টমাস আলভা এডিসন

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইতিহাসে টমাস আলভা এডিসন খুব গুরুত্বপূর্ণ এক বিজ্ঞানী। তাঁর আবিষ্কৃত ডিরেক্ট কারেন্টের (ডিসি) কথা আমরা সবাই জানি। শুধু বিদ্যুৎই নয়, বাতিও তাঁরই আবিষ্কার। এক যুক্তরাষ্ট্রেই তাঁর নামে সহস্রাধিক পেটেন্ট, মানে আবিষ্কার-স্বত্ব আছে।

এডিসনের মা–বাবার নাম, জন্ম সাল ইত্যাদি আমরা এক জীবনে নিতান্ত কম পড়িনি। কিন্তু এগুলোর কোনোটাই আমাদের মনে থাকে না। তার দরকারও নেই। বড়জোর বিসিএসের জন্য লাগলেও লাগতে পারে। তবে বিসিএসে এডিসনের বাবার নাম কখনো এসেছে বলে আমি শুনিনি!

তবু এডিসনের কথা বলতে গেলে তাঁর মা–বাবার নাম একবার হলেও বলতে হবে। যতটা না জানার জন্য, তার চেয়ে বেশি তাঁদের প্রাপ্য সম্মান দেওয়ার জন্য। হ্যাঁ, এডিসনের বাবার নামও এডিসনই ছিল! স্যামুয়েল অগডেন এডিসন। আর তাঁর মায়ের নাম, ন্যান্সি এলিয়ট।

তাঁর একদম ছোটবেলায় পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব একটা খারাপ ছিল না। খানিকটা সে জন্যই, ইচ্ছেমতো দুষ্টুমি করার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। আসলে, বড়রা দুষ্টুমি বললেও ছোটদের জন্য এগুলো হলো জীবন-মরণের কেস!

যেমন, মুরগির ডিমের কথাই ধরা যাক। এডিসন খেয়াল করে দেখেছিলেন, মুরগি ডিম পাড়ার পর সেটার ওপরে বসে থাকে। তা দেয়। তিনি ভাবলেন, মুরগি পারলে আমি কেন পারব না! যেই ভাবা, সেই কাজ। ঘরের কোণে খড়টড় দিয়ে এর ওপরে ডিম রেখে বসে পড়লেন তা দিতে! এরপরে কী হয়েছে, সেটা ভাসা–ভাসাভাবে শোনা যায়। তবে কানমলা একটা নিশ্চয় খেয়েছিলেন। ছেলের ডিম ফোটানোর চেষ্টা কোনো মা–বাবারই অত সহজে মেনে নেওয়ার কথা নয়।

কিন্তু এডিসন সেখানে থামেননি। চালিয়ে গেছেন এসব ‘গুরুত্বপূর্ণ’ গবেষণা। এখানে আরেকটা ব্যাপারও আছে অবশ্য। স্কুলে এক শিক্ষককে একবার পেছন থেকে ‘বোকা’ বলেছিলেন তিনি। ফলে তিন মাসেই তাঁর স্কুলজীবন শেষ হয়ে গিয়েছিল। (তোমরা কেউ এখন আবার স্কুলের শিক্ষককে বোকা বলতে যেয়ো না যেন!) বাকি সব পড়াশোনা ও দুষ্টুমি তিনি বাসায় বসেই করেছেন, একেবারে নিজ উদ্যোগে! আর পড়াশোনার দিকটা সামলেছেন তাঁর মা।

এখন পড়াশোনার পাশাপাশি ‘গুরুত্বপূর্ণ’ গবেষণার জন্য দরকার গবেষণাগার। এডিসন সেদিকে মন দিলেন। টুকটাক যন্ত্রপাতি কিনে ফেললেন নিজে নিজেই। কিন্তু এ সময় তাঁর পরিবারে কিছুটা অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। কিন্তু গবেষণা তো আর এভাবে ফেলে রাখা যায় না। এডিসন ভাবেন। ভেবে ভেবে তাঁর মনে হয়, উঁহু! এভাবে ছেড়ে দিলে চলবে না। নিজেকেই যা করার, একটা কিছু করতে হবে।

