ডাইনি বুড়ির ভ্যাকুয়াম ক্লিনার

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

মিস্টার রোনাল্ড সুইম্বল, মানে আমাদের রণ আঙ্কেল জন্মদিন বেশ পছন্দ করেন। কারণ, জন্মদিনের অনুষ্ঠান মানেই পার্টি আর হইচই। পার্টটাইমে তিনি ম্যাজিক দেখান। তাই কোথাও পার্টি হলেই সেখানে ডাক পড়ে তার।

তিনি স্রেফ শূন্য থেকে ডিম আনতে পারেন, মানুষের কানের ভেতর থেকে টেনে বের করতে পারেন বিভিন্ন দেশের পতাকা, তাসের ৫০টা বিভিন্ন ধরনের খেলাও পারেন। আসলেই খুব ভালো ম্যাজিক দেখাতে পারেন আঙ্কেল রণ। আয়নার সামনে কঠোরভাবে চর্চা করে সেসব শিখতেন। ব্ল্যাকবেরি ম্যাজিক চতুর্ভুজের (সার্কেল নয়) প্রেসিডেন্টও তিনি।

আঙ্কেল রণর একটা তোতা পাখি ছিল। ওর নাম মিমস। সে হ্যাট থেকে কার্ড তুলতে পারে আর জোরে জোরে চিৎকার করতে পছন্দ করে।

তার মেয়ের নাম লুসি। স্টেজে দাঁড়িয়ে লুসি সাধারণত তেমন কিছু বলে না। তবে আঙ্কেল রণর আলখেল্লা ধরে থাকে সে। আবার একটা খাঁচার ভেতর রাখা মিমসকে তার হাতে তুলে দেয়। এ রকম আরও বেশ কিছু কাজ করে লুসি।

এভাবে বেশ সুখে–শান্তিতেই ছিল এই তিনজন। কিন্তু টাউন হলে জিমি ওয়াডলের দশম জন্মদিনের রাতে সবকিছু কীভাবে যেন বদলে গেল।

সেদিন আঙ্কেল রণ হেঁটে মঞ্চে উঠে এলেন। খুশিতে সব ছেলেমেয়ে ষাঁড়ের মতো চেঁচিয়ে বলতে লাগল, ‘হ্যালো, আঙ্কেল রণ।’

মঞ্চে উঠতে না উঠতেই হুট করে আঙ্কেল রণর মাথা থেকে হ্যাটটা খুলে নিচে পড়ে গেল। অমনি কথা নেই বার্তা নেই সেখান থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এল তিনটা জলজ্যান্ত খরগোশ।

হ্যাটটা তোলার জন্য একটু নিচে ঝুঁকলেন আঙ্কেল রণ। অমনি চোখের পলকে একঝাঁক কবুতর তার জ্যাকেট ভেদ করে বেরিয়ে এল। একটা লকলকে ড্যাফোডিল ফুলও গজাল তার কান থেকে। ওদিকে ভীষণ জোরে পাক খেতে লাগল তার গলায় বাঁধা বো টাই। সব কটি ম্যাজিকই খুব মজার ছিল। বিস্ময়ে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল ছোট্ট জিমি ওয়াডলের। কিন্তু এসব ঘটনায় সেদিন টাউন হলে সবচেয়ে বেশি তাজ্জব হয়েছিলেন যে লোকটি, তিনি হলেন খোদ আঙ্কেল রণ। এগুলোর কোনোটাই আসলে তার ম্যাজিক ট্রিক ছিল না। কারণ জানো বোধ হয়, খরগোশে তার ভীষণ অ্যালার্জি।

এত সব কাণ্ডের পরও তিনি ম্যাজিক দেখিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে গেলেন। কিন্তু একে একে সব কটিই অকেজো হয়ে গেল। বেশ কিছু ম্যাজিকের কৌশল দেখালেন তিনি। যেমন একটা টপ হ্যাটকে একটা ফুলদানিতে রূপান্তরিত করা কিংবা একটা টেবিলকে অদৃশ্য করে দেওয়া। কিন্তু সেগুলো তিনি করতে চাননি। তিনি হাত নাড়লেই ভোজবাজির মতো কিছু না কিছু সামনে হাজির হচ্ছিল, নয়তো কিছু একটা অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল সেখান থেকে। তার তাসের প্যাকেটটা ধরতে গিয়ে তিনি প্রায় কেঁদেই ফেললেন। আর প্যাকেটটা যখন একটা ওয়াইনের গ্লাসে পরিণত হলো, তখন মঞ্চ থেকে দৌড়ে নেমে এলেন তিনি।

