জয়িতা ও বোকা বাবা

অলংকরণ: অসীম চন্দ্র রায়

বারান্দার ঘুলঘুলিতে একজোড়া চড়ুই বাসা বেঁধেছে। এতক্ষণে সেই জুটির বাসা ছেড়ে বের হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু আজ যায়নি। বারান্দার গ্রিলে বসে কিচিরমিচির করছে।

দরজা গলিয়ে সাবধানে জয়িতাকে মাথা বের করতে দেখেও পাখি দুটো উড়ে পালাল না। শুধু গ্রিলের এক ফোকর থেকে উড়ে গিয়ে আরেকটায় বসল। তারপর আবারও শুরু করল কিচিরমিচির। আচ্ছা, পাখিদের নিজস্ব কোনো ভাষা কি আছে? নিশ্চয়ই আছে। গুগল ট্রান্সলেটরের মতো পাখিদের ভাষা বোঝার কোনো যন্ত্র  যদি থাকত! জয়িতার খুব ভাবতে ইচ্ছে করছে, পাখিগুলো অপেক্ষা করছিল তার জন্যই, তাকে শুভেচ্ছা জানাবে বলে। আজ যে জয়িতার জন্মদিন!

একটা পাখির নাম জয়িতা দিয়েছে তিড়িং। আরেকটা বিড়িং। তিড়িং মেয়ে পাখিটা, বিড়িংটা ছেলে। যদিও জয়িতা দুজনকে আলাদাই করতে পারে না। আচ্ছা, পাখিরা কীভাবে একে অন্যকে চেনে? সব পাখিই তো দেখতে একই রকম?

ভাবতেই জয়িতার হাসি পেল। এমন যদি মানুষের বেলাতেও হতো? সব মানুষই দেখতে একই রকম! একসঙ্গে একই রকম দেখছে অনেকগুলো জয়িতা। অনেকগুলো একই রকম দেখতে বাবা। একই রকম মা!

জয়িতা হয়তো বুদ্ধি করে অন্য এক জয়িতার সঙ্গে বাসা অদল-বদল করে নিত। কিন্তু সেখানে গিয়ে যে বাবা আর মাকে সে পেত, কেমন হতো তারা? এক রকম দেখতে হলেই তো সবাই এক রকম হবে না।

ইদানীং বাবা-মা দুজনের ওপর খুব রাগ হয় জয়িতার। অভিমান মেশানো রাগ। বাবা-মা ভাবে, জয়িতা তো খুব ছোট, কিচ্ছু বোঝে না। সত্যিটা বরং, জয়িতাই এমন অনেক কিছু বোঝে, বাবা-মা বোঝে না। জয়িতা যেমন ঠিক বোঝে, বাবা-মা আলাদা হয়ে যাচ্ছে শিগগিরই। শিগগিরই নতুন একটা বাবা সে পেতে যাচ্ছে।

শুধু জয়িতা নয়, এই কথা এখন অনেকেই জানে। এসব কথা এ-কান ও-কান হতে সময় লাগে না। মৌনিতা সেদিন বেশ আফসোস করেই বলছিল, ‘তোর কী ভাগ্য রে জয়ী, ভালো একটা বাবা পাচ্ছিস। সেই বাবা আবার থাকে কানাডায়। কানাডার মতো দেশের সিটিজেন হয়ে যাবি। কী সুন্দর স্নো ফল হয়! আমি টিভিতে দেখেছি!’

জয়িতা ভেবেছিল মৌনিতা ঠাট্টা করছে।

পরে বুঝেছে, শুধু মৌনিতা নয়, তার ক্লাসের আরও অনেকে জয়িতাকে সত্যিই ঈর্ষা করতে শুরু করেছে। জয়িতা ভালো একটা বাবা, ভালো একটা পরিবার, ভালো একটা দেশ পাচ্ছে বলে। আশ্চর্য! কেউ জয়িতা আর তার বাবার বিচ্ছেদটা বড় করে দেখছেই না!

জয়িতার নতুন হবু বাবাকে দেখে অবশ্য সবারই হিংসা করার কথা। সেই বাবা নিজের বাবার মতো হ্যাংলা নয়, বোকা বোকা নয়; ভীষণ স্মার্ট। জয়িতা তাকে ডাকে শাহেদ আঙ্কেল। বাবার বিশ্ববিদ্যালয়–জীবনের বন্ধু। পাস করেই কানাডা চলে গিয়েছিলেন।

অনেক দিন পর দেশে ফিরেছেন। এক মাসের ছুটি শেষ হয়ে যাচ্ছে কিছুদিনের মধ্যেই। শাহেদ আঙ্কেল প্রায়ই জয়িতাদের বাসায় আসেন। আর কানাডার গল্প করেন, ‘কানাডার সবচেয়ে ভালো দিক কী, জানিস জয়ী? সেখানে পকেটে করে শুধু চিনি আর গুঁড়া দুধ নিয়ে বের হবি। তারপর বরফ কুড়িয়ে নিয়ে দুধ-চিনি মেশালেই আইসক্রিম!’