বাবা-মাকে বললেন সে কথা। তাঁর বয়স তখন তেরো। এই বাচ্চা আবার কাজ কী করবে! মা–বাবা রাজি হলেন না। কিন্তু ছেলের জেদের সঙ্গে কী আর পারা যায়? শেষমেশ এডিসন খবরের কাগজ ফেরি করার কাজ জুটিয়ে ফেললেন। বুদ্ধিমান এডিসন ভাবলেন, কান টানলে মাথা আসে—এটা একটা প্রতিষ্ঠিত সত্য। তাই কাগজের সঙ্গে সঙ্গে বাদাম, চকলেট ইত্যাদিও রাখতে শুরু করলেন তিনি। যে কাগজ কিনবে, দুটো বাদামও কিনে নেবে সঙ্গে! আর বাদাম দেখলে কার না খেতে ইচ্ছে করবে?

সব মিলিয়ে টুকিটাকি ভালোই আয় হলো। এ সময় জানতে পারলেন, পুরোনো ছাপার যন্ত্র বিক্রি হবে কম দামে। ভাবলেন, হাতে যেহেতু কিছু টাকা আছে, কিনেই ফেলা যাক যন্ত্রটা! কিন্তু কিনে কী করবেন? কেন, পত্রিকা বের করবেন! স্থানীয় পত্রিকার জন্য সংবাদ সংগ্রহ করাটা তাঁর জন্য কঠিন কিছু নয়। আরও কিছু কাজ অবশ্য আছে। সম্পাদনা করা, ছাপা, বিক্রি করা ইত্যাদি। কিন্তু যে ছেলে ছাপানোর যন্ত্র কিনে ফেলেছে, বড় হয়ে যে কিনা ইতিহাসের সবচেয়ে বড় উদ্যোক্তাদের একজন হয়ে উঠবে; এসব কি আর তাকে আটকাতে পারবে?

ছেলেবেলায় এডিসন

সত্যি সত্যি পত্রিকা বের করে ফেললেন এডিসন। বিক্রিও হতে লাগল মোটামুটি। টাকাও মন্দ জমল না। তবে পরিমাণটা যে খুব বেশি না, সেটা তো বোঝাই যায়। মাত্র পনেরো বছর বয়সে রাতারাতি পত্রিকার মালিক হয়ে যাওয়া ছেলেটার মাথায় তখন আরেক জিনিস ঘুরছে। যেভাবেই হোক, টেলিগ্রাফ শিখতে হবে।

কথায় আছে, কেউ যখন মন থেকে খুব করে কিছু চায়, পুরো পৃথিবী তাকে সেটা পাইয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগে। এডিসনের সামনেও সুযোগ এসে গেল।

একদিন কাগজ নিয়ে রেললাইন দিয়ে যাচ্ছেন। দেখলেন, এক পিচ্চি লাইনের মধ্যেই খেলছে। ওদিকে দূর থেকে আসছে ট্রেন। পিচ্চির সেদিকে খেয়ালই নেই। কাগজপত্র সব ফেলে দিয়ে ছুট দিলেন। সরিয়ে আনলেন সেই পিচ্চিকে। দেখা গেল, সেই পিচ্চি স্টেশনমাস্টারের সন্তান! খুশি হয়ে ভদ্রলোক বললেন, বলো, তোমার জন্য কী করতে পারি? এডিসন তখন তাঁকে টেলিগ্রাফ শেখার ইচ্ছার কথা জানান। এভাবেই কয়েক মাসের মধ্যেই টেলিগ্রাফ শেখা হয়ে গেল তাঁর। সেই সঙ্গে সাংকেতিক লিপিও শিখে ফেললেন। এই সংকেত ও মোর্স কোড নিয়ে একটা বেশ মজার ঘটনা আছে।

১৮৮৫ সাল। এডিসনের প্রথম স্ত্রী মারা গেছেন। মিনা মিলার নামের এক তরুণীর সঙ্গে পরিচয় হয় এডিসনের। এডিসন তাঁকে মোর্স কোড শেখালেন। এভাবেই তাঁদের প্রেম হয়ে গেল। দেখা যেত, আশপাশে মানুষ থাকলেও তাঁরা গোপনে ঠিকই নিজেদের কথা চালিয়ে যাচ্ছেন। একদিন এডিসন সবার সামনেই মিনার হাতে ট্যাপ করে, মোর্স কোডের মাধ্যমে একটা কথা বললেন। উত্তরে মিনাও ট্যাপ করেই জবাব দিলেন।

এডিসন তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমাকে বিয়ে করবে?

