গুরু পূর্ণিমার রাতে যত কাণ্ড!

অলংকরণ: আরাফাত করিম

আমাদের সঙ্গে কক্সবাজার যাবি? মাহিন বলল।

মানে?

মানে আমরা আগামী সপ্তাহে সবাই মিলে কক্সবাজার যাচ্ছি বেড়াতে। ওখানে আমাদের একটা নিজস্ব রিসোর্ট আছে। আমরা ওখানে এক সপ্তাহ থাকব। তুই আর অন্তু চাইলে যেতে পারিস আমাদের সঙ্গে। আমি মাকে বলেছি, মা বলেছে তোদের সঙ্গে নিতে। যাবি?

আমি হতভম্ব হয়ে অন্তুর দিকে তাকালাম। অন্তুও হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকাল। এ রকম একটা প্রস্তাব পাব, আমরা কি জীবনেও ভেবেছি!

আমি আর অন্তু পাশাপাশি বাসায় থাকি। ওর সঙ্গে আমার অনেক মিল। ওর বাবা মারা গেছে একটা রোড অ্যাকসিডেন্টে। আমার বাবাও বেঁচে নেই, মারা গেছে ক্যানসারে। ওর অবশ্য একটা বড় বোন আছে। আমি আমার মায়ের একমাত্র ছেলে। আমার মা–ও চাকরি করে, অন্তুর মা–ও চাকরি করে।

কী, যাবি কি না বল? মাকে জানাতে হবে। প্লেনের টিকিট কাটতে হবে, কক্সবাজারের রিসোর্টের কেয়ারটেকারকে জানাতে হবে; রুম গোছগাছের ব্যাপার আছে। মাহিন বড়দের মতো গম্ভীর হয়ে বলতেই থাকে। ওরা খুব বড় লোক। ওর বাবা শিল্পপতি। আমি আর দেরি করলাম না, চেঁচিয়ে বললাম, যাব। অন্তুও আমার সঙ্গে গলা মেলাল। মানে সে–ও যাবে।

আমি আর অন্তু এই মুগদাপাড়ার বাইরে কোথাও গিয়েছি বলে মনে পড়ে না। আমাদের পরিবারের কেউই যায়নি। বাবা যখন বেঁচে ছিল, তখন দাদি আর দুই ফুফুও আমাদের সঙ্গে থাকত। মা তখন সব সময় রান্নাঘরেই রান্নাবান্না নিয়ে সময় কাটাত। মায়ের এক বান্ধবী বেড়াতে এসে মাকে বলেছিল, তুই রান্নাঘর থেকে জীবনেও বের হবি না? তোর কি কোথাও ঘুরতেও ইচ্ছে করে না? তখন মা বলেছিল, কে বলে রান্নাঘর থেকে বের হই না? ওই দিন ঝড়ে–বাতাসে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে ফেলল রান্নাঘরের বাইরে, তা জানিস!

মায়ের কথা শুনে আমরা হি হি করে হাসতাম। মা তখন বেশ মজার মজার কথা বলত।

আসলে সত্যি কথা বলতে কি, বাইরে বেড়াতে যাওয়ার মতো অবস্থাও আমাদের এখন আর নেই। আমাদের দুজনের মাকেই যথেষ্ট যুদ্ধ করতে হচ্ছে টিকে থাকার লড়াইয়ে। আমার মাঝেমধ্যে নিজের বাবার ওপর খুব রাগ হয়। কেন ক্যানসার রোগে তাকেই মরতে হলো? আরও কিছুদিন বেঁচে থাকা যেত না? এখন আমার মা কী কষ্টটাই করছে! ছোটখাটো একটা চাকরি করে, একটা প্রাইভেট কোম্পানির স্টোরকিপার। সেই রাত নয়টায় আসে। যায় সকাল আটটায়। আমি জানি না, অন্তু হয়তো আমার মতোই ভাবছিল। তবে খালাম্মা, মানে অন্তুর মা অবশ্য একটা কলেজের শিক্ষক। অন্তুরা আমাদের থেকে একটু বেশি ভালো আছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শিল্পপতির ছেলে মাহিন আমাদের বন্ধু হলো কীভাবে? এর একটা কারণ আছে, আমরা স্কুলে একসঙ্গে পড়তাম। পড়তাম বললাম, কারণ, এখন আর মাহিন আমাদের সঙ্গে পড়ে না। ও একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে চলে গেছে। ওটাও বড়লোকদের স্কুল। আমি আর অন্তু আগের সাধারণ স্কুলটাতেই আছি। মাহিন চলে গেছে তারপরও আমরা কেন বন্ধু আছি? কারণ, আমাদের পাড়ায় একটা ফুটবল ক্লাব আছে। সেই ক্লাবের ক্যাপ্টেন আমি। মাহিন গোলি আর অন্তু খেলে ফরোয়ার্ডে। আমাদের পাড়ায় এই ক্লাবটার বেশ নামধাম আছে। আমরা ইন্টার ডিস্ট্রিক্ট ফুটবল কন্টেস্টে দুবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। যাহোক, এই ক্লাবের কারণে আমরা এখনো একসঙ্গে আছি।

তাহলে আমি বাসায় মাকে ফাইনালি জানিয়ে দিলাম, তোরা দুজন আমাদের সঙ্গে যাবি। বলে উঠে দাঁড়াল মাহিন। তার গাড়ি চলে এসেছে। আমি আর অন্তু দুজনই সবেগে মাথা নাড়লাম। আমরা তিনজন একটা মাঠের ধারে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। এই মাঠেই আমরা ফুটবল প্র্যাকটিস করি। যেদিন প্র্যাকটিস থাকে না, সেদিন পাশের একটা পার্কে যাই ঘুরতে। আজ ব্যতিক্রম, প্র্যাকটিস নেই তারপরও ফুটবল মাঠেই আছি। তাই বোধ হয় এই ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটল...মানে কক্সবাজার যাওয়ার ব্যাপারটা আরকি। মাহিন চলে যাওয়ার পর আমরা দুজন আলোচনায় বসলাম।

আমার একটু খটকা লাগছে। বলে অন্তু।

কী খটকা?

কেন তোর মনে নেই, মাহিনের বোন রিনির সঙ্গে কী ঝামেলা হলো গত মাসে।

আরে তাই তো, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। আমি বলি।

তারপরও ও আমাদের নিতে চাচ্ছে কক্সবাজারে!

হুম...এটা তো ভাবিনি। আমি তখন মাসখানেক পেছনে গিয়ে বিষয়টা মনে করার চেষ্টা করলাম। ভাবলাম একটু। এটা এক মাস আগের কথা। আমরা দুজন মাহিনের বাসায় গেলাম। মাহিনের একটা ছোট বোন আছে, নাম রিনি। খুব সুন্দরী। মেয়েটা সেটা জানেও বোধ হয়। আমাদের দেখলেই ভাব নেয়। যেন আমাদের চেনে না। সেদিনও তা–ই হলো। আমি বললাম, মাহিন আছে?

মা-হি-ন! যেন মাহিনকে সে চেনে না।

হ্যাঁ, তোমার বড় ভাই মাহিন । মহিতুল ইসলাম মাহিন, এই বাসায় থাকে। আমি বলি। তখন সে টের পায়, আমরাও তার সঙ্গে ইয়ার্কি শুরু করেছি। তখন সে রেগে গেল।

আমার সঙ্গে ফাজলামো করছ?

ফাজলামো কখন করলাম, তুমি মাহিনকে চিনতে পারছ না দেখে ওর পরিচয় দিচ্ছিলাম।

রিনি গটগট করে ভেতরে চলে গেল। ঘটনা এইটুকুই। কিন্তু এই ব্যাপারটা নিয়েই সে মাহিনকে লাগাল আমাদের নামে। পরে একদিন আমাদের মাহিন চার্জ করে বসল।

তোরা রিনিকে কী বলেছিস?

কী বলব?

রিনি বলল তোরা নাকি ...

তখন অন্তু বিষয়টা ব্যাখ্যা করে। সব শুনে মাহিন গম্ভীর হয়ে যায়। তারপর কিছুদিন আমাদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ ছিল। তারপর একদিন ফুটবল প্র্যাকটিস ছিল, একটা লোকাল ম্যাচও ছিল সবুজ সংঘের সঙ্গে। সেই সূত্রে আবার সব নরমাল হলো। তবে আমরাও আর ওর বাসায় যাই না। তারপর হঠাৎ আজ এই প্রস্তাব।

আমার মনে হয় ও আগের ব্যাপারটা সব ভুলে গেছে, কী বলিস?

তা–ই হবে।

আর আমরাও তো এমন কিছু করিনি রাগ করার মতো।

তা–ও ঠিক।

সেদিনকার মতো আড্ডাবাজি বন্ধ করে আমরা বাসায় ছুটলাম। এই সুখবরটা বাসায় দেওয়া দরকার। বাসার থেকে অনুমতিরও প্রয়োজন আছে। একই সঙ্গে প্লেন জার্নি আর কক্সবাজার ঘোরা চাট্টিখানি কথা নাকি! মনে হয় না মা আপত্তি করবে।

বাসায় সব শুনে মা বলল, সত্যি মাহিনের মা তোদের সঙ্গে যেতে বলেছে?’