আইসক্রিম জয়িতার খুব প্রিয় বলেই হয়তো লোভ দেখানো হচ্ছে। বোকা বাবা বনাম অঢেল আইসক্রিম খাওয়ার স্বাধীনতা—কোনটাকে বেছে নেবে জয়িতা!

সবাই জয়িতার বাবাকে বোকা বলে। আড়ালে হাসাহাসি করে বাবাকে নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়–জীবনে বাবা ছিল খুবই মেধাবী ছাত্র। শাহেদ আঙ্কেলের চেয়ে মেধাবী। চাইলেই ভালো একটা চাকরি জুটিয়ে নিতে পারত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাবা বেছে নিয়েছে কবিজীবন!

সে যখন একদম ছোট ছিল, দাঁত কেবল চারটা কি পাঁচটা, সকালে ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে নিয়ে ছুটে যেত বারান্দায়। আর বলত, ‘কাক কাক, বেরাশ কয়েচিশ?’

কিন্তু জয়িতা জানে, তার বাবা আর সবার মতো নয়। কবিরা স্বার্থপর হয় না। কবিরা নিজেদের ছাড়া আর সবাইকে নিয়ে ভাবে। পাখিদের নিয়ে, আকাশ নিয়ে, রোদ নিয়ে; রাস্তায় পড়ে থাকা নুড়িপাথর নিয়েও।

একবার বাবার হাত ধরে স্কুলে ফেরার সময় যেমন রাস্তায় পড়ে থাকা পাথরের টুকরোয় হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিল জয়িতা। বাবা ছুটে এসে ধরেছিল তাকে। জয়িতার পায়ে ব্যথা লেগেছিল, একটু ছুলেও গিয়েছিল হাঁটু। কিন্তু সে ব্যথা ভুলে গিয়েছিল, বাবা অনেক দিন পর তাকে এভাবে ছুটে এসে ধরে ফেলেছিল বলে। খুব ভালো লেগেছিল।

বাবা হদ্দমদ্দ করে ছুটে এল। ব্যাকুল স্বরে জানতে চাইল, ‘ব্যথা পেয়েছিস?’

জয়িতা মাথা নাড়াল, ‘না বাবা, পাইনি।’

বাবা বলল, ‘ধুর বোকা, আমি তোকে জিজ্ঞেস করেছি? আমি তো প্রশ্নটা করলাম পাথরকে। কী রে পাথর, ব্যথা পেয়েছিস?’

পাথরটাকে আঙুল দিয়ে আদর করে ছড়া কাটল, ‘ব্যথা পেয়েছ নুড়িপাথর! থুড়ি থুড়ি, অনেক আদর!’

তারপর জয়িতার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি তো জানতাম জয়ী, তুই ব্যথা পাবি না। এত অল্পতে তোর ব্যথা পেলে চলবে না। তোর নাম যে আমি রেখেছি জয়িতা!’

জয়িতার বুকেও বোধ হয় হুবহু বাবার হৃদয়টার একটা ছোট কপি বসানো আছে। সে যখন একদম ছোট ছিল, দাঁত কেবল চারটা কি পাঁচটা, সকালে ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে নিয়ে ছুটে যেত বারান্দায়। আর বলত, ‘কাক কাক, বেরাশ কয়েচিশ?’

সেই সময় সবার জন্যই মায়া হতো। এমনকি ফ্যানের জন্যও। তারা আরাম করে ঘুমাচ্ছে, আর ফ্যানটা সারা দিন ঘোরার পরও সারা রাত ঘুরে ঘুরে বাতাস দিচ্ছে।

বাবা একদিন জয়িতাকে একটা গল্প বলেছিল: এক দেশে ছিল এক রাজকন্যা। রাজকন্যার নাম তায়িজ।

তায়িজ কেমন নাম বাবা?