মিনা জবাব দিয়েছিলেন, হ্যাঁ!

১৮৮৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তাঁদের বিয়ে হয়। পরে তাঁদের তিন সন্তানও হয়েছিল।

এডিসনের ঘটনাবহুল জীবনী নিয়ে বলতে গেলে আসলে বলে শেষ করা যাবে না। তাই তাঁর উদ্যোগ ও বিদ্যুতের ব্যাপারে ছোট্ট করে বলি। ১৮৬৯ সালে ভোল্ট পরিমাপের একটা যন্ত্র বানান তিনি। এটা অবশ্য বর্তমানের ভোল্টমিটার নয়। তবে সেটার পেটেন্ট নিয়েছিলেন এডিসন। এই পেটেন্ট তাঁর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। যে টাকা পেয়েছিলেন, সেটা নিয়ে পাড়ি জমালেন নিউইয়র্কে। কিন্তু অল্প কয়েক দিনেই সেসব টাকা শেষ হয়ে গেল। এ সময় তাঁর পরিচয় হয় এক টেলিগ্রাফ অপারেটরের সঙ্গে। সেই অপারেটর তাঁকে এক ডলার ধার দেন। সেই সঙ্গে গোল্ড ইন্ডিকেটর কোম্পানির ব্যাটারি ঘরে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। সেখানে থাকাবস্থায় তৃতীয় দিন এডিসন দেখলেন, ট্রান্সমিটারের বেহাল দশা। ম্যানেজারের অনুমতি নিয়ে ঠিক করে দিলেন সেটা। সেদিনই ওই কোম্পানির কারখানায় ফোরম্যান হিসেবে চাকরি পেয়ে যান তিনি। বেতন ৩০০ ডলার!

সে আমলে ৩০০ ডলার অনেক টাকা। তার ওপরে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ম্যানেজার হয়ে গেলেন। বেতন আরও বেড়ে গেল। এর কিছুদিন পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর একটা করলেন তিনি। গোল্ড ইন্ডিকেটর কোম্পানি একধরনের যন্ত্র বানাত। এই যন্ত্রের ফিতায় লেখা হতো টেলিগ্রাফের খবর। এডিসন নতুন এক যন্ত্র বানালেন। যেটা আগের চেয়ে অনেক উন্নত, কিন্তু এটা বানাতে খরচ পড়বে অনেক কম। কোম্পানির মালিকের কাছে নিয়ে গেলেন সেই যন্ত্র। ভদ্রলোক সেই যন্ত্র দেখে বললেন, কত দামে বিক্রি করতে চান এটা? এডিসন ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। কিন্তু চার-পাঁচ হাজারের মতো ভাবছিলেন। তাঁকে অবাক করে দিয়ে ৪০ হাজার ডলার ধরিয়ে দিলেন ভদ্রলোক!

এত দিনে এডিসন পুরোপুরি স্বাধীন হয়ে গেলেন। কাজ শুরু করলেন পুরোদমে। নিত্যনতুন আবিষ্কার করেন আর পেটেন্ট করে নেন। সেগুলোর কিছু বিক্রি করে আয় করেন মোটা অঙ্কের টাকা।

১৮৭৬ সালে নতুন এক কারখানা বানান তিনি মেনলো পার্কে। তত দিনে টেলিফোন আবিষ্কার হয়ে গেছে৷ কিন্তু যন্ত্রটা অতটা উন্নত ছিল না। কথা ভালোভাবে শোনাও যেত না। এ সময় এডিসন কার্বন ট্রান্সমিটার উদ্ভাবন করলেন। ফলে টেলিফোনে কথাবার্তা ও যোগাযোগ খুব সহজ হয়ে গেল। রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন এডিসন।

এবার তিনি মনোযোগ দিলেন বিদ্যুতের দিকে। বানালেন কার্বন ফিলামেন্ট। নিউইয়র্কে প্রথম বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্রও গড়ে তুলেছিলেন তিনি।