তো মিথ্যে বলছি। অন্তুকে জিজ্ঞেস করো। অন্তু পাশেই ছিল, সে–ও বলল, হ্যাঁ খালাম্মা, মাহিন এসে আমাদের রিকোয়েস্ট করল।

ঠিক আছে যা। তোর তো ভালো কাপড়চোপড়ই নেই।

যেগুলো আছে, সেগুলো ঠিকমতো ধুয়ে ইস্তিরি করলেই হবে। শুধু জুতোটা হাফসুল করে পালিশ করতে হবে।

তুমিও যাচ্ছ তো? মা অন্তুকে বলে।

হ্যাঁ খালাম্মা, আমাদের দুজনকেই তো বলল। আমার আম্মাও বলেছে যেতে। স্কুলে তো এখন গ্রীষ্মের ছুটি আছেই।

বেশ তো যাও। সাবধানে থেকো। সমুদ্রের কাছে বেশি যেয়ো না যেন, বড়দের কাছাকাছি থেকো।

হ্যাঁ হ্যাঁ, ওটা নিয়ে ভাববেন না।

সত্যি বলতে কি, তারপর থেকেই শুরু হলো আমাদের প্রস্তুতি। মা আমার তিনটা শার্ট আর দুটো প্যান্ট ধুয়ে সুন্দর করে ইস্তিরি করে দিল। একটা তো পরেই থাকব।

প্রতিটা কাপড় দুবার করে পরবি। আর পৌঁছেই আমাকে ফোন দিবি।

ফোন পাব কোথায়? আমার কি মোবাইল ফোন আছে?

আরে গাধা, এখন সব জায়গায় ফোন আছে। না হয় মাহিনের ফোন থেকেই ফোন দিবি যে ঠিকমতো পৌঁছেছিস। আর মাহিনের ফোন নম্বরটা আমায় দিয়ে যাবি।

আচ্ছা, তুমি ভেবো না। তোমার একা থাকতে সমস্যা হবে না তো মা? আমার একটু যেন চিন্তা হয়, কখনো মাকে ছেড়ে একা থাকিনি।

আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। তোরা ঠিকমতো থাকিস।

অন্তুরও বাসায় একই অবস্থা। ও অবশ্য কক্সবাজার যাওয়া উপলক্ষে একটা নতুন শার্ট আর প্যান্ট পেল। নতুন বলতে আমি কিনেছি একটা কাঁধে ঝোলা ব্যাগ আর একজোড়া মোজা। আমরা দুজনেই মোটামুটি প্রস্তুত। মা দিয়েছে ২০০ টাকা। আমার কাছে ছিল ৪০ টাকা। আর ওদিকে অন্তুও পেয়েছে ৫০০ টাকা। ওখানে গিয়ে বার্মিজ মার্কেটে টুকটাক কেনাকাটা করতে হবে না! কক্সবাজারের বার্মিজ মার্কেট নাকি অনেক বিখ্যাত। এর মধ্যে মাহিনের সঙ্গে দেখা হয়েছে। সে বলেছে, পরশু দিন ঠিক সাড়ে আটটার মধ্যে আমরা দুজন ওর বাসায় গিয়ে যেন হাজির হই। ঠিক সাড়ে আটটায় ওদের বড় মাইক্রোবাসে করে সোজা এয়ারপোর্টে, তারপর প্লেনে...কক্সবাজার। উফ্‌ আমি কল্পনায় তখন প্লেনের জানালা দিয়ে মেঘ, পাখি এসব দেখতে শুরু করেছি। সবচেয়ে ভালো হতো যদি একটা ক্যামেরা থাকত। অবশ্য মাহিনের ক্যামেরায় ছবি তো তোলা হবেই, ওখান থেকে আমরা নিশ্চয়ই কিছু ছবি পেয়ে যাব।

দেখতে দেখতে পরশু দিন চলে এল। আমি আমার নতুন কেনা কাঁধঝোলা ব্যাগে আমার কাপড়চোপড় নিয়ে নিলাম। এখন যাব অন্তুদের বাসায়, ওখান থেকে রিকশায় সোজা মাহিনদের বাসায়। মা আজ একটু আগে আগেই অফিসে যাওয়ার সময় অন্তুদের বাসার সামনে আমাকে নামিয়ে দিল। বলল, দেখিস বাবা, সাবধানে থাকিস, বড়দের কথা শুনিস কিন্তু। আমার উচিত ছিল মাহিনের মায়ের সঙ্গে দেখা করা। সময়ে হলো না।

আচ্ছা মা, তুমি ভেবো না। মাকে বিদায় দিয়ে হঠাৎ করে মনে হলো, ইশ্‌ যদি মাকেও সঙ্গে নেওয়া যেত। আমাকে দেখে অন্তু চেঁচিয়ে উঠল, এত দেরি করলি, আটটা বেজে গেছে। অন্তুর মা বলল, মাহিনদের বাসায় যেতে ১০ মিনিটও লাগবে না। দুধটা খেয়ে যা তো। অন্তুর মায়ের হাতে এক গ্লাস দুধ। আমার হাসি পেয়ে গেল। গাধাটা এখনো গ্লাসে করে দুধ খায়। অন্তুর বড় বোন বলল, এই তোরা দুজন কিন্তু একসঙ্গে থাকিস।

থাকব।

রবি, তুই সাঁতার জানিস?

নাহ।

গুড, দুই গাধাই সাঁতার জানে না। যাচ্ছে সমুদ্রদর্শনে।

উফ্‌, বীণা এসব কী বলছিস যাওয়ার সময়। যা বাবা, ফি আমানিল্লাহ।

অন্তুর মা আমাদের দুজনের গায়ে–মাথায় ফুঁ দিয়ে দিল। কেন যেন আমার সমস্ত শরীর শিরশির করে উঠল। অন্য রকম একটা অনুভূতি হলো। আমরা তাহলে প্লেনে করে সত্যিই যাচ্ছি কক্সবাজারে...সমুদ্রদর্শনে!

একটা রিকশা নিয়ে আমরা ছুটলাম। ঠিক আটটা দশে আমরা পৌঁছালাম মাহিনদের গেটে। গেট বন্ধ। ধাক্কা দিতেই দারোয়ান চাচা গেট খুলে তাকাল আমাদের দিকে।

সাতসকালে তোমরা?

আমার মাথার মধ্যে যেন বিস্ফোরণ হলো। এমনিতেই মেজাজ খারাপ। তবু মাথা ঠান্ডা রেখে বললাম। দেখতে পাচ্ছেন না কী করছি...পার্কে মানুষ কী করে?

আমরা তো মাহিনদের সঙ্গে কক্সবাজার যাব। আমাদের কথা শুনে দারোয়ান চাচার ভ্রু কুঁচকে গেল।

কক্সবাজার যাইবা?

হ্যাঁ। ওদের গাড়ি কোথায়?

ওরা তো সেই ছয়টার সময় চইলা গেছে।

কই গেছে?

কক্সবাজার।

আমাদের না নিয়ে!

তোমগো নেওয়ার কথা ছিল?

অ্যাঁ! হ্যাঁ, তা–ই তো কথা ছিল। আমাদের বলেছে সাড়ে আটটার মধ্যে আসতে।

হ, এখন আটটাই তো বাজে, কিন্তু ওরা ছয়টার সময় চইলা গেছে।

সবাই গেছে?

হ্যাঁ, সবাই গেছে।

আমি হতভম্ব হয়ে অন্তুর দিকে তাকালাম। অন্তুও হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ও আসলে আমাদের ডজ দিল! ফিসফিস করে বলল অন্তু।

মনে কয় তোমগো লগে মজা করছে মাহিনে।

তা–ই হবে। চল পার্কে গিয়ে বসি একটু।

চল।

দুজন এসে পার্কে বসলাম। সেই বেঞ্চিটায়, মাঠে খেলা না থাকলে যেখানে আমরা প্রায়ই বসি। আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে, এটা কী হলো! অন্তু হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি বাসায় কী বলব? আমার তখন জেদ চেপে গেছে। দাঁতে দাঁত ঘষে বললাম, অন্তু কাঁদিস না। আমরা সত্যিই কক্সবাজার যাব। নিজে নিজেই যাব।

কীভাবে? চোখ মুছে অন্তু অবাক হয়ে তাকায়!

কেন, বাসে করে।

বাসভাড়া জানিস?

জানি, ১ হাজার টাকা কক্সবাজার, নন–এসি আর এসি হলে ১ হাজার ২০০ টাকা।

তোর আমার মিলিয়ে আছে মাত্র সাড়ে আট শ টাকার মতো।

ওতেই হবে।

কীভাবে হবে?

বাসে না, আমরা যাব ট্রাকে।

মানে?

এই সময় একটা লোক আমাদের দিকে আসতে লাগল। লোকটার সঙ্গে আরও দু–চারজন। লোকটা ঠিক আমাদের সামনে এসেই হুংকার দিয়ে উঠল—

এই তোদের স্কুল নেই? পার্কে বসে কী হচ্ছে?

আমার মাথার মধ্যে যেন বিস্ফোরণ হলো। এমনিতেই মেজাজ খারাপ। তবু মাথা ঠান্ডা রেখে বললাম। দেখতে পাচ্ছেন না কী করছি...পার্কে মানুষ কী করে?

স্কুল ফাঁকি দিয়ে সাতসকালে পার্কে বসে আড্ডাবাজি? চাবকে পিঠের ছাল তুলে ফেলব!

আমি তখন লোকটাকে চিনতে পারলাম। এই লোক এই এলাকার এমপি। ডিগবাজি দিয়ে এমপি হয়েছে। কিছুদিন আগেও তার বিরুদ্ধে চামড়া তুলে নেব আমরা টাইপ স্লোগান হয়েছে! আর এখন আমাদের চামড়া তুলতে চাইছে। আমি ফট করে বলে ফেললাম—

আপনি আমাদের চামড়া তুলবেন মানে? কদিন আগেও তো আপনার চামড়া তুলে নেওয়ার মিছিল হয়েছে আমাদের পাড়ায়! ভুলে গেছেন আঙ্কেল?

কী কী বললি? লোকটার মনে হলো রাগের চোটে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাবে, তখন আমার থেকেও জোরে চেঁচিয়ে উঠল অন্তু—

আমরা পার্কে বসে যা ইচ্ছে করব, আপনি বলার কে। তুই–তোকারি করছেন কেন? চামড়া পরে তুইলেন, বাসায় গিয়ে নিজের চরকায় তেল দেন। লোকটা যেন হকচকিয়ে গেল অন্তুর এ রকম হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠায়।

কত বড় বেয়াদব দেখেছেন? এই ছেলে, জানো উনি কে? উনি এখানকার...