জাপানিজ রাজকন্যা তো, এই জন্য এমন নাম। জাপানিজদের নাম তাদের চেহারার মতো হয়। চ্যাপ্টা। এ কারণে রাজকন্যার নাম তায়িজ।

তায়িজের সবার জন্য খুব মায়া। সবচেয়ে বেশি মায়া ফ্যানের জন্য। তখন খুব গরম। সবাই ঘেমেটেমে শেষ। মাথার ওপর ফ্যানটা চেষ্টা করে যাচ্ছে সবার কষ্টটা দূর করে দিতে। ফ্যানটারও বয়স হয়েছে। মাঝেমধ্যে ঘরঘর শব্দ আসে ফ্যান থেকে।

একদম আমাদের ফ্যানটার মতো বাবা। দেখো না এটাও কেমন ঘরঘর শব্দ করে!

ঠিক ধরেছ। একদম আমাদের ফ্যানটার মতোই। সারা দিন ঘুরে ঘুরে ওর গলা শুকিয়ে যায়। ওরও তো গরম লাগে। কিন্তু ওকে বাতাস দেবে কে? তাই ওর জ্বর আসে।

যাহ বাবা, তুমি বোকা! ফ্যানের কি জ্বর হয়?

হয় তো। তোর বিশ্বাস হচ্ছে না? দাঁড়া, তোকে দেখাচ্ছি।

বলে বাবা ফ্যানটা বন্ধ করে দিয়েছিল। তারপর ফ্যানটা একদম থেমে গেলে জয়িতাকে ঘাড়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল খাটে। ফ্যানটা তখন ঘাড়ে বসা জয়িতার একদম খুব কাছে। বাবা বলল, আস্তে করে ফ্যানটা একটু ছুঁয়ে দাও।

জয়িতার ভয় লাগছিল। এমনিতেই ঘাড়ে উঠে শক্ত করে দুই হাতে বাবার চুল মুঠি করে ধরে রেখেছিল, যেন পড়ে না যায়।    

বাবা জয়িতার এক হাত ধরে আলতো করে ফ্যানের গোলাকার চাকতির মধ্যে ছুঁয়ে দিল। দ্রুতই সরিয়ে নিল। জয়িতার তাতেও বুঝতে কষ্ট হলো না, জ্বরে কেমন গা পুড়ে যাচ্ছে ফ্যানটার!

বাবার ঘাড় থেকে নেমে ছুটে গিয়ে প্যারাসিটামল নিয়ে এসে বলেছিল, ফ্যানটাকে খেতে দাও বাবা!

এটাই তো বড় সমস্যা রে মা। ফ্যানের জ্বর হলেও যে ওষুধ খাওয়ার উপায় নেই। বরং ওই অবস্থাতেও ওরা বাতাস দিয়েই যাবে, দিয়েই যাবে...

তায়িজেরও তোমার মতোই খারাপ লাগছিল ফ্যানের জন্য। একদিন মাঝরাতে ওর ঘুম ভেঙে গেল। একপাশে বাবা ঘুমাচ্ছে, আরেক পাশে মা। মাঝখানে রাজকন্যা তায়িজ। চোখ মেলতেই তার চোখ গেল ফ্যানটার দিকে। ঘরে মৃদু একটা আলো। তবু তায়িজের বুঝতে কষ্ট হলো না, ফ্যানটার দম ফুরিয়ে যাচ্ছে। আর পারছে না!

তায়িজ ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে বলল, ফ্যান ভাই, ফ্যান ভাই, তোমার এত কষ্ট!

হ্যাঁ খটশ খট খটশ খট আওয়াজ করে বুঝিয়ে দিল, হ্যাঁ, অনেক কষ্ট।

তায়িজ চুপি চুপি বিছানা থেকে নেমে দিল বন্ধ করে ফ্যানের সুইচ। একটু তো বিশ্রাম নিক ফ্যান ভাইটা। তারপর এসে হাসি হাসি মুখ করে ঘুমিয়ে পড়ল।

ওপর থেকে ফ্যান সবই দেখছে। দেখছে রাজকন্যার মমতা। দেখছে, কী করে এই গরমে ঘামছে রাজকন্যা।

সুইচ বন্ধ থাকলে কী হবে, ফ্যান তখন আপনা–আপনিই চলতে শুরু করল। তায়িজকে যে সে ঘামতে দিতে চায় না। কারণ সেই দিন থেকেই তায়িজের ফ্যান হয়ে গেল ফ্যান।

সেদিন থেকে জয়িতা বাবারও ফ্যান হয়ে গেছে। তার লেখক বাবাটার, কবি বাবাটার।

বাবার ফ্যানের গল্প মাথায় নিয়ে বড় হতে হতে জয়িতা বুঝেছে, তায়িজ আসলে আর কেউ নয়। সে নিজেই। জয়িতা শব্দটা উল্টো করে লিখলে যে তায়িজই হয়।

এই বাবাকে ছেড়ে কী করে থাকবে জয়িতা!

