ঝুলন্ত ব্যাচের অস্তিত্ব সংকট

আমি দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী, এসএসসি ২০২১ ব্যাচ। অনেকেই এই ব্যাচের নাম দিয়েছে ‘ঝুলন্ত ব্যাচ’। এই নামের পেছনের রহস্য সম্পর্কে আমি সেভাবে অবগত না হলেও আমরা যে ঝুলে আছি, এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দুই বছর থেকে দশম শ্রেণির সীমানাই পেরোতে পারলাম না!

দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর পর ১২ সেপ্টেম্বর দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেছে। স্কুলে গিয়ে ভুগলাম অস্তিত্ব সংকটে। আমাদের স্কুলে সাধারণত ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ১৩টি কক্ষ আছে। আর কারিগরি শাখা, স্কাউট, বিএনসিসি, ল্যাবরেটরিসহ আছে কিছু অব্যবহৃত কক্ষ। আমাদের মূল সংকট এই কক্ষ নিয়েই। সেটাও আমাদের স্কুলেরই ছোট ভাইবোনদের সঙ্গে। একদিকে আমরা পুরোনো দশম শ্রেণি (এসএসসি ২০২১) আর অন্যদিকে নতুন দশম শ্রেণি যাদের আমরা সচরাচর আদর করে ‘নিউ টেন’ বলে ডাকি (এসএসসি ২০২২)। কারণ, দশম শ্রেণির জন্য নির্দিষ্ট নির্ধারিত কক্ষ রয়েছে। কিন্তু আমরা আর ওরা এই দুই দশম শ্রেণির গুণধর শিক্ষার্থীরা তো সবাই ‘দশম শ্রেণি’তেই পড়ি। তাহলে প্রশ্ন হলো, দশম শ্রেণির জন্য নির্ধারিত কক্ষে বসবে কোন ব্যাচ? এসএসসি ২০২১ নাকি এসএসসি ২০২২? অবশ্য এরও খুব সুন্দর একটা সমাধান হয়েছে। কারণ, সপ্তাহে প্রতিদিন আমরা দুই দশম শ্রেণি ক্লাস করব, কিন্তু বাকিরা সপ্তাহে এক দিন করে করবে। তাই শেষমেশ কক্ষের অভাব হলো না । কিন্তু দশম শ্রেণির কক্ষ না আমরা ছাড়ব, না ওরা!

এই সমস্যার একটি মজার সমাধানও হয়েছে ক্লাস শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ আগে। একদম প্রথম দিকে দশম শ্রেণির ছাত্ররা যখন ক্লাসরুমে ঢুকবেন, তখন আমরা বললাম, ‘ভাইয়া, এটা তো আমাদের জন্য। তোমাদের জন্য ওই যে ওই রুমটা দেখছ, ওটায় ব্যবস্থা করা হয়েছে।’

আদতে এমন কোনো নির্দেশনা ছিল না যে ‘নিউ টেন’ ওই কক্ষটায় ক্লাস করবে। অবশ্য ওই কক্ষটা এখনো অবহেলিত। কারও ক্লাসই হয় না সেখানে। তাই আমরা এখন বসি দশম শ্রেণির কক্ষে, আর খুবই অপ্রিয় সত্য মেনে নিয়ে, গাল মুখ ফুলিয়ে আমাদের সেই নিউ টেনের ভাইবোনেরা বসে নবম শ্রেণির কক্ষে।

এখনো প্রায়ই মজা করে বলি, ‘পড়ো ক্লাস টেনে। অথচ ক্লাস নাইনের মায়া এখনো কাটাতেই পারলা না তোমরা।’

ক্লাসরুম আর অস্তিত্ব বাঁচিয়ে বিজয়ীর বেশে দশম শ্রেণির সেই শ্রেণিকক্ষে বসার পর ঘটল আরেক মজার বিপত্তি। আমরা অনেকেই আমাদের ক্লাস রোল কত ছিল, তা ভুলে গিয়েছিলাম। স্যার আসার আগেই কে কার পেছনে, কে কার সামনে—এসব নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ আর প্রচুর গবেষণা করে আমরা আমাদের রোল নম্বরগুলো উদ্ধার করেছি। বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। বলতে গেলে এসব গবেষণায় আবার আমরা খুবই দক্ষ! তারপর প্রথম ক্লাসে রোল অনুযায়ী নাম প্রেজেন্ট করল সবাই।

সেদিন শুধু দুটি ক্লাস হয়েছে আমাদের। যাব কি যাব না—এ নিয়ে যখন বাড়িতে বসে দোটানায় ছিলাম, তখন ছোট বোনের আবদার, আমি না গেলে সে–ও যাবে না স্কুলে। অগত্যা চলে গেলাম স্কুলে। আবার ১২ সেপ্টেম্বর আমার এক বান্ধবীর জন্মদিনও ছিল। তবে জন্মদিন যারই হোক, কেকের ক্রিমটা সব সময় আমার মুখেই যে সবচেয়ে বেশি লাগে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। একজন দেখলাম ফোনের ফ্রন্ট ক্যামেরা দেখে দেখে টিস্যু দিয়ে নিজের চাঁদবদনের ক্রিম পরিষ্কার করছে। এত সহজ! কিছু ক্রিম নিয়ে আবার মাখিয়ে দিলাম তার মুখে। সব মিলিয়ে দারুণ কেটে গেল দিনটা।

লেখক: দশম শ্রেণি, পীরগাছা জে এন সরকারি মডেল উচ্চবিদ্যালয়, রংপুর