‘ম্যাজিকগুলো তো একদম নতুন দেখছি...,’ অবাক কণ্ঠে লুসি বলতে যাচ্ছিল।

‘ওগুলো আমার না রে! কী সব কাণ্ড হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি না! আমি তো আজ সঙ্গে কোনো কবুতরও আনিনি!’

‘কেক!’ চিৎকার করে উঠল তোতা পাখি মিমস।

বিস্মিত দর্শকেরা তখনো খুশিতে তুমুল তালি দিচ্ছিল। আর কোনো কথা বলার আগেই মঞ্চে ফিরে যেতে হলো মিস্টার রোনাল্ডকে। তারপর সবার উদ্দেশে পরপর দুবার বো করতে হলো। সবাই তার সঙ্গে হাত মেলাচ্ছিল আর জিজ্ঞেস করছিল, এই ম্যাজিকগুলো কীভাবে দেখাতে পারলেন তিনি।

ভিড় ঠেলে একসময় নিজের ড্রেসিংরুমে পৌঁছাতে পারলেন তিনি। ঘরে ঢুকেই দরজা লক করে দিলেন।

‘আমি বুঝতে পারছি না, এসব কাণ্ডকারখানা কীভাবে ঘটল,’ তিনি বললেন। ‘কিন্তু মনে হচ্ছে, যেকোনো কিছুর দিকে আমার আঙুল তাক করলেই সবকিছু হয়ে যাচ্ছে। যেমন ধরা যাক, ওই কাপবোর্ডকে বললাম একটা হ্যাটস্ট্যান্ড হয়ে যাও তো, আর...’

সেটা সঙ্গে সঙ্গে একটা হ্যাটস্ট্যান্ডে পরিণত হয়ে গেল।

‘জ্যাম!’ চিৎকার করে উঠল মিমস।

মিস্টার রোনাল্ড তার নিজের হ্যাটের দিকে আঙুল তাক করলেন।

‘উধাও হয়ে যাও।’ খসখসে কণ্ঠে বললেন তিনি। ভোজবাজির মতো সঙ্গে সঙ্গে তা-ই ঘটল।

সেদিন তারা ট্যাক্সিতে চড়ে বাসায় ফিরলেন। বাসায় যেতে যেতে রাস্তার দুই পাশের ফুটপাতের নানান জিনিসের দিকে হাতের আঙুল তাক করলেন আঙ্কেল রণ। তিনি আসলে পরীক্ষা করে দেখতে চাইছিলেন, তার ওই জাদুর ক্ষমতা তখন বহাল আছে কি না। তা করতে গিয়ে তিনটা ল্যাম্পপোস্ট একে একে একটা সারস পাখি, চাকার ওপর একটা হাতি আর শিশুর গাড়ির বগিতে পরিণত হলো।

আরও বিপত্তি ঘটল ট্যাক্সি ড্রাইভারকে ভাড়া দিতে গিয়ে। আঙ্কেল রণ একটা জিনিসকে আরেকটা জিনিসে রূপান্তরিত করতে পারছেন ঠিকই, কিন্তু কোনো বস্তুর আসন্ন ভাগ্য কী হতে পারে, তাতে কোনো নিয়ন্ত্রণ তার হাতে ছিল না। আবার কোন জিনিস রূপান্তরিত হয়ে ঠিক কিসে পরিণত হবে, তা–ও জানতেন না তিনি। তাই নিজের পকেট থেকে মানিব্যাগটা টেনে বের করতে না করতেই সেটা হুট করে একটা চিজ স্যান্ডউইচ হয়ে গেল।

‘ওগুলো আমার না রে! কী সব কাণ্ড হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি না! আমি তো আজ সঙ্গে কোনো কবুতরও আনিনি!’