দুই

একটাই চিনির দানা। দুদিন থেকে কামড়ে ধরেছে দুটো পিঁপড়া। রান্নাঘরের দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে দুই পিঁপড়ার এই কাণ্ড দেখছে জয়িতা।

মা আজ বিশেষ রান্না করছে। খিচুড়ি আর মাংস ভুনার ঘ্রাণ ভেসে আসছে পাতিল থেকে। বৃষ্টির দিনে খিচুড়ির সঙ্গে মাংসের ভুনা! বাবার খুব প্রিয়।

‘মা, বাবা কোথায়?’

‘আমি কী জানি তোর বাবা কোথায়? গেছে হয়তো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে।’

‘বাবাকে ফোন দাও না, মা।’ জয়িতা চায় বাবাও, তাদের সঙ্গে দুপুরে খাক। একসঙ্গে একই টেবিলে বসে তিনজনের খাওয়া হয় না অনেক দিন।

মা কোনো জবাব দিল না। না–ও বলল না। এর মানে হলো, মা নিজে ফোন দিয়ে বাবার খোঁজ নেবে না। তবে জয়িতা চাইলে নিতে পারে।

স্কুলে সে নিজেদের গাড়িতে চেপে যাবে। আনিকা, মৌনিতারা যখন গাড়ি থেকে নামে, কী ভাব! জয়িতা ঠিক করে রেখেছিল, ওদের নিজের যখন গাড়ি হবে, কাউকে ভাব দেখাবে না

জয়িতা খাবার টেবিলের ওপরে রাখা মায়ের ফোনটা তুলে নিল। তার এখনো কেন জানি মনে হচ্ছে, বাবা সকাল সকাল বেরিয়ে গেছে জয়িতার জন্য কোনো গিফট আনতে। বাবা নিশ্চয়ই ভুলে যায়নি দিনটার কথা।

ফোনের রিং হলো। কেউ ধরল না। জয়িতা আবার ডায়াল করল। এবারও ফোন ধরল না বাবা। হয়তো মায়ের নম্বর দেখেই ধরছে না। জয়িতা মেসেজ লিখল: বাবা, আমার জন্মদিন আজ। তুমি কোথায়। তাড়াতাড়ি ফেরো। জয়ী।

সেন্ড করার আগে কী যেন মনে হলো। মেসেজটা পুরো মুছে দিল। তার আঙুল পর্দায় ইতস্তত ঘুরছে। জয়িতার মনে দ্বিধা কাজ করছে। লিখবে কি লিখবে না। তারপর দ্বিধা ছেড়ে আবার লিখল। এবার ছোট মেসেজ: বাবা, আমি, জয়ী।

এতটুকু দেখলেই তো বাবার ফোন ব্যাক করা উচিত। আর জন্মদিনের কথা সে মরে গেলেও বাবাকে মনে করিয়ে দেবে না।

ফোনটা আবার টেবিলের ওপর রেখে কিছুক্ষণ বসার ঘরে ঘুরঘুর করল। জয়িতাদের বসার আর খাওয়ার ঘর একটাই। একবার উঠে এসে জগ থেকে পানি ঢেলে খেল। পিপাসা পায়নি, তবু। জগটার পাশেই যে ফোনটা রাখা। বাবা যদি ফোন ব্যাক করে!

সময় গড়াচ্ছে। জয়িতা অকারণে দেয়ালঘড়িটার দিকে তাকাল। ঘড়িটার ব্যাটারি ফুরিয়ে গেছে অনেক দিন হলো। বদলানোই হয়নি। মোবাইলেই সময় দেখে নেওয়া যায় এখন। ব্যাটারি ছাড়া ঘড়ি কি কোনো কাজের? জয়িতা ঠিক করল, আজকেই ব্যাটারি বদলে ফেলবে। ঘড়িদের কত মজা। ব্যাটারি বদলে ফেললেই নতুন জীবন!

তাদের ক্লাসের শিখা মিস একদিন বলেছিল, ‘নষ্ট ঘড়িও কিন্তু দুইবার সঠিক সময় দেয়।’ কথাটা একটু কঠিন। জয়িতার বুঝতে বেশ সময় লেগেছে। নষ্ট, অচল ঘড়ি কী করে ঠিক সময় দেবে। পরে দুইবার সঠিক সময় দেয়, কথাটা সে বুঝতে পেরেছে।

জয়িতা উঠে এসে আবার স্ক্রিনে তাকাল। না, কোনো মিসকল জমে নেই। মোবাইলটা সাইলেন্ট করা নেই বুঝতে পেরেও একবার দেখে নিল রিংটোন চালু আছে কি না। একবার মেসেজ বক্সে গেল, এমনও তো হতে পারে মায়ের ফোনে ব্যালেন্স ছিল না। তাই মেসেজটা যায়নি। ওহ না, ব্যালেন্স না থাকলে তো কলই যেত না। জয়িতার আর শেষ কোনো আশা রইল না।