স্যার পুলিশে ফোন দিই। পাশ থেকে চামচা টাইপের আরেকটা লোক বলে।

হ্যাঁ, ফোন লাগাও। এলাকার ছেলেপেলের তেল বেড়েছে। সব কটাকে ফটকে দেব...

শুনুন। এই সময় সবাই ঘুরে তাকিয়ে দেখে বয়স্ক একটা লোক দাঁড়িয়ে। হাতে লাঠি। লোকটার চেহারায় অন্য রকম একট ব্যক্তিত্ব আছে, লোকটাকে খুব চেনা চেনাও লাগছে। এভাবে কোনো শিশুর সঙ্গে কথা বলতে আপনি পারেন না। আপনারই তো বলেছেন, শিশুদের হ্যাঁ বলুন, এটা শিশুদের সঙ্গে হ্যাঁ বলার ভাষা? আর আপনার জায়গা তো পার্কে না। পার্কের বাইরে...বাইরে অনেক অনিয়ম হচ্ছে, ওগুলো সামলান। সবার আগে ঘরে গিয়ে নিজের ছেলেকে সামলান...!

আ-আমার ছেলে কী করেছে?

কেন, আজকের পেপারেও আছে, খুলে দেখুন। পেপার পড়ার অভ্যেস করুন, যান ...

আ-আপনি...? লোকটা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল; তখন লোকটা তার ভারী গলায় বলল, আশা করছি আমাকে চিনতে পারছেন, পরিচয় দিতে হবে কি? লোকটা থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সঙ্গের লোকগুলোও যেন চুপসে গেল। হঠাৎ আমি উনাকে চিনতে পারলাম। আরে উনি তো খুবই বিখ্যাত একজন মানুষ। টিভিতে প্রায়ই দেখি...নামটা মনে করার চেষ্টা করছি...তখনই হাত ধরে অন্তু টান দিল, চল তো... আমরা দুজন ছুটলাম।

আমরা সত্যিই কক্সবাজার যাব?

অবশ্যই।

কখন?

এখনই যাব। চল কারওয়ান বাজার। ওখান থেকে ট্রাক ছাড়ে।

আমরা ট্রাকে যাব?

হ্যাঁ, ট্রাকে গেলে অনেক সস্তা। ওখান থেকে অনেক জায়গায় ট্রাক যায়। কক্সবাজারের ট্রাকও নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।

ট্রাকের ব্যাপারটা আমি জানতাম। আমাদের বাসায় একটা বুয়া ছিল, সে যখন দেশে যেত, তখন কারওয়ান বাজার থেকে যেত। কারওয়ান বাজারে সাতসকালে দূরদূরান্ত থেকে ট্রাকে করে শাকসবজি, ফলমূল আসে। সেই ট্রাকগুলো যখন ফিরে যায়, তখন কম পয়সায় মানুষদের নিয়ে যায়। আমরাও সেই সুযোগটা নেব। কারওয়ান বাজার এসে একটা ট্রাক পেলাম রংপুর যাবে। এই ট্রাক আম নিয়ে এসেছিল। এখন ফিরে যাবে। যাওয়ার পথে রংপুরের রাস্তায় যাদের পাচ্ছে, উঠিয়ে নিচ্ছে। রংপুরের মানুষও হুড়মুড় করে উঠছে।

কিন্তু আমরা যাব কক্সবাজার। আর ঠিক তখনই একটা ট্রাক এসে থামল। ট্রাকের হেলপারটা অদ্ভুত স্বরে বলতে লাগল, চট্টগ্রাম! চট্টগাম! আমরা দেরি করলাম না। লাফিয়ে উঠে পড়লাম। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যাওয়া যাবে নিশ্চয়ই। আমি তাকিয়ে দেখি, অন্তুর চেহারায় সেই কান্না কান্না ভাবটা নেই। আমরা দুজনই এখন ভয়ংকর কিছু করার জন্য যেন তৈরি। মাহিন আমাদের রাগিয়ে দিয়েছে। আমরা কক্সবাজার যাবই...ওদের আগেই যাব।

ট্রাকটা যখন ছাড়ল, তখন বুঝলাম, আমাদের জার্নিটা খুব সহজ হবে না। প্রচণ্ড ঝাঁকুনি। ডিব্বার ভেতর যেমন ঝালমুড়ি ঝাঁকায়, আমরা সে রকম ঝাঁকুনি খেতে খেতে চলছি। ট্রাকের মধ্যে দেখি, এক ঝালমুড়িওলাও উঠেছে। সে এর মধ্যেও বেশ ঝালমুড়ি বিক্রি করছে। তার অবশ্য সুবিধে হয়েছে, ডিব্বায় ঝালমুড়ি নিয়ে ঝাঁকাতে হচ্ছে না। ট্রাকের ঝাঁকুনির চোটে ডিব্বার ভেতর এমনিতেই মুড়ির ঝাঁকির কাজ হয়ে যাচ্ছে। তবে ঢাকা থেকে বের হওয়ার পর ঝাঁকুনি একটু কমল, ঢাকার বাইরে হাইওয়ের রাস্তা চমত্কার।

ট্রাকে অনেক লোক। সবাই দরিদ্র মানুষ। মেয়েরাও আছে কম না। আমরা দুজনেই একটু পরিষ্কার কাপড় পরা ছিলাম। কিন্তু ট্রাকের ভেতরে ময়লার ওপর বসার কারণে অচিরেই আমাদের কাপড় আর কাপড় রইল না। তাতে কী, মাত্র দু শ টাকায় আমরা দুজন চট্টগ্রাম যাচ্ছি, এটাই তো বিরাট ব্যাপার। ঝাঁকুনি খেতে খেতে একসময় অভ্যাস হয়ে গেল আমাদের।

রবি?

বল।

ওখানে গিয়ে আমরা কোথায় উঠব?

একটা ব্যবস্থা হবেই, ভাবিস না। দরকার হলে আমরা বিচে শুয়ে থাকব। অনেকেই নাকি থাকে।

না না বিচে শুয়ে থাকা যাবে না।

কেন?

আমি পেপারে পড়েছি, ওখানে বিচে মাঝেমধ্যে হাইজ্যাক হয়।

আমাদের আছেটা কী যে হাইজ্যাক হবে?

আচ্ছা যা, সস্তার কোনো হোটেলে থাকব না হয়।

পাব তো?

পাব না কেন, ওখানে সব ধরনের হোটেল আছে।

পাঁচ হাজার টাকার রুমের হোটেল যেমন আছে, ৫০ টাকা রুমের হোটেলও আছে।

কী বলছিস, ৫০ টাকার রুম মানে?

হ্যাঁ, সত্যি বলছি । সস্তার ওই সব হোটেলে ৫০ টাকার রুম বুকিং দিলে তোকে কিছু কাঠের তক্তা, করাত আর পেরেক ধরিয়ে দেবে।

কেন?

বাহ, তুই তখন করাত দিয়ে কেটে নিজের বিছানা বানিয়ে থাকবি ওই রুমে!

ধুত...যত সব ফালতু কথা বলিস তুই। আমি হো হো করে হেসে উঠলাম। গাধাটা এতক্ষণে বুঝেছে আমি ফান করছি।

চার লেনের হাইওয়ে দিয়ে ট্রাক হু হু করে ছুটছে। মাঝেমধ্যেই প্রচণ্ড ঝাঁকুনি। এর মধ্যেই আমি বোধ হয় ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। হঠাৎ অন্তু আমাকে ধাক্কা দিল!

কী হলো?

দেখ।

দেখি অন্তুর হাতে একটা কাগজের টুকরো, তাতে লেখা, আমাকে বাঁচান, ওরা আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে! হাতের লেখাটা বাচ্চাদের মতো।

এটা কোথায় পেলি?

এখানেই পায়ের কাছে পড়ে ছিল।

বলিস কী?

আমার মনে হয় এই ট্রাকে করে কেউ কোনো বাচ্চাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। সে–ই লিখেছে!

এখানে লিখবে কীভাবে?

হয়তো আগেই লিখে রেখেছিল!

অসম্ভব না।

আমরা তখন ট্রাকের সব কটি মানুষকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। কাউকেই ঠিক সন্দেহ হচ্ছিল না। তখনই একজনকে পেলাম। আমাদের সামনে কোনার দিকে বসে আছে একটা লোক। তার পাশে মুখ ঢাকা বোরকা পরা একজন মহিলা। মাঝখানে একটা মেয়ে ঘুমুচ্ছে। মেয়েটাকে দেখে মনে হলো, মেয়েটা এই লোকটার মেয়ে হতে পারে না। আর বোরকা পরা মহিলাটার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ চমকে উঠলাম। আমি নিশ্চিত যে ওটা মহিলা না, পুরুষ, বোরকা পরে আছে। কারণ, বোরকাওলার একটা পা বের হয়ে আছে, নিশ্চিত পা–টা কোনো পুরুষের। কারণ, পায়ে বড় বড় লোম দেখা যাচ্ছে। তারচেয়েও বড় কথা, বোরকার নিচে ও পায়ে জিনসের প্যান্ট দেখা যাচ্ছে। হয়তো সে গুটিয়ে রেখেছিল, প্যান্টটা খুলে নিচে নেমে এসেছে, সে জানে না। তার মানে, আমরা নিশ্চিত হলাম মাঝখানের মেয়েটাকে এরা ধরে নিয়ে যাচ্ছে।

আমি নিশ্চিত। অন্তু ফিসফিস করল। এ মেয়েটাকে বাঁচাতে হবে!

কীভাবে?

জানি না। বুদ্ধি একটা বের কর।

ওরা যেখানে নামবে, আমরাও নামব।

ঠিক ঠিক। মেয়েটা ঘুমুচ্ছে কেন, জানিস?

কেন?

নিশ্চয়ই ওকে নেশাজাতীয় কিছু খাইয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

এই সময় ওই লোকটার পাশের এক মহিলা জিজ্ঞেস করল, মাইয়া এত ঘুমায় ক্যা? কী হইছে?

