প নিজের বলে চালাচ্ছেন। গল্পবলিয়ে বাঙালি হওয়ার প্রয়োজনও এখন বুঝলাম। আমি গুজরাটি হলে তো এ ব্যাপারটা অনেক আগেই জেনে ফেলতাম। এভাবে ঘটনাচক্রে দুতিয়ার কাছ থেকে জানার কোনো প্রয়োজন হতো না।

আমি বললাম, ‘আপনি কি বসবেন? না আরেক দিন আসবেন? অবিশ্যি আমিও ওঁকে ব্যাপারটা বলে দিতে পারি।’

‘আমি নিজেই আসব। কাল সকালে এলে দেখা হবে কি?’

‘এগারোটা নাগাদ এলে নিশ্চয়ই হবে। মি. পারেখ একটু দেরিতে ওঠেন।’

মি. দুতিয়া চলে গেলেন।

আমি আবার মন দিয়ে ব্যাপারটা উপলব্ধি করার চেষ্টা করলাম। ব্যাপার খুবই সোজা। লোকটা স্রেফ আমাকে না জানিয়ে আমার নাম ভাঙিয়ে নিজে নাম করছে।

নাঃ—এর একটা বিহিত না করলেই নয়। এ জিনিস বরদাস্ত করা যায় না। অথচ লোকটাকে দেখে একবারও বুঝতে পারিনি যে সে এত অসৎ হতে পারে।

পরদিন দোতলায় আমার ঘরের জানালা থেকে দেখলাম এগারোটার সময় একটা পুরোনো ফোর্ড গাড়ি এসে পারেখের বাড়ির সামনে থামল আর তার থেকে দুতিয়া নামলেন। এবার থেকে ললিতা পত্রিকায় চোখ রাখতে হবে। পারেখের কোনো গল্প বেরোয় কি না, সেটা দেখতে হবে। কিন্তু এর প্রতিকার হয় কী করে? এ জিনিস তো চলতে দেওয়া যায় না।

রাত্তিরে ডাক পড়ল। গেলুম। পারেখ বললে গল্প শুনবে। আমার ভাবাই ছিল। আমি বলে গেলুম। গল্পের শেষে আমায় তারিফও করলে। বললে, ‘দিস ইজ ওয়ান অফ ইওর বেস্ট।’

এক মাস পরের কথা। এর মধ্যে আরও আট-দশটা গল্প বলা হয়ে গেছে। একদিন সকালে পারেখ বেরিয়েছে, আমি আমার ঘরে বসে আছি। এমন সময় পারেখের ভাইপো হীরালাল এসে বলল আমার টেলিফোন আছে।

আমি নিচে আপিসে গেলুম। ফোন তুলে হ্যালো বলে দেখলুম ললিতার সম্পাদক দুতিয়া কথা বলছেন। বললেন, ‘মি. পারেখ নেই শুনছি।’

‘না, উনি একটু বেরিয়েছেন।’

‘বিশেষ জরুরি দরকার ছিল। তা আপনি কি একবার আমার আপিসে আসতে পারবেন? ঠিকানাটা টেলিফোন ডিরেক্টরিতেই পাবেন।’

আমি বললাম, ‘এখান থেকে কত দূর আপনার আপিস?’

‘ট্যাক্সিতে এলে দশ মিনিটে পৌঁছে যাবেন।’

‘বেশ, আমি আসছি।’

ললিতার আপিস দেখলেই বোঝা যায় তাদের অবস্থা খুব সচ্ছল। বেশ বড় ঘরে একটা বড় টেবিলের পেছনে দুতিয়া তিনটে টেলিফোন সামনে নিয়ে বসে আছেন। আমাকে দেখেই উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘কেলেঙ্কারি ব্যাপার।’

‘কী হলো?’

‘মি. পারেখ আমাদের একটা গল্প পাঠিয়েছিলেন—চমত্কার গল্প। আমরা সেটা ছাপিয়েছিলাম। তারপর থেকে অন্তত দেড় শ চিঠি পেয়েছি—পাঠকেরা বলছে গল্পটা চুরি—এর মূল লেখক হচ্ছেন তোমাদের বাংলাদেশের শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।’

সত্যজিত রায়। বাংলা সাহিত্য অন্যতম স্তম্ভ। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মতা।  ১৯২১ সালের ২ মে কলকাতায় জন্মগ্রহন করেন সত্যজিত রায়। বাবা প্রখ্যাত লেখক সুকুমার রায়। তুখোড় গোয়েন্দা ফেলুদা, পাগলাটে বিজ্ঞানী প্রফেসর শঙ্কু, গল্পবাজ তারিনী খুড়োর মতো অসংখ্য অনবদ্য চরিত্রের জনক সত্যজিৎ রায়। নির্মাণ করেছেন পথের পাঁচালী, অপরাজিত, অপুর সংসারসহ অসংখ্য বিশ্বনন্দিত চলচ্চিত্র। ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল তিনি মারা যান।