শেষ পর্যন্ত নিজের লাঞ্চের টাকা থেকেই ভাড়া মেটাতে হলো লুসিকে। ভাড়া পেয়েই কোনো কথা না বলে ট্যাক্সির ড্রাইভার ভোঁ করে একটানে সেখান থেকে চলে গেল।

‘দরজার চাবি আমার কোমরের পকেটে,’ দাঁতে দাঁত চেপে বললেন আঙ্কেল রণ। ‘মনে হয় আমার হাতে কোনো কিছু না ছোঁয়াই ভালো। তার চেয়ে তুমি দরজা খোলো। নইলে সেটা অজানা–অকথ্য কিছু হয়ে যেতে পারে।’

‘গ্লাভস!’ লুসি বলল। ‘ব্যস, এটাই আসল সমাধান! এক্ষুনি দুই হাতে পরে নাও। তাহলে তোমাকে আর কোনো কিছু ছুঁতে হবে না, বাবা।’

‘আমার কাছে নেই,’ করুণ সুরে বললেন আঙ্কেল রণ। ‘কিন্তু ওগুলো ধরলে যদি আবার হুট করে অন্য কিছু হয়ে যায়।’

লুসির কাছে এক জোড়া লাল উলের হাতমোজা ছিল। তার পেছনে বিশ্রি রঙে খরগোশের একখান ছবি এমব্রয়ডারি করা। আঙ্কেল রণ সেগুলো স্পর্শ করতেই এক জোড়া পায়ের মোজায় পরিণত হলো।

চট করে লুসির মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। এক দৌড়ে তার বাবার এক জোড়া মোজা নিয়ে এল সে। আঙ্কেল রণ সেগুলো হাতে পরতে না পরতেই তা লাল উলের হাতমোজায় পরিণত হয়ে গেল।

ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন রণ। এরপর টেলিফোনটা হাতে তুলে নিলেন। ব্ল্যাকবেরি ম্যাজিক চতুর্ভুজের সহকর্মীদের তক্ষুনি তার কাছে আসতে বললেন তিনি। শিগগিরই তার ছোট্ট বাড়িটা লোকজনে গিজগিজ করতে লাগল।

‘এই যে দেখো,’ তাদের বললেন আঙ্কেল রণ। হাতমোজা খুলে ঘরের এক কোণে রাখা ছোট্ট ক্যাকটাসের পটটার দিকে আঙুল তাক করলেন তিনি। পটটা মুহূর্তেই একটা মারবেলের বাটিতে পরিণত হলো! সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। ব্যতিক্রম ছিলেন কেবল তাদের মধ্যে থাকা এক মেয়ে। তিনি তখন জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিলেন। রাস্তা দিয়ে শিশুদের একটা গাড়ির বগিতে বসে একটা সারস ছোট্ট চাকা লাগানো একটা হাতিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। সেই দৃশ্যই গভীর মনোযোগে দেখছিলেন তিনি।

‘এটা কোনো ম্যাজিকের কৌশল নয়। সবকিছু সত্যি সত্যি ঘটছে, একেবারে সত্যিকারের জাদু,’ আঙ্কেল রণ বললেন।

‘মার্মালেড!’ চেঁচিয়ে উঠল মিমস।

‘এ রকম কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই।’ ব্যঙ্গ করে বললেন আমির রাজ। তিনি তাসের খেলা দেখান।

‘স্যান্ডউইচ!’ ঠোঁট দিয়ে নিজের খাঁচায় ঠোকরাতে ঠোকরাতে আবার চেঁচাল মিমস।

ঘরের টেবিলটাকে চোখের পলকে ঘাস কাটার একটা আস্ত যন্ত্র বানিয়ে ফেললেন আঙ্কেল রণ।

‘আমি এখন কী করব?’ তিনি বললেন। ‘মনে হয় এভাবে নিজের ভাগ্য বদলে ফেলতে পারব। কিন্তু সব সময় এভাবে হাতমোজা পরে থাকতে চাই না। কে জানে, আমি হয়তো ভালো কোনো জিনিসকেও ভয়ংকর কিছুতে রূপান্তর করতে পারব।’