আর কয়েন না, মাইয়ার খারাপ বাতাস লাগছে, খালি ঘুমায়। ঝাড়াইতে লয়া যাইতাছি দ্যাশে। লোকটা বলে। কথা বলা উচিত ছিল বোরকাওয়ালির, যেহেতু সে মেয়ে সেজে আছে, কিন্তু কথা বলল লোকটা। কারণ, কথা বললে তো পুরুষকণ্ঠ বোঝা যাবে। তা–ই না? অন্তু ব্যাখ্যা করে।

ঠিক বলেছিস।

আমাদের দুজনের মাথায় তখন আর কক্সবাজার নেই। আমরা দুজনই তখন শার্লক হোমস হয়ে উঠেছি। আমাদের একটাই চিন্তা, মেয়েটাকে উদ্ধার করতে হবে, কিন্তু কীভাবে? ওদের সঙ্গে কি অস্ত্র আছে? ওরা কি নারী পাচারকারী? তাহলে তো ওদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট আছে। এ সময় লোকটার মোবাইলে একটা ফোন এল। লোকটা হাত দিয়ে ফোনটা আড়াল করে ফিসফিস করে কিছু বলল, তবে বোঝা গেল না।...একটা কথা বোঝা গেল শুধু। সে বলছে, আছে, আমগো লগেই আছে...মেয়েটার কথাই বলছে কি?

কিন্তু মেয়েটা চিরকুটটা লিখল কখন? আবার সেই প্রশ্ন।

হয়তো আগেই লিখে রেখেছিল। আমরা দুজনেই ভাবতে লাগলাম কীভাবে উদ্ধার করব মেয়েটাকে। বিভিন্ন সিনেমা কমিকসের কিডন্যাপের কাহিনিগুলো মনে করার চেষ্টা করতে লাগলাম। যেখানে নায়ক উদ্ধার করে নায়িকাকে। কীভাবে উদ্ধার করে, কৌশলগুলো ঠিক কী!

কথা বলা উচিত ছিল বোরকাওয়ালির, যেহেতু সে মেয়ে সেজে আছে, কিন্তু কথা বলল লোকটা। কারণ, কথা বললে তো পুরুষকণ্ঠ বোঝা যাবে।

একটা বাজারের মধ্যে এসে বাস থামল। অনেকেই নেমে গেল। হঠাৎ দেখি আমাদের টার্গেটও নামছে। বোরকাওয়ালি মেয়েটাকে ধাক্কা দিয়ে জাগাল। মেয়েটা ঢুলু ঢুলু চোখে উঠে দাঁড়াল। তাকে বোরকাওয়ালি শক্ত করে ধরে রেখেছে। বোঝাই যাচ্ছে, ধরে না রাখলে ও টলে পড়ে যাবে। মেয়েটাকে দেখে আমি আর অন্তু আবার নিশ্চিত হলাম। অতি অবশ্যই এই মেয়েকে কিডন্যাপ করা হয়েছে এবং একে উদ্ধার করা আমাদের অতি অবশ্যকর্তব্য। আমি অন্তুর দিকে তাকালাম। অন্তু আমার দিকে তাকাল। তারপর একরকম লাফিয়ে নামলাম ট্রাক থেকে। কারণ, ট্রাক তখন স্টার্ট দিয়ে ধীরে ধীরে সামনে এগোতে শুরু করেছে।

লোক দুটো মেয়েটাকে নিয়ে একটা রিকশা নিল। আমরাও নিলাম। মূল সড়ক থেকে একটা রাস্তা ভেতরের দিকে চলে গেছে। কাঁচা মাটির সরু রাস্তা। চারটা রিকশা পরপর চলছে। প্রথমে মেয়েটাকে নিয়ে কিডন্যাপারের দল। তারপর একটা রিকশা, তারপর আরেকটা, তারপর আমরা, মানে আমাদের রিকশাটা ৪ নম্বরে। আমাদের রিকশাওয়ালা বলে, কই যাইবা তোমরা?

এই তো সামনে।

দুয়ারা বাড়ির মোড়ে?

জি জি । আমি আন্দাজে বলি। কতক্ষণ চলেছি জানি না। কিডন্যাপারদের রিকশাটা হঠাৎ থেমে গেল। আমরা চেঁচিয়ে উঠলাম থামুন থামুন।

কী হইল?

আমরা এখাইে নামব।

রিকশাওলা একটু অবাক হলো। তবে কিছু বলল না। ভাড়া নিয়ে রিকশা ঘুরিয়ে চলে গেল। তার বোধ হয় লাভই হলো, ফিরে গিয়ে আবার নতুন কোনো খ্যাপ ধরবে। তবে আমাদের ভাগ্য ভালো যে আমরা বেশ দূরত্ব রেখে চলছিলাম। মাঝখানের দুটো রিকশার মধ্যে আরেকটা রিকশা নাই হলো কখন, ঠিক বুঝতে পারলাম না, হয়তো ডানে কোনো গলিতে ঢুকে গেছে। ডান দিকে জঙ্গলের মতো গাছপালা, মাঝেমধ্যে বাড়িঘর। আর বাঁ দিকে বিস্তীর্ণ ফসলের খেত-খামার। পাটখেত, ভুট্টাখেত, ধানখেত তো আছেই।

কিডন্যাপারদের রিকশাটা ওদের নামিয়ে দিয়েছে। আমরা দূর থেকে দেখলাম, বোরকা পরা লোকটা তার বোরকা খুলে ফেলেছে। সে এখন পুরোদস্তুর একটা পুরুষ মানুষ। বেশ ভালো গোঁফ আছে। দূর থেকে দিব্যি বোঝা যাচ্ছে! আমরা একটা গাছের আড়াল থেকে বোঝার চেষ্টা করলাম, ওরা কই যায়। ফাঁকা রাস্তায় মানুষ নেই। হঠাৎ হঠাৎ একটা–দুটা রিকশা, নইলে সাইকেল যাচ্ছে। বাম দিকের বিস্তীর্ণ ফসলের প্রান্তর থেকে হু হু করে বাতাস আসছিল।

চারদিকে অন্ধকার করে তখন সন্ধ্যা নেমে আসছে। তখনই টের পেলাম বেশ খিদে পেয়েছে আমাদের। আমার মনের ভাব বুঝেই যেন অন্তু বলল—

কিছু খেয়ে নিই চল। আমার কাছে দুটো স্যান্ডইউচ আছে।

জলদি বের কর। আমার কাছেও আছে, মা দিয়েছে। আগে তোরটাই খাই। আমরা দ্রুত কাজ সারলাম, তারপর পানি খেলাম। এখন মেয়েটার হদিস আগে পাওয়া দরকার। অন্ধকারটা আরেকটু গাঢ় হলে পরে আমরা ওই জায়গাটার দিকে এগিয়ে গেলাম। যেখানে লোক দুটো মেয়েটাকে নিয়ে নেমে গেছে রিকশা থেকে। ওই জায়গাটায় গিয়ে দেখলাম, পাশাপাশি ঝুপরি টাইপ তিনটা বাড়ি। মাটির বাড়ি। আমরা একেক করে তিনটা ঘরেই উঁকি দিলাম জানলা দিয়ে, কেউ নেই। প্রথম দুটা ঘর অন্ধকার, ৩ নম্বর ঘরটায় টিপ টিপ করে একটা কুপি জ্বলছে। কিন্তু ঘরে কেউ নেই। আশপাশে অন্য কোনো বাড়ি নেই। কী আশ্চর্য, লোক দুটো গেল কই। আর মেয়েটা? তখনই ঠিক কানের কাছে কেউ কথা বলে উঠল, ১০ লাখ টাকা নিয়া গাবতলী বাজারে আইসা ফোন দেন। তারপর কমু কী করবেন। মনে রাইখেন, কথার হেরফের হইলে লগে লগে আপনের মাইয়ারে জবাই কইরা ফালামু! আমার ঘাড়ের কাছে শিরশির করে উঠল। যে গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে আমরা দুজন, তার ঠিক উল্টো পাশেই ও লোক দুটো দাঁড়িয়ে। তাহলে মেয়েটা কোথায়? অন্তু আমাকে ইশারা করল। আমরা পা টিপে টিপে সরে এলাম। লোক দুটো তখনো কী যেন বলছে। অন্তু কানের কাছে ফিসফিস করল, মেয়েটাকে পেয়েছি!

কোথায়?

যে ঘরটায় কুপি জ্বলছে, সেই ঘরে খাটের তলে।

সত্যি?

হ্যাঁ।

আমরা দুজন আর দেরি করলাম না। দ্রুত ওই ঘরটায় ঢুকে নিচু হতেই দেখলাম মেয়েটাকে। আশ্চর্য, মেয়েটা পিট পিট করে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। আমি মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বলে হাত ধরে টান দিলাম। মেয়েটা চট করে উঠে এল। ফিসফিস করল, লোক দুটো কই?

চুপ। তখনই দেখি দরজায় লোক দুটি দাঁড়িয়ে। আমি কিছু চিন্তাভাবনা না করেই ফুঁ দিয়ে কুপিটা নিভিয়ে দিলাম। চারদিকে গাঢ় অন্ধকারে ডুবে গেলাম আমরা। লোক দুটি কি আমাদের দেখে ফেলেছে?

এহ, কুপিটা নিইভা গেল। ওই কুপিটা জ্বালা তো।

দেশলাই তো আপনের কাছে।

আমার কাছে না, তুই না নিলি বিড়ি ধরাইতে। যাক, লোক দুটো আমাদের দেখতে পায়নি। মেয়েটা তখন উঠে এসে আমাদের দুজনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে। আমাদের তিনজনের বুকের ভেতরই ড্রাম পিটাচ্ছে যেন। ওরা দেশলাই এনে কুপি জ্বালানোর আগেই আমাদের কিছু একটা করতে হবে, মানে এ ঘর থেকে বের হতে হবে। লোক দুটো তখনো দেশলাই নিয়েই কথাবার্তা বলছে।

তাইলে দেশলাইটা মনে হয় গাছতলায় পড়ছে!