এরই মধ্যে সে গোসল সেরে নিয়েছে। মা বাথরুমের দরজা বন্ধ করে গুনগুন করে গাইছেন। রবীন্দ্রনাথের গান। কাঁদালে তুমি মোরে ভালোবাসারই ঘায়ে। শক্ত শক্ত কথা। জয়িতা বোঝে না। ঘায়ে মানে কী? আঘাত করা? ভালোবাসা দিয়ে কাউকে আঘাত করা যায়?

তখনই আবার বাবার কথা মনে পড়ল তার। এই যে সারা দিন সে বাবা বাবা করছে, অথচ বাবা ঠিকই ভুলে বসে আছে তাকে। একদমই ভুলে গেছে জয়িতার জন্মদিনের কথা!

এবার অসহ্য রাগ হলো তার।

খাবার টেবিলে বসে মা ভাত বাড়ল কেবল একটা প্লেটে। জয়িতার দিকে তাকাল। মা বোধ হয় খাইয়ে দিতে চায় তাকে। একসময় জয়িতা মায়ের অনেক বকুনি খেয়েছে। ক্লাস টুয়ে উঠেও মা খাইয়ে না দিলে খেতে পারত না। জয়িতার লজ্জা করছে, আবার ইচ্ছেও করছে, মা খাইয়ে দিক।

মায়ের কী যেন মনে হলো। জয়িতার দিকে ভরা প্লেটটা বাড়িয়ে দিয়ে নিজে বসে রইল শূন্য প্লেটে। আচ্ছা, মা–ও কি কারও জন্য অপেক্ষা করছে? বাবা হয়তো দুপুরে ফিরবে এই ক্ষীণ আশায়?

ভাবতে ভাবতেই দরজার বেল বেজে উঠল। বাবা! জয়িতা ততক্ষণে হাতে খিচুড়ি আর ঝোল মেখে ফেলেছে। তবু ওই হাতেই ছুটে দিয়ে খুলে দিল দরজা।

জয়িতার ঝলমলে মুখটা অন্ধকারে ডুবে গেল আবার। বাবা নয়, শাহেদ আঙ্কেল। হাতে রঙিন কাগজে মোড়ানো বিশাল বড় একটা প্যাকেট। কয়েকটা গ্যাসবেলুনও আছে। জয়িতাকে দেখে বললেন, ‘জয়ী ধর তো ধর। পড়ে যাচ্ছে, নিতে পারছি না।’

দরজা খুলে এমনিতেই জয়িতার মনটা খারাপ হয়ে গেছে। শাহেদ আঙ্কেলকে এখন সবচেয়ে বেশি বিরক্ত লাগছে। কিন্তু সব সময় বিরক্তি প্রকাশ করা যায় না। এটাই সমস্যা। অনেক সময় কাউকে বলতে ইচ্ছে করে, ‘আপনি যান তো, ভাগেন এখান থেকে।’ কিন্তু হাসি হাসি মুখ করতে হয়। এমন ভাব করতে হয়, যেন খুব আনন্দ হচ্ছে।

জয়িতা একবার মায়ের দিকে তাকাল। মা চোখের ইশারা করল। জয়িতা গিফটের বাক্সটা নিল। কিন্তু গ্যাসবেলুনটা ধরার চেষ্টা করল না। শাহেদ আঙ্কেলও বুঝতে পারেননি। জয়িতার দিকে গ্যাসবেলুনের সুতো বাড়িয়ে দিয়েই হাত ছেড়ে দিয়েছেন। ফলে নীল হাতির গ্যাসবেলুনটা হাওয়ায় ভেসে ছাদে গিয়ে ঠোক্কর খেল।

পাশেই জোরে ঘুরছিল ফ্যান। ফ্যানের পাখা ছিন্নভিন্ন করল নীল হাতিটাকে। জয়িতা এবার হেসে উঠল। তার কেন জানি মনে হলো, বাবার হয়ে ফ্যানটা প্রতিশোধ নিয়েছে।

শাহেদ আঙ্কেল বোকা বোকা ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। গ্যাসবেলুনের এই পরিণতি দেখে জয়িতা হাসছে কেন, সেটাও যেন তাঁর মাথায় ঢুকছে না। তিনি জয়িতাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, ‘দুঃখ করিস না। আজ বিকেলে আমরা যখন বেড়াতে যাব, তখন তোকে দুইটা নীল হাতি কিনে দেব। না, নীল হাতি না। একটা নীল হাতি, আরেকটা নীল হাঙর।’