‘তুমি আজ কিছু খেয়েছিলে নাকি, যার জন্য এ রকম হচ্ছে? কিংবা আজকে কোনো অস্বাভাবিক কিছু ঘটেছে?’ জিজ্ঞেস করলেন প্রেস্টো।

‘দাঁড়াও ভেবে দেখা যাক…উম, তেমন কিছু নয়। একটা মাত্র অস্বাভাবিক ঘটনা মনে পড়ছে। সকালে কাজে যাওয়ার সময় আজকে এক বুড়ো মহিলার ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ছুড়ে ফেলে দিয়েছি। ওটা কার পার্কে রাখা ছিল। জানি না, ওটা ওখানে কেন ছিল। যন্ত্রটা দিয়ে তিনি মনে হয় ভয়ংকর কিছু একটা করতে যাচ্ছিলেন। তবে আমার গাড়ির সঙ্গে হেলান দিয়ে রেখেছিলেন ওটা।’

‘তিনি কি বাদামি কোট পরা ছোটখাটো কোনো মহিলা ছিলেন? মাথায় হ্যাটপিনে ঠাসা একটা ফ্লাওয়ারপট হ্যাট পরা?’ লুসি জিজ্ঞেস করল। সেখানে বসে সব কথাই শুনছিল সে। ‘তা–ই ছিল নাকি? হায় হায়, আমি তো ভাবতেই পারিনি। উনি তো মিসেস রিলে। তিনি তো ডাইনি।’

‘বিস্কুট! ক্রিপস! আইসক্রিম!’ মিমসের গলা ভেসে এল।

‘তার মানে বলতে চাইছ, তিনি আমাকে জাদুটোনা করেছেন?’ তোতা পাখির কথা কানে না তুলে গোল্লা গোল্লা চোখে বললেন আঙ্কেল রণ।

‘হাস্যকর কথা, জাদু বলতে আসলে কিছু নেই...,’ প্রেস্টো চ্যাঞ্জো বলতে শুরু করলেন। কিন্তু আঙ্কেল রণ একটা পেনসিলকে চোখের পলকে ছোট্ট একটা কলা বানিয়ে দেওয়ার পর দুম করে মাঝপথে থেমে গেলেন তিনি।

সদ্য প্রস্তুত কলাটা নিজের অজান্তেই ছিলতে ছিলতে আঙ্কেল রণ বললেন, ‘আমার ধারণা, জাদু যে আছে, এটা এইমাত্র প্রমাণিত হলো। এখন গুরুতর প্রশ্ন হলো, এ ব্যাপারে আমরা এখন কী করতে পারি?’

‘তার কাছে গিয়ে ক্ষমা চাও গে,’ বাস্তবসম্মত প্রস্তাব দিলেন প্রেস্টো।

কাজেই মিসেস রিলের বাড়ির দিকে রওনা হলেন আঙ্কেল রণ ও ব্ল্যাকবেরির অন্য ম্যাজিশিয়ানরা। বাড়িটার নম্বর ৩, ডালিয়া ক্রিসেন্ট। সেটা দেখে কোনোভাবেই মনে হয় না যে ওটা সাক্ষাৎ একটা ডাইনির বাড়ি। বাড়ির সামনের বাগানে চমৎকার সব ফুলে ভরা।

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
‘হাস্যকর কথা, জাদু বলতে আসলে কিছু নেই...,’ প্রেস্টো চ্যাঞ্জো বলতে শুরু করলেন। কিন্তু আঙ্কেল রণ একটা পেনসিলকে চোখের পলকে ছোট্ট একটা কলা বানিয়ে দেওয়ার পর দুম করে মাঝপথে থেমে গেলেন তিনি।

লুসি দুবার বেল বাজাল। প্রেস্টো দরজায় বেশ জোরে টোকা দিলেন। জানালা দিয়ে ভেতর উঁকিঝুঁকি দিলেন তারা। কিন্তু জানালার গোবরাটে ঘরোয়া গাছপালায় ছোটখাটো একটা জঙ্গলের সৃষ্টি হয়েছে। সে কারণে খুব বেশি কিছু দেখা গেল না।

‘খুব একটা সুবিধার মনে হচ্ছে না। তিনি মনে হয় ঘুমিয়ে আছেন, নয়তো বাড়ির বাইরে গেছেন,’ হতাশ সুরে বললেন আঙ্কেল রণ।