জলদি কর। মাইয়ার জ্ঞান ফিরার সময় হইছে কইলাম। আরেক ডোজ দিতে হইব।

আচ্ছা আনতাছি। বলে লোকটা সরে পড়ল। মনে হয়, বোরকা পরে ছিল যে লোকটা, সে গেল দেশলাইয়ের খোঁজে। আর তখনই রিন রিন করে দ্বিতীয় লম্বা লোকটার মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। লোকটা, হ্যালো ক্যাডা? সিদ্দিক...? বলে দরজা থেকে একটু সরে দাঁড়াল। এই সুযোগ...আমরা তিনজনেই নিঃশব্দে বের হয়ে এলাম ঘরটা থেকে। মেয়েটা যে নিজে নিজেই হেঁটে বের হয়ে আসবে, আমি ভাবতেই পারছিলাম না। দ্রুত ওকে নিয়ে রাস্তা পার হয়ে ধানখেত পার হয়ে একটা পাটখেতের ভেতরে ঢুকে পড়লাম। ভাগ্যিস এখানে লম্বা লম্বা পাটখেত ছিল। কিন্তু এ কী, আমাদের সঙ্গে অন্তু ছিল, ও কোথায়? আমার বুকের ভেতর ধক করে উঠল।

অন্তু কোথায়?

তোমার সঙ্গে যে ছিল ছেলেটা?

হ্যাঁ।

ও তো আমাদের পেছনেই ছিল। তারপর...মেয়েটাও অবাক! হায় হায় এখন কী হবে? আমি আমার ঘাড়ের ব্যাগটা মাটিতে রাখলাম। মেয়েটাকে বললাম, এখানে বসে থাকো, দেখি অন্তুর কী হলো। মেয়েটা মাথা নাড়ল। ফিসফিস করল, ওরা কিন্তু ভয়ংকর, খুব সাবধান!

পাঠখেত থেকে উঁকি দিয়ে দেখি, লোক দুটোর একজন অন্তুকে শক্ত হাতে ধরে আছে। আর এদিক–ওদিক তাকাচ্ছে। দ্বিতীয় লোকটা হাতে একটা লাঠি নিয়ে বের হয়েছে। সে–ও উদ্বিগ্ন। এদিক–ওদিক তাকাচ্ছে। অন্তুর মাথায় ঠাস করে একটা থাপড় দিয়ে কিছু বলল। অন্তু কী বলল, বোঝা গেল না। কিছু একটা করতে হবে এখনই, আমি ভাবলাম। কিন্তু কী করব? একটা কিছু দরকার। লাঠি বা ইট একটা কিছু। তখনই একটা ভারী পাথরের মতো কিছু পায়ে ঠেকল। ওটাই হাতে উঠিয়ে নিলাম। ঠিক পাথর নয়, ঝামা ইটের মতো একটা ভারী কিছু। মাথার ভেতরটা দপ দপ করছে, আর বুকের ভেতর ধক ধক করছে। লাঠি হাতে লোকটা কিছু একটা আনতে রাস্তা থেকে ভেতরে ঢুকে গেল। আর অন্তুকে ধরে থাকা লোকটা হঠাৎ অন্তুকে কী সব বলতে বলতে কিল–ঘুষি মারতে শুরু করল। আমার আর সহ্য হলো না। হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে এসে হঠাৎ লাফিয়ে উঠলাম রাস্তায়। ফুটবল খেলায় আমি ভালো স্ট্রাইকার। সেকেন্ড ব্যাকে খেলি। আমাদের কোচ শিখিয়েছে, কী করে শট দিলে বলের ওপর সর্বশক্তি প্রয়োগ হয়। তা–ই করলাম। লাফিয়ে উঠে লোকটার হাঁটুতে আমার সেই বিখ্যাত লাথিটা দিলাম, যেন লোকটার হাঁটুটাই একটা ৫ নম্বরি ফুটবল, কট করে একটা শব্দ হলো যেন। তারপরই দুই হাতে হাতের পাথরটা ছুড়ে দিলাম লোকটার মাথা বরাবর সর্বশক্তি দিয়ে। লোকটা ‘ও মারে’ বলে বসে পড়ল মাথায় হাত দিয়ে। তবে সে রাস্তার ওপর বসে পড়ল একটা পা সোজা করে। তার মানে, তার হাঁটু গেছে। অন্তু ততক্ষণে লাফ দিয়ে আমার দিকে চলে এসেছে। ফিসফিস করল, মেয়েটা কোথায়?

এদিকে আয় বলে আমি অন্তুকে নিয়ে ছুটলাম পেছন দিকে। যেন লোকটা দেখতে পায় আমরা রাস্তা ধরে পেছন দিকে ছুটে গেছি। লোকটা তখন মাটিতে বসে কোঁকাচ্ছে। এক হাত মাথায়, এক হাত হাঁটুতে।

মেয়েটা কইরে?

আছে। আমি অন্তুকে নিয়ে এবার রাস্তা থেকে ধানখেতে নেমে গেলাম। সাবধানে এগিয়ে গেলাম পাটখেতের দিকে।

তোকে অনেক ধন্যবাদ, রবি। তুই না এলে...অন্তু ফিসফিস করে বলে। আমি কিছু বললাম না। পাটখেতের ভেতর অন্তুকে নিয়ে ঢুকে গেলাম। ওপরে একটা অস্পষ্ট চাঁদের আলোর কারণে আবছা আবছা দেখতে পাচ্ছি।

তোকে যে মারল ব্যথা করছে না?

একটু আগেও করছিল, এখন আর করছে না।

মেয়েটা ঠিক সেখানেই বসে আছে শান্ত ভঙ্গিতে। আমার ব্যাগটার ওপর।

আমার খুব খিদে পেয়েছে। তোমাদের কাছে খাবারটাবার কিছু আছে? মেয়েটা ফিসফিস করে বলল। আমার ব্যাগে দুটো বার্গার ছিল। একটা মেয়েটাকে দিলাম। তোমার নাম কী?

মেয়েটা হাপুসহুপুস করে বার্গারটা খেতে লাগল। বলল, নিতু।

তুই খাবি? আরেকটা বার্গার আমি অন্তুর দিকে এগিয়ে দিলাম। অন্তু অর্ধেকটা ছিঁড়ে নিয়ে বাকি অর্ধেকটা আমাকে দিল। আমার অত খিদে ছিল না। তারপরও খেয়ে ফেললাম। তখনই খেয়াল করলাম, অন্তুর কাঁধে ওর ব্যাগটা নেই।

তোর ব্যাগ কই?

ওই ব্যাগের জন্যই তো ধরা খেলাম। ওটা ওরা রেখে দিয়েছে।

কীভাবে হলো?

তোদের পিছে পিছে ছুটে আসছিলাম। তখন ওই লম্বা লোকটা ব্যাগটা ধরে আমাকে আটকে ফেলল। ব্যাগে ৫০০ টাকার নোটটা ছিল...। অন্তু আফসোসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে।

বাদ দে, চল আমরা এগোই।

হ্যাঁ, চল।

পাটখেতের ভেতর দিয়ে দিয়ে আমরা কতক্ষণ হেঁটেছি, বলতে পারব না। হাঁটতে হাঁটতেই মেয়েটার সঙ্গে আমাদের কথা হলো। তার পুরো নাম ফারজানা খান নিতু। থাকে ধানমন্ডি । স্কলাসটিকা স্কুলে পড়ে। স্কুলের গেট থেকে বের হয়ে ফুচকা খাচ্ছিল, সাধারণত ফুচকা সে খায় না। ওই দিন তাদের গাড়ি আসতে দেরি হচ্ছিল বলে খাচ্ছিল। তখন হঠাৎ একটা সাদা মাইক্রোবাস এসে তার পাশে থামল। সে কিছু বোঝার আগেই তার মুখে রুমাল চেপে বাসের ভেতর উঠিয়ে নেয়। তারপর আর কিচ্ছু মনে নেই। মাঝখানে তিনবার ওরা গাড়ি পাল্টেছে।

নিতু বলল, একবার দোতলা বাড়ির একটা রুমে ছিলাম। ওরা আমাকে মাঝেমধ্যেই জুসের মতো মিষ্টি মিষ্টি কিছু খাওয়াচ্ছিল, ওটা খেয়েই মনে হয় আমার...তবে শেষবার জ্ঞান ফেরে ট্রাকের ভেতর। তখন তোমাদের দেখি।

কিন্তু চিরকুটটা কখন লিখেছিলে?

লিখেছিলাম, এটা মনে আছে, কিন্তু কখন লিখেছিলাম মনে নেই। কারণ, ওই যে বললাম, আমাকে তিনবার তিনটা গাড়িতে করে নিয়ে ঘুরেছে। একটা বাসায় ছিলাম এক রাতে একটা রুমে, ওই রুমটায় কাগজ–কলম, বইপত্র সবই ছিল, একটা নষ্ট টিভিও ছিল। মনে হয় ওখানেই লিখেছিলাম। তিনটা চিরকুট লিখেছিলাম। তিনটা তিন জায়গায় ফেলেছি।

বাহ্‌ ভালো বুদ্ধি।

আমরা চিরকুটা পেয়েছিলাম ট্রাকের ভেতর। ওরা তোমাকে ট্রাকে করে নিচ্ছিল কেন?

সেটা জানি না। কিন্তু তোমরা ট্রাকে করে কোথায় যাচ্ছিলে?

হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠলাম আমি।

হাসলে কেন?