জয়িতার আজ বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করছে খুব। কিন্তু তার মনের কল্পনায় তিনজনের বেড়ানোর যে ছবিটা আঁকা আছে, সেখানে বাবাকে ইরেজারে মুছে শাহেদ আঙ্কেলকে বসাতে হবে! ভাবতেই মনটা আরও দমে গেল।

‘তুমি বসো।’ মায়ের এই কথার জন্য শাহেদ আঙ্কেল যেন তৈরিই ছিলেন। খাবার টেবিলে রাখা বাটিতেই হাত ধুয়ে বসে পড়লেন। মা একটু অপ্রস্তুত। শাহেদ আঙ্কেল বসে পড়েছে জয়িতার চেয়ারে। মায়ের চোখের চাহনি দেখে শাহেদ আঙ্কেল হয়তো ভুলটা বুঝতে পারলেন। সামনে রাখা জয়িতার খিচুড়ির প্লেটটা চোখে পড়ল।

‘ওহ তুই এখানে বসেছিস নাকি জয়ী। স্যরি স্যরি, খেয়াল করিনি। আয় বোস।’ বলেও কিন্তু উঠে দাঁড়ালেন না। জয়ীর খাবারের প্লেটটা সরিয়ে দিলেন পাশের খালি চেয়ারটার সামনে। বাবা হলে কখনো এই কাজ করত না। বাবা জানে, এই বাসায় জয়ী যে চেয়ারে বসে খায়, শুধু সেই চেয়ারেই বসে খায়।

মা বুঝলেন। বললেন, ‘তুমি ওই চেয়ারটা ছেড়ে দাও। ওখানে জয়িতা বসে।’

শাহেদ আঙ্কেল উঠে দাঁড়ালেন। কিন্তু কোথায় বসবেন, বুঝতে পারছেন না। তিনটাই চেয়ার। বাবার চেয়ারটায় জয়িতা গিফটটা রেখেছে। আরেকটায় বসেছে তার মা। চট করে নিজের চেয়ারে বসে পড়ল জয়িতা। নিজের চেয়ারে সে শাহেদ আঙ্কেলকে বসতে দেবে না। বাবার চেয়ারেও না!

শাহেদ আঙ্কেল সহজ সমাধান বের করে ফেললেন। গিফটটা টিভি ট্রলির ওপরে রেখে এসে বসে পড়লেন জয়িতার বাবার চেয়ারে।

দ্রুত খাওয়া শেষ করে জয়িতা শোবার ঘরে ছুটে গেল। বালিশের একপাশটা ভিজিয়ে ফেলে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল, নিজেও জানে না।

মা কপালে হাত রাখতেই ঘুম ভেঙে গেল। মোবাইলের ঘড়িতে দেখল, ছয়টা বাজে। সকাল ছয়টা, নাকি সন্ধ্যা?

মা বললেন, ওঠো, ফ্রেশ হয়ে নাও। আমরা বেড়াতে যাব।

বেড়াতে যাওয়ার কথা শুনে আনন্দই হচ্ছিল জয়িতার। কিন্তু পরক্ষণেই বুঝে গেল, এই বেড়াতে যাওয়া ‘সেই’ বেড়াতে যাওয়া নয়। তবু সে তৈরি হয়ে নিল।

নিচতলার গ্যারেজে চকচকে কালো রঙের একটা গাড়ি। মা আর শাহেদ আঙ্কেল সামনে গিয়ে বসল। জয়িতা বসল পেছনে।

জয়িতা কত দিন কল্পনা করেছে, স্কুলে সে নিজেদের গাড়িতে চেপে যাবে। আনিকা, মৌনিতারা যখন গাড়ি থেকে নামে, কী ভাব! জয়িতা ঠিক করে রেখেছিল, ওদের নিজের যখন গাড়ি হবে, কাউকে ভাব দেখাবে না। বরং যাদের গাড়ি নেই, সেই বন্ধুদের গাড়িতে করে ঘোরাবে। সে কখনোই আনিকা-মৌনিতাদের মতো হবে না।

আজ গাড়িতে চড়েও তার ভালো লাগল না। এর চেয়ে রিকশা কত ভালো। তিনজন একসঙ্গে চড়লে বাবা সব সময় বলত, ‘ঢাকার রিকশাগুলোর একটা দিক আমার খুব ভালো লাগে। রিকশার সিটগুলো ভীষণ ছোট। তাই যতই চেষ্টা করো, দূরে সরে বসতে পারবে না!’