সবকিছু ছাপিয়ে ভেতর থেকে ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের মতো কোনো যন্ত্রের শব্দ ভেসে আসছিল। একটু পরই বোঝা গেল, সেটা আসলেই ভ্যাকুয়াম ক্লিনার। অবাক কাণ্ড! যন্ত্রটার ওপর চড়ে বসে স্রেফ শূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছিলেন মিসেস রিলে। ভ্যাকুয়াম ক্লিনারটার পেছন দিক দিয়ে ফিনকি দিয়ে ধুলা-ময়লা ছিটকে বেরিয়ে আসছিল। তাতে শূন্যে ছুটে বেড়াতে পারছিল যন্ত্রটা।

‘ওহ্‌, সুইম্বল, তুমি,’ তিনি বললেন। ‘আমার ধারণা, তোমার ওপর থেকে জাদুমন্ত্রটা তুলে নেওয়ার অনুরোধ করতে আমার কাছে এসেছ, তা–ই না?’

‘কিছু যদি মনে না করেন, তাহলে...,’ ভ্যাকুয়াম ক্লিনারটার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আমতা আমতা করে বলতে লাগলেন আঙ্কেল রণ।

‘অবশ্যই মনে করব! যা–ই হোক, তোমরা তো ম্যাজিশিয়ান। সব সময় তো ম্যাজিক দেখিয়ে অনেক কিছু করতে পারো। তাহলে এবার ওই জাদুমন্ত্র থেকে নিজেই নিজেকে উদ্ধার করো গে!’

‘আমরা তো এ রকম ম্যাজিক দেখাই না, ম্যাম,’ প্রেস্টো বললেন।

ঝট করে তার দিকে রাগী চোখে তাকালেন মিসেস রিলে। তারপর দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, ‘তুমি তো জাদুমন্ত্রেই বিশ্বাস করো না! বিড়ালের দাঁত কোথাকার! তাসের খেলা আর হ্যাট থেকে খরগোশ বের করো, হুঁ? তোমরা তো চরম উদ্ধতভাবে আমার জায়গা দখল করে আছ!’

‘কী?’

‘মানে উনি বলতে চাইছেন, তোমরা জোর করে এই জায়গায় ঢুকে পড়েছ। এখানে তোমাদের ঢোকা উচিত হয়নি,’ লুসি বলল। ‘বাবা, উনি আরও রেগে যাওয়ার আগেই এখান থেকে চলে এসো।’

ভ্যাকুয়াম ক্লিনারটা হঠাৎ গোঁ গোঁ শব্দে গর্জে উঠল। আবার ওপরের দিকে উড়তে শুরু করল সেটা।

ডাইনিটা ছাদের ওপর দিয়ে ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে লাগল। সেদিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আঙ্কেল রণ বললেন, ‘আহ্‌! কী অসাধারণ ভদ্রমহিলা। মিস্টার রিলে বলে কি কেউ আছেন? ওহ্‌ হো, তিনি তো কবেই সাগরে হারিয়ে গেছেন, তা–ই না? তিনি নিঃসন্দেহে চমৎকার মহিলা।’

সে রাতে আঙ্কেল রণ আবিষ্কার করলেন, উলের হাতমোজা পরে ঘুমানো খুবই অস্বস্তিকর। কিন্তু তার ভয় হচ্ছিল, তার হাতের স্পর্শে কোনোভাবে তার বিছানাটা হয়তো একটা ধারাল চাকু কিংবা কে জানে একটা ঘোড়াতেও পরিণত হয়ে যেতে পারে। তাই সেগুলো খুলেও রাখার সাহস পেলেন না।

অগত্যা শুয়ে শুয়ে তিনি ভাবতে লাগলেন, এখন কী করা যায়? এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া যায় কীভাবে?