সে অনেক কাহিনি। পরে বলব। এখন জলদি জলদি মেইন রোডে ওঠা দরকার আমাদের।

ঠিক বলেছ। আমরা কিন্তু এখনো বিপদ থেকে মুক্ত নই। আমরা দ্রুত পা চালিয়ে হাঁটতে লাগলাম।

হাঁটতে হাঁটতে একটা আইলের ওপর একটা দোকান টাইপ কিছু মনে হলো। আমাদের দেখে বুড়ো দোকানদারও অবাক। এই সময় কাস্টমার থাকে না, সে দোকান বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছে।

তোমরা কোন বাড়ির? বুড়ো লোকটা প্রশ্ন করে।

পানি আছে? তার প্রশ্নর উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করি।

আছে, কলা, রুটি, টোস বিস্কুট আর গুড়ের চা—সবই আছে।

আমরা বসে পড়লাম। পানি আর গুড়ের চা দেন।

টোস বিস্কুট খাও চা দিয়া, ভালো লাগব।

দেন।

স্কুলের গেট থেকে বের হয়ে ফুচকা খাচ্ছিল, সাধারণত ফুচকা সে খায় না। ওই দিন তাদের গাড়ি আসতে দেরি হচ্ছিল বলে খাচ্ছিল। তখন হঠাৎ একটা সাদা মাইক্রোবাস এসে তার পাশে থামল।

আমরা তিনজন শুধু চা আর বিস্কুট খাব বলে বসলাম, তারপর কলা–রুটিও খেয়ে ফেললাম। কলা–রুটির যে এত স্বাদ, কে জানত। আমি তো দুটো কলা খেয়ে ফেললাম। অন্তুও খেল দুটো। নিতুও খেল। তারপর চা খেলাম। অসাধারণ লাগল। গুড়ের চা আগেও খেয়েছি, কিন্তু এটা মনে হচ্ছে সুপার–ডুপার টেস্টি চা।

তোমরা কোন বাড়ির? লোকটা আবার প্রশ্ন করে।

ওই তো ওদিকে...অন্তু এড়ানোর চেষ্টা করে।

কাজীবাড়ি?

জি।

বেড়াইতে আইছ?

জি জি।

হুম...তোমগো দেইখাই বুঝছিলাম। রাইত হইছে, বাড়ি যাও। আমরা এত কিছু খেলাম, বিল হলো মাত্র ২২ টাকা। বুড়ো চাচা দুই টাকা কম নিল, ২০ টাকা রাখল।

দাদু এখান থেকে বড় সড়কটা কোন দিকে?

এই পথেই সোজা গিয়া ডাইনে।

আমরা চাচাকে ধন্যবাদ দিয়ে আইল ধরে রওনা হলাম। শরীরে এখন প্রবল শক্তি। আমার খুব অবাক লাগছে। একটু আগেও নিতু নামের মেয়েটাকে চিনতাম না, অথচ ওর জন্য কী ভয়ংকর একটা রিস্ক নিলাম আমি আর অন্তু। আর মেয়েটাও কী স্বাভাবিকভাবে হাঁটছে আমাদের সঙ্গে, যেন সে জানতই আমরা ওকে উদ্ধার করব। এ যে গল্প–উপন্যাসের অ্যাডভেঞ্চারকেও হার মানায়!

আমার মনে হয় তুমি তোমার বাবাকে একটা ফোন করো, অন্তু বলে।

ফোন তো পেতে হবে।

হ্যাঁ, তাই আমরা আগে মেইন রোডে উঠি । ওখানে নিশ্চয়ই কোনো ফোনের দোকান পাব। তখনই চিন্তাটা মাথায় এল। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম।

কী হলো? নিতু জানতে চায়।

আমি এখন একটা খুব জরুরি কথা বলব।

কী সেটা?

আমি গল্প–উপন্যাস বা সিনেমায় দেখেছি। যেকোনো অ্যাডভেঞ্চারে প্রথম উদ্ধার পর্বটা বেশ সহজেই হয়। যেমন আমরা নিতুকে উদ্ধার করলাম কিন্তু খুব সহজেই।

খুব সহজে না, লোকটা আমাকে যেভাবে মারছিল...উফ্‌, মাথাটা মাঝেমধ্যে এখনো টনটন করছে। তুই ঠিক সময় না এলে আমার খবরই ছিল।

তারপরও আমি বলব, প্রথমবার আমরা বেশ সহজেই ওকে উদ্ধার করতে পেরেছি।

তুমি কী বলতে চাচ্ছ? নিতু জানতে চায়।

আমি বলতে চাচ্ছি, যেকোনো অ্যাডভেঞ্চারে কিন্তু দ্বিতীয়বার ভয়ংকর বিপদে পড়তে হয়। সেটা থেকে উদ্ধার পাওয়া কঠিন। কাজেই...তখনই পায়ের শব্দ পাওয়া গেল, কে যেন ছুটে আসছে। আমরা তিনজন চট করে আইল থেকে নেমে ধানখেতে নিচু হয়ে প্রায় শুয়ে পড়ার মতো করে লুকিয়ে পড়লাম। রাত হয়েছে বলে সুবিধাই হয়েছে। চট করে আশপাশে কিছু দেখা যাচ্ছে না। যে ছুটে আসছে, তার হাতে একটা টর্চ। টর্চের আলো এদিক–ওদিক ফেলতে ফেলতে ছুটে আসছে। বোঝাই যাচ্ছে আমাদের পাগলের মতো খুঁজছে। আরেকটু কাছে আসতেই বোঝা গেল সেই লোকটা, হাতে সেই লাঠিটা আর টর্চ। দ্বিতীয় লোকটা নেই, যে বোরকা পরে মেয়ে সেজে এসেছিল। তার মানে, দ্বিতীয় লোকটা ভালো আহত হয়েছে। হয়তো হাঁটতেই পারছে না। ঠিক আমাদের মাথার ওপর দিয়ে ছুটে গেল লোকটা, তার মানে সে আমাদের পাগলের মতো খুঁজে চলেছে সবখানে। ওই গুড়ের চায়ের দোকানদার কিছু বলেছে কি? বলার কথা না। কারণ, আমরা বের হওয়ামাত্র লোকটা ঝাপ ফেলে তার দোকান বন্ধ করে ফেলে।

যাহোক, টর্চ হাতে লোকটা চলে যাওয়ার পর আমরা সাবধান উঠে এলাম।

তুই ঠিক কথা বলেছিস, দ্বিতীয়বার বিপদে পড়া চলবে না আমাদের। আমরা কি এই পথেই যাব?

হ্যাঁ, তবে খুব সাবধানে। আমাদের দুজনকে অবাক করে নিতু গুন গুন করে গান গেয়ে উঠল। আর কী আশ্চর্য, আকাশে মস্ত একটা চাঁদ! একটু আগেও চাঁদ ছিল না। নিতু গান থামিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, এটা গুরু পূর্ণিমার চাঁদ।

মানে? আমরা তিনজনই তখন বেশ ফুরফুরে মেজাজে এগোচ্ছিলাম।

মানে...গু হচ্ছে খারাপ, অন্ধকার অমানিশা...আর রু হচ্ছে জ্ঞান। অন্ধকার দূর করে জ্ঞানের যে আলো...নিতু বেশ গুছিয়ে মোটামুটি একটা বক্তৃতাই দিয়ে ফেলল। আমরা দুজনেই বেশ অবাক হলাম।

তুমি এত কিছু জানলে কী করে?

মায়ের কাছে শুনেছি। জানো, আমার কিন্তু ভীষণ ভালো লাগছে।

কেন?

এই যে গ্রামের রাস্তা দিয়ে হাঁটছি...কী সুন্দর বাতাস...নানা রকম পোকার ডাক শুনতে পাচ্ছি। আকাশে গুরু পূর্ণিমার চাঁদ।

কেন? মা–বাবার জন্য চিন্তা হচ্ছে না?

মোটেই না। একটা ফোন করতে পারলেই এখন সব সমাধান হয়ে যাবে। আচ্ছা, তোমাদের কক্সবাজার যাওয়ার গল্পটা বললে না?

তাহলে শোনো। অন্তু মাহিনের কাহিনি বলতে শুরু করে ফিসফিস করে। আমি সামনের দিকে এগিয়ে যাই একটু। তীক্ষ্ণ নজর দিই সামনের দিকে। দ্বিতীয়বার বিপদে পড়লে চলবে না। কিছুতেই না, আমি সত্যিই সিরিয়াস।

অলংকরণ: আরাফাত করিম
ডানে? না বামে? সময় যেন থেমে গেছে...আচমকা প্রচণ্ড গাড়ির টায়ারের স্কিড করার একটা শব্দ হলো...স্ক্রিইইইইচ! তারপর ধাম করে একটা বিকট শব্দ হলো

একটু পরেই বাস–ট্রাকের শব্দ শুনতে পাই আমরা তিনজনই। তার মানে সামনেই মেইন রোড। আরেকটু এগিয়ে গিয়ে আমি বললাম, এখন আর ঠিক এই পথে আমরা মেইন রোডে উঠব না। যেহেতু টর্চ হাতে লোকটা এই পথেই গিয়েছে। সে সামনে ঘাপটি মেরে বসে থাকতে পারে। এক কাজ করি। তোরা দুজন এই গাছটায় উঠে বসে থাক। আমি একা যাই। নিতু, ফোন নম্বরটা বলো।

০১৭১...

যেহেতু আমাদের সঙ্গে কাগজ–কলম নেই। আমি দু–তিনবার আউড়ে মুখস্থ করে নিলাম নম্বরটা।

এটা কার নম্বর?

বাবার।

তোমার বাবার নাম বলো।

বাবার নাম ভুলে গেছি

মানে?