মা তখন কপট রাগ দেখাত। এ রকম বৃষ্টির দিন হলে তো রিকশার হুড তুলে দিতে হতো। টেনে ধরে রাখতে হতো সামনের পলিথিন। তখন রিকশাটাকে ছোট্ট একটা ঘরের মতো লাগত।

জয়িতা এবার খেপে গিয়ে বলল, ‘মিথ্যে কথা। আমার বাবা বেকার না। আমার বাবা কবি।’

আজ তারা গাড়ি করে যাচ্ছে। ঝিরঝিরে বৃষ্টি। গাড়ির কাচ ঝাপসা হয়ে আসছে। নাকি ঝাপসা হয়ে আসছে জয়িতার চোখই?

তারা ঘুরল, শপিং করল, রেস্টুরেন্টে খেল। জয়িতা পুরো সময় বেশ হাসিখুশিই থাকল। তার হাসিখুশি মুখ দেখে মায়ের মুখটাও উজ্জ্বল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মা এখন আর কপালে হাত রাখলেই বুঝতে পারে না, ভেতরে-ভেতরে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে জয়িতা।

বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত। তখনো দরজায় তালা ঝুলছে। বাবা এখনো ফেরেনি। জয়িতার জন্মদিনটা বাবা সত্যিই ভুলে গেছে!

বেশ হয়েছে। তুমি পচা বাবা। ফালতু বাবা। এমন বাবার আমার দরকার নেই।

তিন

আজ স্কুলে একটা কাণ্ড হয়ে গেছে।

মিস সবাইকে ইলাস্ট্রেশন বুক কিনে জমা দিতে বলেছিলেন। সবাই জমা দিয়েছে। কেবল জয়িতারটাই বাকি। জয়িতা বাবাকে বারবার তাগাদা দেয়। বাবা শুধু ভুলে যায়। মিস রাগ হন। সবাইকে সেখানে হোমওয়ার্ক দেওয়া হয়ে গেছে। এর ওপর ২৫ নম্বর। জয়িতা দেরি করলে তো ঝামেলা।

আজ মিস তাকে দাঁড় করিয়ে কী বকুনিটাই না দিলেন! জয়িতার বুক ভেঙে ঝরনার জলের মতো কান্না এসে জমতে থাকল চোখের কোণে।

এমন সময় পাশের সিট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আনিকা বলে বসল, ‘জয়িতা ইলাস্ট্রেশন বুকটা কিনতে পারবে না মিস। ওর বাবা গরিব।’

জয়িতা প্রতিবাদ করে উঠল, ‘আমার বাবা মোটেই গরিব না। ও মিথ্যা বলছে।’

মিথ্যেবাদীর অপবাদ আনিকাই বা মেনে নেবে কেন? সে আরও জোর গলায় বলল, ‘না মিস, আমি মিথ্যে বলছি না। ওর বাবা আসলেই গরিব। মাম্মাম বলছিল, ওর বাবা নাকি ভ্যাগাবন্ড। বেকার। কিচ্ছু করে না।’

জয়িতা এবার খেপে গিয়ে বলল, ‘মিথ্যে কথা। আমার বাবা বেকার না। আমার বাবা কবি।’

এই কথা শুনে পুরো ক্লাস হেসে দিল। মিসও নিজের হাসি আড়াল করতে পারলেন না। হাতে থাকা হোয়াইট বোর্ড মোছার ডাস্টারটা ডেস্কে ঠুকে বললেন, ‘কোয়ায়েট। ইউ আর মেকিং নয়েজ।’

সে হুঙ্কারে ক্লাসের হাসির কলরোল কিছুটা থামল বটে, কিন্তু জয়িতাকে সবাই বুঝিয়ে দিল, কবি হওয়ার চেয়ে বেকার-ভ্যাগাবন্ডই হওয়া ভালো। তার বাবা তো এলেবেলে টাইপ কবি, বিখ্যাত কেউ নন। স্কুলের বইয়েও পড়ানো হয় না তার বাবার কবিতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলে না হয় একটা কথা ছিল।

এমনিতেই বাবা কাল তার জন্মদিন ভুলে গেছে। রাতে তো বাসায় ফেরেইনি। এর মধ্যে আজ এই অপমান! জয়িতার সব রাগ গিয়ে পড়ল বাবার ওপর। লজ্জায়–অপমানে জয়িতা দাঁড়িয়েই থাকল অনেকক্ষণ। মিস বসতে বলার পরও বসল না। সামনের ডেস্কে পড়তে থাকল বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা। বৃষ্টি শুধু মেঘ থেকেই ঝরে, কে বলেছে!