জাদুকরী ক্ষমতার হাত দুটোর জন্য পরদিন কারখানার কাজ থেকে ছুটি নিলেন তিনি। লুসি তার বাবার কারখানায় ফোন করে বলল, তার ফ্লু হয়েছে। কারণ, তার মনে হলো, বাবার বসকে অবিশ্বাস্য সত্যটা বলার চেয়ে এই হাঁচি-কাশির কথাটা বলাই বেশি ভালো হবে।

দুপুরের খাওয়ার সময় তাদের বাসায় এলেন প্রেস্টো চ্যাঞ্জো। তিনি বললেন, ‘শোনো, আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। আচ্ছা, আমরা কি গির্জার ভিকারের কোনো সাহায্য পেতে পারি না?’

‘মিসেস রিলে গির্জার ধর্মসংগীত দলের সদস্য। গির্জায় হাঁটু গেড়ে বসার অসংখ্য কুশন তিনি এমব্রয়ডারি করে দিয়েছেন,’ ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বলল লুসি। ‘কিন্তু তিনি যে ডাইনি, সে কথা পাদরি কাউপারসিল কিছুতেই বিশ্বাস করবেন না। মিসেস রিলে আসলে ভালো মনের মানুষ। তবে একটু বদরাগী এই যা। আসলে মহিলাকে আমারও বেশ পছন্দ।’

‘এক বাক্স চকলেট আর কিছু ফুল নিয়ে যদি তার সঙ্গে একবার দেখা করি, তাহলে হয়তো তিনি আমাকে ক্ষমাও করে দিতে পারেন,’ লজ্জায় একটু লাল হয়ে বললেন আঙ্কেল রণ।

‘কলা!’ চেঁচিয়ে উঠল মিমস।

‘ভাবো একবার, প্রতি সপ্তাহে তিনি লাইব্রেরিতে বই বদল করতে আসেন। তখন তার সঙ্গে দেখা হয়,’ প্রেস্টো বললেন। ‘তিনি ওই লাইব্রেরিতে কাজ করেন। কিন্তু তাকে তো কখনো কোনো জাদুর বই নিতে দেখিনি। শুধু ডাক্তারদের নিয়ে লেখা উপন্যাস নেন, ওই যেমন ধরো, ডক্টর ফিংড্যাঙ্গল অ্যান্ড দ্য অ্যাঞ্জেল অব ওয়ার্ড টেন কিংবা লাভ অ্যামং দ্য বেডপ্যানস টাইপের বই। আবার বাগান করাসংক্রান্ত বইও নেন। যেমন ধরো সহজ উপায়ে ফুল চাষ কিংবা ফুল-পাতা বাহারি লতা। সেদিন যদি তাকে ওই ভ্যাকুয়াম ক্লিনারে চড়ে বেড়াতে না দেখতাম, তাহলে বিশ্বাসই করতাম যে তিনি ডাইনি।’

‘পিজ্জা!’ যোগ করল মিমস।

‘বাগান করেন, তা–ই না?’ বিড়বিড় করলেন আঙ্কেল রণ। ‘আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে...।’

দুপুরের খাবার খেয়ে নিজের সেরা পোশাকটা বেছে গায়ে চড়ালেন আঙ্কেল রণ। মাথার হ্যাটটাও পরিষ্কার করে নিলেন। পকেটগুলোর মধ্যে কিছু ম্যাজিকের কৌশলও ভরে নিতে ভুললেন না। তারপর মিসেস রিলের ছোট্ট পরিচ্ছন্ন বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলেন তিনি।

অনেকবার টোকা দেওয়ার পর দরজা খুললেন মিসেস রিলে।

‘ওহ্‌, আপনি। এক্ষুনি এখান থেকে চলে যান, আমি কিছু করার আগেই...’

‘মিসেস রিলে, আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই,’ নরম গদগদে সুরে আঙ্কেল রণ বললেন। ‘প্লিজ, আমাকে একবার ভেতরে আসতে দিন। নইলে আমি কিন্তু হাতমোজা খুলে আপনার দরজাটা আস্ত পেঙ্গুইন বানিয়ে দেব!’