হি হি করে হাসে নিতু। যে বিপদে পড়েছিলাম বাবার নাম ভুলে যাওয়ার কথা না? দাঁড়াও মনে করার চেষ্টা করি।

ফাজলামো হচ্ছে? মনে রেখো, বিপদ কিন্তু এখনো কাটেনি।

হি হি নিতু হাসতেই থাকে। মেয়েটা মনে হচ্ছে একটু পাগল আছে।

মনে পড়েছে, মনে হয় আফজাল খান। খন্দকার আফজাল খান।

ঠিক আছে। তোরা এখানে বসে থাক। আমি যাচ্ছি।

খুব সাবধান রবি। দুজন একসঙ্গে বলে।

তোরাও সাবধান, মনে রাখবি, দ্বিতীয়বার বিপদে পড়তে চাই না আমরা।

আমি এগিয়ে গেলাম। একটু ঘোরা পথে সরু রাস্তাটা ছেড়ে একটা আইল ধরে মেইন রোডে উঠে এলাম। ফাঁকা রাস্তা, মাঝেমধ্যে ট্রাক ছুটে যাচ্ছে। এটা কোন জায়গা কে জানে। এত রাতেও বেশ লোকজন আছে। বাজার এলাকা। আমি খুঁজতে খুঁজতে একটা ফোনের দোকান পেলাম। একটা অল্প বয়স্ক ছেলে দুটো পুরোনো নকিয়া সেট নিয়ে বসে আছে। কাগজে লেখা, প্রতি কল ৫ টাকা। দুই মিনিটের বেশি কথা বললে ১০ টাকা।

একটা ফোন করব।

করো। ফোনটা এগিয়ে দিল। আমি আগেই জেনে নিয়েছিলাম, এই জায়গাটার নাম ছিরুম বাজার, চট্টগ্রাম রোড। ওপাশে ফোন বাজছে...ফোন বাজছে। আমার বুকটা ঢিপ ঢিপ করছে। চতুর্থবারে ফোন ধরল কেউ।

হ্যালো?

আফজাল সাহেব বলছেন?

হ্যাঁ।

আমরা নিতুকে উদ্ধার করেছি। আমরা আছি ছিরুম বাজার চট্টগ্রাম রোডে। নিতু ভালো আছে। এখন জলদি আমাদের এখান থেকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করুন। এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেললাম।

তোমরা কারা? তুমি কে?

আমার নাম রবি। একটা ফোনের দোকান থেকে কল দিয়েছি। জলদি করুন। কিডন্যাপাররা এখনো আমাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে।

আচ্ছা, আমি এখনই ব্যবস্থা নিচ্ছি। নিতু কি আশপাশে আছে?

না, ও একটা গাছে উঠে লুকিয়ে আছে। ভয় নেই, ওর সঙ্গে আমার বন্ধু অন্তু আছে।

আচ্ছা আচ্ছা।

দ্বিতীয় ফোনটা করলাম আমার মাকে।

হ্যালো মা, কেমন আছ?

ব্যাপার কী, একটা ফোন নেই, আমি টেনশন করছি। যাওয়ার সময় ভুল করে ফোন নম্বর নিইনি মাহিনের।

ভাগ্য ভালো যে মাহিনের ফোন নম্বর দিতে ভুলে গেছি।

কী করব, নেটওয়ার্ক নেই এখানে। আমি চেঁচিয়ে বলি, আমরা ভালো আছি কক্সবাজারে পৌঁছেছি। অন্তুও ভালো আছে।

উফ্‌...আচ্ছা ঠিক আছে, আমি এখনি অন্তুর মাকে ফোন দিচ্ছি। তারাও টেনশন করছিল।

আচ্ছা জানিয়ে দাও।

আচ্ছা, ভালো থাকিস।

ফোনের বিল মিটিয়ে দিলাম। দুই মিনিটের বেশি হয়েছে। ১০ টাকা। ছেলেটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমার কথা শুনে কি অবাক হলো? আর ঠিক তখনই দেখলাম লোকটাকে। টর্চ আর লাঠি নিয়ে রাস্তার অন্য পাশে দাঁড়িয়ে, আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমার কলজে উড়ে গেল। লোকটা অন্তুকে দেখেছে, আমাকে তো দেখেনি, নাকি দেখেছে। ট্রাকে দেখতে পারে, সেটা কি মনে রেখেছে? হঠাৎ লোকটা আমার দিকে ছুটে আসতে লাগল। আমার মাথায় দ্রুত চিন্তা চলছে। কী করব? ছুট লাগাব? কিন্তু কোন দিকে ছুটব? ডানে? না বামে? সময় যেন থেমে গেছে...আচমকা প্রচণ্ড গাড়ির টায়ারের স্কিড করার একটা শব্দ হলো...স্ক্রিইইইইচ! তারপর ধাম করে একটা বিকট শব্দ হলো। আমি হতভম্ব হয়ে দেখলাম, লোকটা একটা ধবধবে সাদা মাইক্রোবাসের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে উড়ে গিয়ে পড়ল একটা দোকানের ওপর। হুড়মুড় করে দোকানটা ভেঙে পড়ল। মুহূর্তে ভিড় জমে গেল। হইচই কাণ্ড। সাদা মাইক্রোবাসটা থামল না, কোনোমতে এঁকেবেঁকে চালিয়ে আবার সোজা হয়ে রাস্তায় উঠে ভোঁ ভোঁ করে ছুটে বেরিয়ে গেল ফাঁকা রাস্তা দিয়ে। মাইক্রোবাসের দোষ নেই। নিয়তি নিজেই আমার চোখের সামনে নিতুর একজন কিডন্যাপারের জীবন ছিনিয়ে নিল বলে আমার মনে হচ্ছে। মানুষের ভিড়ভাট্টার দিকে গেলাম না। লোকটা নিশ্চয়ই মরেই গেছে। এবার রাস্তা পার হলাম নিশ্চিন্তে। হঠাৎ দেখি লোকটার হাতের টর্চটা রাস্তার ধারে পড়ে আছে। এখনো কেউ দেখেনি। দেখলে নিশ্চয়ই উঠিয়ে নেবে। আমার কেন যেন মনে হলো, আর ভয় নেই। হঠাৎ দেখি একটা ছোট্ট ফার্মেসির বেঞ্চে সেই গোঁফওয়ালা লোকটা বসে আছে। মাথায় ব্যান্ডেজ, পায়েও হাঁটুর কাছে প্লাস্টার করা, আমার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে এখনো জানে না, তার পার্টনার মারা গেছে (সম্ভবত)। আমার যে কী হলো আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। লোকটার দিকে তাকিয়ে বললাম, আপনার বোরকা কই? জলদি ওটা পরে ফেলুন, পুলিশ আসছে কিন্তু...! লোকটা ভয়ংকর রকমভাবে দাঁত কিড়মিড় করে উঠে দাঁড়াতে গেল, যেন আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে...তারপরই ও মাগো মাগো বলে ধপ করে বেঞ্চে বসে পড়ল!

আমি নিশ্চিন্ত মনে হেঁটে হেঁটে সেই গাছটার নিচে এসে দাঁড়ালাম। চেঁচিয়ে বললাম, এই তোমরা নেমে আসো। আর ভয় নেই। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নেই। আমার বুকটা ধক করে উঠল। ওরা দুজন গাছে নেই। আমি কি ভুল গাছের নিচে দাঁড়িয়েছি? প্রশ্নই ওঠে না। গাছ এখানে একটাই। তাহলে কি সত্যি সত্যিই যে ভয়টা পেয়েছিলাম, তা–ই হলো। দ্বিতীয়বার বিপদে পড়লাম আমরা! তখনই খিল খিল হাসির শব্দ। পাশের একটা উঁচু ডিবির পেছন থেকে ওরা দুজন বের হয়ে এল।

তোকে ভয় পাওয়াতে নিতুর প্ল্যান এটা। অন্তু বলে।

তোমাকে দূর থেকে আসতে দেখে একটু মজা করলাম। বাবাকে ফোন করেছিলে?

হ্যাঁ, উনি ব্যবস্থা নিচ্ছেন। আমাদের আর ভয় নেই।

আর ভয় নেই কেন? অন্তু জানতে চায়।

একটু আগে দুজন কিডন্যাপারের একজন রোড অ্যাকসিডেন্ট করে সম্ভবত মারা গেছে। আমাকে ধরতেই ছুটে আসছিল, তখন একটা মাইক্রোবাস...

উফ্‌, সত্যি তুমি দেখেছ?

হ্যাঁ, দেখলাম মুখ থুবড়ে পড়ে আছে একটা দোকানের ভেতর।

আর আরেকজন?

ও দেখলাম একটা ফার্মেসিতে বসে আছে মাথায় ব্যান্ডেজ আর হাঁটুতে প্লাস্টার!

ওই ব্যাটার হাঁটুর বাটি মনে হয় সিঙ্গাপুর থেকে এনে লাগাতে হবে। বলে অন্তু খিক খিক করে হাসতে লাগল। উফ্‌, সত্যি তুই যা একটা লাথি দিয়েছিলি রবি।

সত্যি...আমিও দেখেছি। বলে নিতু।

মানে? তুমি কীভাবে দেখলে?

হি হি...তুমি আমাকে বসে থাকতে বললেও আমি তোমার পিছে পিছে এসে দেখেছি।

একটু বাদেই আমরা তিনজন মেইন রোডে উঠে এলাম। আকাশে সেই নিতুর গুরু পূর্ণিমার চাঁদ । মেইন রোডে তখনো ভিড়–হইচই–হট্টগোল। একটা পুলিশের গাড়িও দেখলাম। তখনই আকাশে দেখা গেল ছোট্ট একটা হেলিকপ্টার, ভট ভট শব্দ করে চক্কর খাচ্ছে। হেলিকপ্টারটা রাস্তার ওপরই নেমে এল। কারণ, রাস্তা তখন কিডন্যাপারের অ্যাকসিডেন্টের কারণে মোটামুটি বন্ধই বলা চলে। যা–ও দুয়েকটা গাড়ি আসছে, ছোট্ট হেলিকপ্টারটাকে পাশ কাটিয়ে দিব্যি চলে যাচ্ছে। হেলিকপ্টার দেখে লোকজন সব এবার লাশ ফেলে হেলিকপ্টারের চারদিকে ভিড় করল। এত রাতে এখানে হেলিকপ্টার কেন? নিতু হঠাৎ বাবা...বলে ছুটে গেল হেলিকপ্টারটার কাছে। তার মানে, নিতুর বাবা এসেছেন হেলিকপ্টারে করে।

দেখেছিস, নিতুরা মাহিনদের থেকেও বড়লোক। অন্তু বলে।

কীভাবে বুঝলি?