এডিসনকে নিয়ে একটা বিখ্যাত গল্প আছে। তাঁর বানানো প্রথম সফল বাল্বটি এক কাজের লোককে দিয়ে একবার বলেছিলেন, রেখে আসতে। লোকটা সেটা ভেঙে ফেলে। কিন্তু এডিসন তাকে কিছু বলেননি। খেটেখুটে আরেকটা বাল্ব বানালেন। সফলভাবে সেটা জ্বালিয়ে দেখার পরে সেই লোককেই আবার ডাকলেন বাল্ব রেখে আসতে। লোকটা তখন ভয় পাচ্ছিল। উপস্থিত অন্যরাও বলছে, করছেন কী আপনি! আবার ভেঙে ফেলবে তো! এডিসন বললেন, বাল্ব ভাঙলে আমি বানাতে পারব। কিন্তু আজ ওকে এই কাজ না করতে বললে ওর আত্মবিশ্বাসটা যে আর কখনো জোড়া লাগবে না!

এডিসনকে নিয়ে এ রকম চমৎকার সব গল্প আছে। কিন্তু তিনিও মানুষ ছিলেন। তাই মুদ্রার উল্টো পিঠে তাকালে দেখা যায়, তাঁর ব্যাপারে অভিযোগও আছে অনেক। যেমন, পেটেন্টের ব্যাপারটাই ধরা যাক। এডিসনের আগেও অনেক দারুণ আবিষ্কার হয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা তখনো পেটেন্ট করে সব কুক্ষিগত করে রাখতেন না। এখন যেমন, ইলন মাস্ক কিছু পেটেন্ট ছাড়া বেশির ভাগই উন্মুক্ত করে দিয়েছেন, সে রকম। কিন্তু এডিসন ছিলেন অন্য রকম। কিছুই ছাড়তে চাইতেন না তিনি।

গবেষণায় মগ্ন এডিসন

তাঁর কোম্পানিতেই কাজ করতেন নিকোলা টেসলা। টেসলা অভিযোগ করে বলেছিলেন, এডিসন নাকি তাঁকে ঠিকভাবে প্রাপ্য টাকাপয়সাটুকুও দিতে চাইতেন না। তাই খুব খেপেছিলেন টেসলা। এর মধ্যে তিনি আবিষ্কার করেছিলেন এসি কারেন্ট। এডিসনের ডিসি ও টেসলার এসি কারেন্ট নিয়ে রাতারাতি যুদ্ধ লেগে গিয়েছিল। এটা ‘কারেন্ট ওয়ার’ নামে খ্যাত। টেসলার নিজের কোম্পানি ছিল না। ওয়েস্টিংহাউস ইলেকট্রিক কোম্পানির সাহায্য নিয়েছিলেন তিনি।

এসি কারেন্ট অনেক কম খরচে বহুদূরে সরবরাহ করা যায়। তা ছাড়া এটি তুলনামূলকভাবে অনেক নিরাপদ। কারণ, সার্কিট পূর্ণ না হলে, বৈদ্যুতিক তারে হাত লেগে গেলেও সমস্যা হয় না। যেমন রাবারের জুতো পায়ে থাকলে। মানুষের শরীর বিদ্যুৎ পরিবাহী হলেও রাবার বিদ্যুৎ পরিবাহী নয়। সে জন্য জুতো পায়ে তারে হাত লেগে গেলেও সমস্যা হয় না।

সব মিলিয়ে কারেন্ট ওয়ারে শেষ পর্যন্ত হেরে গিয়েছিলেন এডিসন। ঘরে ঘরে জায়গা করে নিয়েছিল এসি কারেন্ট। তবে ব্যাটারিতে এখনো সেই ডিসি কারেন্টই ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ ব্যাটারিচালিত যত কিছু আমরা চালাই, এডিসনের সেই আবিষ্কারই ব্যবহার করি।

নন্দিত যেমন হয়েছেন, তেমনি নিন্দাও কম পাননি এডিসন। কিন্তু আজকের শিল্পবিপ্লবনির্ভর পৃথিবীর পেছনে তাঁর অবদানকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না।