‘তাহলে পা মুছে আসুন।’

মিসেস রিলের সামনের ছোট ঘরটার ছোট্ট ছোট্ট টেবিল আর ঝকঝকে তকতকে আসবাবের মাঝখানে বসলেন আঙ্কেল রণ। গাছপালার ছোটখাটো জঙ্গলের ভেতর দিয়ে সামনে বসে থাকা ডাইনিটার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘জানেন মিসেস রিলে, আপনার সামনে এখন একটা বিভ্রান্ত মানুষ বসে আছে। আমি যেটাই স্পর্শ করি, সেটা আর আগের মতো থাকে না। এটা আমার স্নায়ুর ওপর প্রচণ্ড চাপ ফেলছে। আমি আসলে দুঃখিত। আরেকটা কথা মি..মি..মিসেস রিলে, তুমি কী আমাকে বিয়ে করবে?’

‘হায় খোদা!’ মিসেস রিলে বলে উঠলেন। চোখের পলকে শূন্য থেকে একটা বেগুনি রঙের হাউস প্ল্যান্ট বের করে আনলেন আঙ্কেল রণ।

‘আমার প্রিয়তমা স্ত্রী মারা যাওয়ার পর অনেক দিন ধরেই এমন একজনকে খুঁজছিলাম, যে কি না সত্যি সত্যি আমার ম্যাজিক বুঝতে পারবে,’ মাথার টুপি থেকে এক বাক্স চকলেট বানাতে বানাতে বললেন আঙ্কেল রণ। ‘আমাকে বিয়ে করো, মিসেস রিলে। তাহলে ব্ল্যাকবেরি শহরে আমিই হব সবচেয়ে সুখী ম্যাজিশিয়ান। আর আমার ওপর থেকে তোমার জাদুমন্ত্রটা যদি তুলে নিতে, তাহলে খুব খুশি হতাম।’

ঘোঁৎ করে নাক টেনে মিসেস রিলে বললেন, ‘কিন্তু এ রকম হুট করে...’

‘হ্যাঁ বলো মিসেস রিলে, নইলে নিজেকে ব্ল্যাকবেরি পৌরসভার বোটিং লেকে ছুড়ে মারব আমি!’ কাঁদো কাঁদো স্বরে বললেন আঙ্কেল রণ।

‘আচ্ছা, ঠিক আছে, হ্যাঁ,’ মিসেস রিলে বললেন।

বিয়েটা কিন্তু বেশ শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হলো। অবশ্য সবার চেয়ে ভালো মানুষটা, মানে প্রেস্টো চ্যাঞ্জো সেদিন আংটি হারিয়ে ফেললেন। কিন্তু আংটির বদলে তার পকেট থেকে একে একে বের করে আনতে লাগলেন বিভিন্ন দেশের পতাকা, এক বাক্স ডিম, একগুচ্ছ কবুতর, এক প্যাকেট তাস, চশমা আর অনেকগুলো পিংপং বল।

এরপর এই সুখী দম্পতি টপহ্যাট ও ঝাড়ুর বাহন দিয়ে বানানো তোরণের নিচ দিয়ে হেঁটে হেঁটে গির্জা থেকে বেরিয়ে এলেন। পাদরি আর্নল্ড কাউপারসিলের কাছে বিষয়টা একটু খাপছাড়া মনে হলেও কিছু বললেন না। এমনকি আঙ্কেল রণ আর তার নতুন বউ যখন টিনের ক্যান আর ফিতা দিয়ে সাজানো একটা ভ্যাকুয়াম ক্লিনারে চড়ে চোখের সামনে দিয়ে উড়ে গেলেন, তখনো কিছুই বললেন না পাদরি মশায়।

লুসির নেতৃত্বে সবাই হইহই করে উঠল।

অবশ্য ব্যতিক্রম ছিল একমাত্র মিমস।

সে তখন জোরে জোরে চিৎকার করে বলছিল, ‘বাঁধাকপি!’

(মূল গল্প: দ্য উইচ’স ভ্যাকুয়াম ক্লিনার)

লেখক পরিচিতি: টেরি প্র্যাচেট (১৯৪৮-২০১৫) জনপ্রিয় ব্রিটিশ লেখক। ফ্যান্টাসি গল্প-উপন্যাসের জন্য তিনি সারা বিশ্বেই জনপ্রিয়। ১৯৭১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস দ্য রেড কার্পেট পিপল। অসংখ্য বই লিখেছেন টেরি প্র্যাচেট। তাঁর বিখ্যাত সিরিজ ডিস্কওয়ার্ল্ড।