দেখছিস না ওর বাবা হেলিকপ্টারে করে এল।

আরে গাধা, আজকাল হেলিকপ্টার ভাড়া পাওয়া যায়। ওই দেখো, গায়ে লেখাই আছে রেন্ট এ ফ্লাই। একটু বাদেই নিতু তার বাবাকে নিয়ে এসে হাজির হলো আমাদের কাছে। নিতুর বাবা মেয়েকে ছেড়ে আমাদের দুজনকে জড়িয়ে ধরে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেললেন। বয়স্ক মানুষ কাঁদলে বড় অদ্ভুত লাগে। তখন হেলিকপ্টার ছেড়ে এবার আমাদের নিয়ে ভিড়। আমার আর অন্তুর বেশ লজ্জা লাগছিল। আর ওই এলাকার লোকজন নিশ্চয়ই খুব অবাক, রাস্তার ওপর এক রাতে এত নাটক! তবে রাস্তার ওপর নাটক আর বেশিক্ষণ চলল না। নিতুর বাবা আমাদের নিয়ে উড়াল দিল হেলিকপ্টারে করে। ততক্ষণে পুলিশ চলে এসেছিল। নিতুর বাবার সঙ্গে কথাও বলেছে। পরে যোগাযোগ করবে বলে তারা লাশটা নিয়ে তাদের পিকআপে উঠিয়ে চলে গেছে। তখনই আমার মনে হলো দ্বিতীয় কিডন্যাপারটাকেও তো ধরা দরকার ছিল! ওটাকে কি ধরতে পেরেছে পুলিশ? আমার মনের কথা বুঝেই যেন নিতুর বাবা বলে উঠল—

ওই দেখো।

তাকিয়ে দেখি দুজন পুলিশ মাথায় আর হাঁটুতে ব্যান্ডেজ বাঁধা দ্বিতীয় কিডন্যাপারকে গাড়িতে ওঠাচ্ছে। কিন্তু পুলিশ বুঝল কী করে যে ও একজন কিডন্যাপার!

অলংকরণ: আরাফাত করিম

আমরা কোথায় যাচ্ছি? অন্তু ফিসফিস করে বলে নিতুকে।

কক্সবাজার। বলে নিতু হাসে। আমি আব্বাকে সব বলেছি। কোনো মানে আছে, আমি মনে মনে বলি। অন্তু তখন হতভম্ব হয়ে হেলিকপ্টারের জানালা দিয়ে দেখছে বাইরের গুরু পূর্ণিমার চাঁদ। আমিও তাকালাম তার দৃষ্টি অনুসরণ করে। আর শুনতে লাগলাম নিতু তার বাবাকে ফিসফিস করে পুরো অ্যাডভেঞ্চারের গল্পটা বলছে। আমরা কীভাবে ওকে নিয়ে ছুটে বের হয়ে পাটখেতে ঢুকলাম। তারপর অন্তু পেছন থেকে ধরা পড়ে গেল, ওর ব্যাগটা ওরা রেখে দিল, যার ভেতর অন্তুর ৫০০ টাকা ছিল। তখন আমি নিতুকে রেখে একাই কীভাবে আক্রমণ করলাম কিডন্যাপারকে। লাথি দিয়ে পা ভেঙে দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিলাম। শুনতে শুনতে আমি নিজেও শিউরে উঠলাম! সত্যিই আমি এত একা একা এত ভয়ংকর সব কাণ্ড করেছি? নিতুর বাবা অবাক হয়ে শুনছিলেন আর মাঝেমধ্যে পেছন ফিরে আমাদের দুজনতে দেখছিলেন। ছয় সিটের হেলিকপ্টার। একদম সামনে একজন পাইলট তার পাশে একজন, সে সম্ভবত নিতুর বাবার লোক। তারপরের দুই সিটে নিতু আর তার বাবা। তারপর আমি আর অন্তু। পেছনেও একটা সিটের মতো জায়গায় আরেকটা লোক বসে আছে। লোকটা একটু পরপর আমাদের সবাইকে কফি ঢেলে দিচ্ছিল। হেলিকপ্টারে বসে পোড়া পোড়া গন্ধের কফি খেতে খেতে (এই জিনিস আগে খাইনি) গুরু পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, আমরা দুজন কি কোনো স্বপ্নের ভেতর ঢুকে পড়লাম নাকি! এত আশ্চর্য ঘটনাও জীবনে ঘটে! তবে পোড়া পোড়া গন্ধের কফিটা কিন্তু বেশ লাগছিল।

আরও আশ্চর্যের ঘটনা আসলে তখনো বাকি ছিল। কক্সবাজারে পৌঁছে চমত্কার একটা হোটেলে উঠলাম আমরা। খেয়েদেয়ে গোসল করে আমি আর অন্তু একটা আরামদায়ক ঘুম দিলাম ফোমের নরম বিছানায় । তারপর সকালে উঠে দে ছুট সি বিচে। নিতুও ছুটল আমাদের সঙ্গে। ওর বাবা আর সেই কফি দেওয়া লোকটা—মনে হলো লোকটা নিতুর বাবার বডিগার্ড টাইপের কিছু হবে। কারণ, তার বগলের নিচে আমি একটা পিস্তল দেখেছি। আমি আর অন্তু লাফিয়ে নামলাম সমুদ্রে! বিশাল বড় বড় ঢেউ এসে ফের আমাদের ছিটকে ফেলল বালুর ওপর। আমাদের অবস্থা দেখে হি হি করে পাড়ে দাঁড়িয়ে হাসে নিতু, মেয়েটার মনে হয় হাসির রোগ আছে। কতক্ষণ যে সমুদ্রের ঢেউয়ে লাফালাফি করলাম জানিও না। চোখ লাল করে উঠে এসে দেখি, হতভম্ব হয়ে লাল শার্ট পরা একটা ছেলে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ দুটো ঠিকরে বের হয়ে আসার উপক্রম। আমি আর অন্তু হাঁপাতে হাপাতে উঠে এসে বললাম, কী রে মাহিন, কেমন আছিস? চিনতে পারছিস আমাদের? নিতু পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠল, এই তোমরা দেরি করছ কেন, জলদি চলো হোটলে। আমার মা–ও চলে এসেছে ঢাকা থেকে।

দুদিন কক্সবাজার থেকে আমরা প্লেনে করে ফিরে এলাম ঢাকায়। নিতুর মা–বাবা আর নিতুর সঙ্গে। সত্যি, পাঁচ দিনে কত রকমের অভিজ্ঞতা যে হলো। পুলিশের কাছে ইন্টারভিউ দিতে হলো, সাংবাদিকদের কাছেও ইন্টারভিউ দিতে হলো...সত্যি, জীবনে কত অদ্ভুত ঘটনা যে ঘটে! আরও একটা অদ্ভুত ঘটনা বাকি ছিল ঢাকায়। সেটা হচ্ছে ঢাকায় ফেরার পর এক সকালে মা ডেকে তুলল আমাকে।

একটা মেয়ে তোকে ডাকছে।

মেয়ে? আমি অবাক হলাম। বাইরে এসে দেখি মাহিনের বোন রিনি দাঁড়িয়ে!

তুমি? মাহিন কোথায়?

আমি একাই এসেছি। তাকিয়ে দেখি, সত্যিই বাইরে ওদের গাড়িটা দাঁড়িয়ে। ড্রাইভার ব্যাটা চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে আছে ব্যাপারটা বুঝতে।

কী ব্যাপার?

আমি সরি বলতে এসেছি।

কীসের জন্য?

তোমাদেরকে কক্সবাজার না নেওয়ার প্ল্যানটা আমার ছিল—বলে সে চোখ নামিয়ে হঠাৎ ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। আমাকে ক্ষমা করে দাও প্লিজ!

না না ঠিক আছে। আসো, ভেতরে এসে বসো! আমি আর কী বলব? রিনি সত্যি সত্যি দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগল। আর আমি তখন ভাবছিলাম রিনির এই ষড়যন্ত্রের কারণেই তো আমরা অ্যাডভেঞ্চার করলাম, একটা মেয়েকে উদ্ধার করলাম, হেলিকপ্টারে চড়লাম, প্লেনে চড়লাম। নিতুর মা–বাবার কাছ থেকে দামি দামি উপহার পেলাম... কক্সবাজারও ঘুরলাম, সমুদ্রও দেখলাম...আর কাগজে আমাদের হিরো হওয়ার (!) খবর তো এখন দেশের প্রায় সবাই জানে। ফেসবুকেও নাকি আমরা এখন ভাইরাল! কী জ্বালা! নাহ একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট এবার খুলতেই হবে (অন্তু নাকি খুলেছে, রিনি ওকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছে, হা হা হা!)। নিতুর মা আমাদের দুজনকে দুটো স্মার্টফোন গিফট করেছে, কাজেই ফেসবুক খোলায় এখন আর কোনো সমস্যা নেই!

হ্যাঁ, রিনিকে আমরা ক্ষমা করে দিয়েছি। মাহিনকেও। অবশ্য স্থানীয় পলিটিকসের কারণে আমাদের ফুটবল ক্লাবটা উঠে গেছে। যে কারণে মাহিনের সঙ্গে আর দেখা হয় না। আমরা অবশ্য এখন আর মাহিনের বাসায়ও যাই না। উল্টো মাহিনই মাঝেমধ্যে আমার আর অন্তুর বাসায় আসে। তখন আমি আর অন্তু মাঝেমধ্যে হালকা ভাব নিই। আগে যেমনটা মাহিন নিত। ঢিল মারলে পাটকেলটি খেতে হয়, এটাই বোধ হয় নিয়ম, কে জানে!