ক্লাস ছুটির পর নিচে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আরও বেশি রাগের পাহাড় জমল। আজ

আসুক বাবা!

বাবা বাসায় থাকুক আর না থাকুক, জয়িতাকে স্কুল ছুটির পর নিতে আসবেই। কোনো দিন এর ব্যতিক্রম হয় না। ছুটির পর দেখা যাবে, গেটের ওপাশে হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে বাবা। আশপাশের লোকেরা যে বাঁকা চোখে দেখছে, সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। দলামচা শার্ট, আধছেঁড়া বুক পকেট, সেখানে আবার কলমের কালির দাগ লেগে আছে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। উষ্কখুষ্ক কাঁচাপাকা চুল।

সত্যি বলতে কি, এক কি দুই বছর আগে জয়িতা একটু একটু করে লজ্জা পেত, যখন এই শার্ট পরে বাবা তাকে নিতে আসত। বাকিদের বাবারা কেউ কেউ গাড়ি হাঁকিয়ে আসে। পরনে স্যুট, গলায় টাই। স্যুট-টাই না হলেও অন্য বাবারা পরিচ্ছন্ন ড্রেসই পরেন। সেই সব বাবাদের ভিড়ে নিজের বাবাটা কেমন মলিন!

প্রতিবার নতুন ক্লাসে উঠলেই নতুন বান্ধবীদের কেউ কেউ জিজ্ঞেস করে, ‘জয়ী, কে রে লোকটা?’ জয়িতা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। আর সে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে দেখে বান্ধবীরা আরও বেশি করে জানতে চায়।

আজ যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, জয়িতা সবার সামনে বলবে, এই লোকটা তার বাবা নয়। এই লোকটা তাদের বাসার কাজের লোক। তাকে নিয়ে আসা আর নিয়ে যাওয়ার জন্য রাখা হয়েছে।

বাবা তাতে কষ্ট পাবে? পাক না। তার কষ্ট পাওয়াই উচিত। কেমন বাবা, একটা ইলাস্ট্রেশন বুক কিনে দিতে পারে না! জন্মদিন ভুলে যায়!

তাদের ক্লাসে নিলয় বলে দুষ্টু একটা ছেলে আছে। আরও কজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় বলল, ‘ওই যে দ্যাখ, কবিরাজের মেয়ে। ওর বাবা কবিদের রাজা। কবিরাজ!’

জয়িতার ইচ্ছে হলো একটা হেস্তনেস্ত করে ফেলতে। এর বদলে বুকটা গুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। রাগ, হতাশা আর উদ্বেগ নিয়ে জয়িতা দাঁড়িয়েই থাকল।

সময় গড়াচ্ছে, কিন্তু কেউ নিতে আসছে না তাকে। এমন তো হয় না কোনো দিন? বাবা কি তবে জয়িতার প্রতি সব টানও ভুলে গেল? ভুলে গেল সব দায়িত্বের কথা?

এত এত মানুষের ভিড়ে সে নিজের বাবাকে খুঁজতে শুরু করল। চোখের দৃষ্টি ছটফট করে শুধু এদিকে তাকায় আর ওদিকে তাকায়। সব রাগ মুহূর্তেই বাষ্পের মতো উবে গেল। এর বদলে সেখানে জমা হতে থাকল ভয়! বাবাকে ছাড়াও সে একা বাসায় ফিরতে পারবে। এতটুকু সাহস জয়িতার হয়েছে। এই ভয় অন্য কিছুর। এই ভয় ফিরতি পথে হারিয়ে যাওয়ার নয়; বরং কিছু একটা হারিয়ে ফেলার! তবে কি বাবা...।

জয়িতার বুকটা কেমন চিনচিন করে উঠল। এবার সে কেঁদেই দেবে ভ্যাঁ করে।

হঠাৎ জয়িতার চোখে পড়ল, ভিড়ের মধ্যে তাকে দেখতে পেয়ে হাসি-হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছেন তার বাউন্ডুলে বাবা।

লোহার ভারী দরজার ফাঁক গলে একঝাঁক রোদ এসে ঘিরে ধরেছে বাবাকে। জয়িতা আবিষ্কার করল, বাকি বাবারা সবাই দেখতে একই রকম। আলাদা নয় খুব একটা। সেই একই রকম বাবাদের ভিড়ে তার ভীষণ রকমের এলোমেলো, দলামচা শার্ট, বুকপকেটে কালির দাগ, এলোমেলো চুল, খোঁচা খোঁচা দাড়ির কবি বাবাটাই বাকি সবার চেয়ে আলাদা।

ছুটে গিয়ে বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল জয়িতা!